নভোনীল -৮ এর শেষ লাইনঃ
মৃণ নভো’ র আঙ্গুলগুলির ফাঁকে নিজের আঙ্গুলগুলি শক্ত করে বেঁধে রাখলো, মৃণের চোখ তখন পানিতে টলোমল যা মন্ত্রমুগ্ধ নভোর চোখেও পড়লো না...
নভোনীল নবমেঃ
মৃণ এর জলভারে নত চোখ আর সমস্ত সত্ত্বায় রেশমি চুড়ির রিনঝিন সিঞ্জন বসন্তের প্রথম দিনকে পূর্ণতা দিলো যেন! নিজের এই ছলকে আসা কান্নায় নিজেই লজ্জা পেলো সে, সারাক্ষণ শুধু এই অনাসক্ত হৃদয়ের দেবদূতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। জানতে ইচ্ছে করে খুব ওর আসক্তি টা কিসে? অবশ্যই আজ পিয়ারু ভাইয়ের ক্যামেরায় কিছু ছবি তুলে রাখবে নভো 'র সাথে।
“ মুখপানে চেয়ে দেখি, ভয় হয় মনে মনে,
ফিরেছ কি ফেরো নাই বুঝিবে কেমনে”
মন্ত্রমুগ্ধ নভো তখন ও মৌনব্রত সন্যাসী, কেবল ঠোঁটের রেখায় হাসি প্রাণখোলা উচ্ছলতায় রূপ নিলো এক সময়।
- মৃণ দেখ তুলতুলি কে? কেমন নিজের মনে নেচে চলেছে গানের সাথে।
- উমম!
এক সমুদ্র অতলান্তিক থেকে বকুল তলায় ফিরল মৃন্ময়ী, নভোর দৃষ্টি অনুসরণ করে মায়ে' দের ভাঁজে শাড়ি পরা লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া এক ছোট্ট পুতুল পুতুল মেয়েকে দেখতে পেলো। যাকে হাত পা বাঁকিয়ে অনুকরণ করে চলেছ ও। নভোর উচ্ছ্বাস ও মৃণ মাঝে অনুরণিত হল। মুগ্ধতা গুলো মালা ছেড়া মুক্তার মত আলগোছে বকুল তলায় ঝরে পরছে, যেন বকুল ঝরার অভাব মেটাচ্ছে এই ফাগুনে। আর ওপাশে বুড়ি নেচেই চলেছে.........
" মাদল বাজে সেই সংকেতে
শ্যামা মেয়ে নাচে
পাগলপারা চাঁদের আলো
নাচের তালে মেশে
নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক"
- উফ এত গরম লাগছে কেন বলতো ?
- কী চমৎকার বাতাস গরম কোথায়!
নাহ হয়ত জনারণ্য’ ই আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে, জানো মা' য়ের খুব ইচ্ছে ছিল আমি ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে পড়ি উনার বিভাগে। শিক্ষক হই, আমি নাকি দেখতে মা' য়ের প্রিয় শিক্ষকের মত, আমার মা প্রায়শই স্বপ্নে দেখতেন আমি ক্লাস ভর্তি ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছি। শুধুমাত্র এই কলাভবন থাকতে হবে ভয়ে কার্জন হল বেছে নিয়েছি। অবশ্য বাবা ভীষণ আনন্দিত! আমার সাথে দেখে করতে এসে কার্জনের জলে নিজের ফেলে আসা সময়ের প্রতিচ্ছবি দেখেন। মানুষ আমার এত প্রিয় কিন্তু!
- কিন্তু কি? বেশি মানুষ ভালো লাগে না, তাই তো।
পায়ে পায়ে ওরা ততক্ষণে দোয়েল চত্বর, হুট করে পায়ে জড়ানো গুলঞ্চ লতার মত মৃন্ময়ীর শাড়ি জড়িয়ে ফুটে উঠলো ঝুমকো লতার মত একটা মুখ, আঁজলায় স্বর্ণচাঁপার ডালি।
-কিরে জবা এতক্ষণে আমাকে খুঁজে পেলি ?
-তুমারে কইছি না, আউজকার পরথম ফুল তুমারে দিমু। দেহ দেহ সবফুল নষ্ট অইয়া যাইতাছে রইদ্দে তারপর ও বেচলাম না। কই আছিলা আপা?
- এই যে নভো ও হচ্ছে জবা, আমরা কিন্তু খুব বন্ধু।
- হুউউ একদম ঝুমকো জবা। মৃণ্ময়ী ব্যাগ খুলে বেশ বড় একটা বক্স দিলো জবা কে, খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নিজের ঝোলায় রেখে। সবচাইতে সোনা রোদের মতো উজ্জ্বল একগুচ্ছ স্বর্ণচাঁপা দিলো ওকে। তারপর হারিয়ে গেলো অরণ্যে, অবশ্যই জনারণ্যে।
- তুমি প্রতিনিয়ত আমাকে মুগ্ধ করে চলো মৃ। তোমার দৃষ্টির স্বচ্ছতা তোমার হৃদয়ের জলছাপ।
- মিঃ দেবদূত কিসে মুগ্ধ করলাম তোমায় ?
- সে না হয় কাল বলবো, কিন্তু তুমি যে আমায় কানাবাবা শুভ্র বানিয়ে দিলে, এর কি হবে? আমি তো গ্লাস ও নেই না
এই দেখ দৃষ্টিতে বৃষ্টি ঝরে ঝরনা।
- ( চাপা হাসিতে উৎসুক হয়ে ) আছে নাকি এমন কোন নাম তোমার ?
- তেমন সার্বজনীন নেই কিন্তু পরিচিত সার্কেলে আছে।
- বলতো শুনি !
- রা রা রাস পুতিন রাশান লাভ মেশিন।
সাথে সাথে মৃন্ময়ী ও গাইতে শুরু করলো
"দৃষ্টিতে যেন সে রাসপুতিন
খুন হয়ে যাই আমি প্রতিদিন”
দুজনেই হাসির ঢেউ হয়ে আছড়ে পরল ফুটপাতে।
উপড়ে উঠে নভো'র দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল;
" হাত বাড়িয়ে হাত চেয়েছি, রাখতে দিও, রেখো "
- হেলাল হাফিজ, তাই না? ভালোবাসা যাকে খায় এইভাবে সবটুকু খায়।
- হুউউ যে জলে আগুণ জ্বলে। তবে আমার চোখে মায়ার কাজল পরিয়ে রেখেছে পৃথিবীর সমস্ত প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী "আবুল হাসান" আর তোমার ?
- আমি !!!
" আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি
ছল করে দেখা অনুক্ষন
বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেইদিন হব শান্ত "
- ব্বাবাহ তুমি দেখছি বাউন্ডেলে'র ভক্ত হয়ে ও ঠাকুর মশায় কে চা' য়ে জলে পান কর !!
- পাঠের বেলায়, সঙ্গীতের বেলায় আমি সর্বভুক ।
- আচ্ছা তোমার অপু' র দেখা নেই কেন এত বেলায় ও ?
- আমার অপু? মেঘাচ্ছন দৃষ্টিতে জানতে চাইলো মৃন্ময়ী!
- বা রে মৃণ্ময়ীর জন্য তো আর অমিত দেখা দেবে না, না বলে কয়ে তো অপূর্ব কৃষ্ণের মনেই তার বসবাস। নিজেকেই নিজে একটা মাথায় গাট্টা দিলো দিলো মৃণ্ময়ী, এই তাহলে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এর রহস্য ? এর আগেও একদিন অপূর্ব কৃষ্ণ নিয়ে এবং শেষ দৃশ্য নিয়ে মজা করেছে; এবং এ জন্যই সেদিন অমিতের জন্য অপেক্ষা করছি বলার পরও নির্বিকার জনাব।
-তোমার জন্য তাহলে কে ?
- এই কে টা কে !
- কে আবার তোমার প্রাণের মানুষ ।
- ওহ! " আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে তাই হেরি তায় সকল খানে।
আছে সে নয়নতারায় আলোক ধারায় তাই না হারায়
ওগো তাই দেখি তায় যেথায় সেথায় তাকাই আমি যে দিক পানে"
- আচ্ছা অপেক্ষা তাহলে মিঃ অমিত রায় এর লাবন্যে'র ?
- না না আমি সূর্য
আমি ই ত্রিদিবেশ
- ভাগ্যিস ধ্রুব নও
- কিন্তু ধ্রুবর তো ব্যাপক চাহিদা তোমাদের সমাজে ?
- সে যার কাছে হোক আমার কাছে নেই।
গল্পে র মাঝে নভো র দৃষ্টির চাঞ্চল্য মৃণ্ময়ীর চোখ এড়ালো না, ততক্ষণে ওরা টি এস সি র লাল চা' য়ে ডুবেছে।
- এই যে মিঃ রাসপুতিন ফাগুণের আগুণে ও সমগ্র সত্ত্বায় বেহাগের সুর? ব্যাপার কি! প্রশ্নের উৎস অনুসরণ করে ফাগুণ বনের পলাশের দেখা পেলো মৃণ্ময়ী। আর নভোর দৃষ্টির ঔজ্জ্বল্যের কারণ।
- মৃণ চিনেছ ?
- আপু'কে না চিনলে তো আমার ডিপার্টমেন্টের ছাত্রত্ত বাতিল হয়ে যেতে পারে ফাইনাল ইয়ারের মাধবী আপু একাধারে চৌকশ মেধাবী এবং রেকর্ড মার্কসের অধিকারী। তবে তোমার সাথে পরিচয় আছে এটুকু অজানা ছিল। বুঝলাম উনি তোমার সার্বজনীন নন, নিজস্ব পরিমন্ডলের কেউ।
- হ্যাঁ ! অবশ্য অন্য একটা পরিচয় আছে, উনি আমাদের রাজশাহীর প্রতিবেশী, পাশাপাশি বাসায় আমাদের বসবাস আজন্ম। আমার বাবা' র সহকর্মীর মেয়ে।
- হয়েছে হয়েছে সিনিয়রদের কে অবশ্যই হাতে রাখতে হয়, তাইবলে অতটা! সে যাইহোক নভো সেদিন ফিজিক্স ক্লাসে' কি হয়েছিলো? তুমি তো দেখছি টক অব দ্যা ডিপার্টমেন্টে পরিণত হয়েছ!
- আর বোলো না পড়াচ্ছেন উচ্চমাধ্যমিক লেবেলের পড়া এর মাঝে সবাই কে সাধারণ ব্যাপারে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন। আমাকে জিজ্ঞেস করেন বলেন তো " শব্দের গতি বেশি না আলোর গতি " আমি বললাম স্যার শব্দের। উনি থ আর পুরো ক্লাস নিস্তব্ধ। চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন কুড উ প্লিজ এক্সপ্লেই? আমি উত্তর দিলাম " স্যার আমাদের বাসায় টি ভি অন্য করলে আগে শব্দ শুনতে পাই। ক্লাসে হাসির বন্যা বয়ে গেলো আর স্যারের টাক বেয়ে ঘাম।
এক মিনিট আসছি বলে নভো টি এস সি র দোতালার দিকে পা বাড়ালো।
- আরেয় না আমাকে এক্ষুনি রুমে ফিরতে হবে, রুমমেট কে ওর স্টেজের সামনে রেখে গেলাম, পরশু পরীক্ষা আছে।
- যাবে তো! আমি তোমাকে হল গেটে রেখে আসছি।
- একেবারেই দরকার নেই রে ঐটুকু ই তো পথ, পড়তে গিয়ে মাথা হ্যাং এরপর ই ভাবলাম যাই একটু ফ্রেশ হয়ে আসি চটপটির ঝালে তাছাড়া মৃণ্ময়ী একা হয়ে যাবে, তোমাদের বন্ধুরা ও নেই সাথে। তোমরা থাকো।
- সে হচ্ছে না আমি আসছি আর তাছাড়া ওর গাড়ি আশেপাশেই আছে ও বাসায় চলে যাবে। বলেই নভো নিজের ব্যাগ হাতে দৌড়ে চলে গেলো, ফিরে এলো আগের সেই কালো টি- শার্টে। পাঞ্জাবিটা মৃণ্ময়ীর এর হৃদয়ের মত দুমড়ে মুচড়ে ওর হাতে তুলে দিলো বলল- কাল আসছ তো ক্যাম্পাসে! দেখা হবে।
ওদের চলে যাওয়া পথের ধুলার আলপনা বড্ড সুখের ছবি আঁকতে লাগলো মৃণ্ময়ীর আনত দৃষ্টিতে।
১৪ই ফেব্রুয়ারি সকালের বাসে ক্যাম্পাসে চলে এলো মৃণ্ময়ী। গাড়ি আছে অজুহাতে ওকে যেন একা ফেলে যেতে না পারে তাই সে ট্রাফিক জ্যামের কারণ দেখিয়ে বাসে এসেছে। এক জীবনের সবটুকু ভালোবাসার নির্যাস এর সুবাসে লেখা চিঠিটা হাতের মুঠোয় রাখল। গেটে নামতেই বিস্ময়ে ধাক্কা! এদিকেই আসছে নভো, দৃঢ় পদক্ষেপ যেন আজ দিকভ্রান্ত ধকধক করে জ্বলা প্রখর দৃষ্টিতে রক্তিমাভ নেমেছে। মৃণ্ময়ীর ক্যাবল একটাই প্রার্থনা! আজ যেন ছুঁয়ে দিলেই ফল্গুধারা বয় আজ শুধুই ব্যাকুল আর শর্ত বিহীন নত ভালোবাসা।
" হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে! মন বাড়িয়ে ছুঁই"
মুখোমুখি হতেই নিজেকে সামলে নিলো নভো।
- এই দেখ তোমার বন্ধুদের আজকের ভোজন।
- মানে, কি আছে এতে ?
- বা' রে আজ বুঝি কাঠ বাদামের তলায় তোমাদের ভোজসভা নেই ?
- তুমি জানলে কি করে ?
- কতদিন দেখেছি তোমাদের আড্ডা, আমি কাছে গেলে যদি ওরা ভয় পেয়ে আর খেতে না আসে, তাই সামনে যাই নি। তোমার কোমল মনের উত্তাপটুকু অনুভব করার চেষ্টা করেছি শুধু। পথের এই কুকুর দের ও যে কেউ এতটা যত্নে ভালোবাসা নিয়ে খাওয়ায়, তোমাকে দেখে ই বুঝলাম। সত্যি'ই মৃ তুমি অনন্য।
- হয়েছে হয়েছে ৯.৩০ এ ক্লাস আছে, আগে সেটা শেষ করি।
- আজ আর ক্লাসে যাবো না সমস্ত রাতের ক্লান্তি আমায় ভর করেছে।
কথাটার মাঝে যে বেদনা, নভোর চোখে তার বিন্দুমাত্র লেশ নেই সেখানে না পাবার তীব্রতা ফুটে আছে, কিছু না বলে চোখের কাজলে প্রশ্ন রাখলো।
- জানো মৃণ আমার অসহ্য সুখের মুহূর্তগুলো সব সময় দীঘল সূর্যের ওপাড়ে থেকে আবীর রঙের রঙ ছড়াবে আমার জীবনে, কিন্তু কখনোই আমার করে পাবো না। পৃথিবীর সমস্ত বিষণ্ণতার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করা এই আমি আজ তার চোখেই বেহাগের করুন সুর বয়ে চলা এক বালক। তার কাছে না হয় একটা সফল প্রেমের গল্প আছে, আমার তো নেই! কতদিন বালক থাকব বলতে পারো? নিজের জন্মের সময় নির্ধারণ কারী তো আমি নই! তবে কেন কেবল মাত্র কয়েক'টা সংখ্যার জন্য, মাধবী কে ভালোবাসার মাধবী কে পাবার আবেদনে অযোগ্য বিবেচিত হলাম। গতকাল সমস্ত রাতজাগা তারারা আমাকে কথা দিয়েছে আজীবন ওরা আমার ভালোবাসার মানুষের ওড়নার আঁচলে জমা থাকবে। আমার মাধবী'র জীবনের আনন্দের প্রদীপ হয়ে! আমার চোখের শেষ অশ্রুটুকু ও চুরি হয়ে গেলো মৃ ...
খুব আলগোছে কাল রাতে লেখা দীর্ঘ চিঠিটা ব্যাগের পকেটে গুঁজে দিলো মৃন্ময়ী!
“ সব কথা তোমাকে জানাবো ভেবেছিলাম
কিনে এনেছিলাম আকাশী রঙের
বিলিতি হাওয়াই চিঠি
সে চিঠির অক্ষরে অক্ষরে লেখা যেত
কেন তোমাকে এখনো চিঠি লেখারকথা ভাবি”
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ
The Beauty of DU campus
নভোনীল (অসম্পূর্ণ লেখা)
পর্ব -২ ব্লগার পদ্মপুকুর
পরব-৩ ব্লগার মেঘশুভ্রনীল
চতুর্থ পর্ব ব্লগার খায়রুল আহসান
নভোনীল -৫ ব্লগার আখেনাটেন
নভোনীল -৬ ব্লগার পুলক ঢালী
পরব-৭ ব্লগার নিয়াজ সুমন
নভোনীল -৮ ব্লগার কবিতা পড়ার প্রহর