somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুদৃশ্য পুলিশ কারে চড়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো 'বুটস' =

১০ ই জানুয়ারি, ২০২১ ভোর ৪:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সুদৃশ্য পুলিশ কারে চড়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো 'বুটস'

গেল সোমবার সকাল এগারোটার কাছাকাছি। ঠক ঠক করে ঘরের বন্ধ দরোজায় বাইর থেকে নক করা হচ্ছে।

'কে' জানতে চাইলে আওয়াজ পাওয়া গেলো, 'আমি RCMP (পুলিশ), আপনাদের এখনই বাসা ত্যাগ করে বাইরে যেতে হবে।'

বাসার ভিতরে থেকেই জানতে চাইলাম, 'সমস্যা কি?'

- 'ফ্লাডিং। তাড়াতাড়ি বাসা ছাড়ুন।'

গেলো কদিন বৃষ্টি হতে দেখিনি, তারপরও ফ্লাড বা বন্যার কথা শুনে মনে খটকা লাগলো। দরজা খুলে দেখি আশপাশের অন্য বাসাগুলোতেও পুলিশ একইভাবে মানুষকে বাসা ছাড়তে বলছে।

কানাডার আলবার্টা প্রদেশের ফোর্ট ম্যাকমারী শহরে এসেছি কয়েকদিনের জন্য। এরই মাঝে এ দুর্যোগে পড়লাম। বাসায় আমি, আমার সহধর্মিনী হালিমা আফরিন, আর আমাদের দুই ছেলে, সাঈদ এবং আয়মান। দশ-পনেরো মিনিটেই জরুরি কিছু জিনিস নিয়ে নিচে নেমে গেলাম আমরা। সাথে আছে, আমাদের পোষা বেড়াল 'বুটস', রেগডল (ragdoll) প্রজাতির; বয়স এক বছর। বয়স কম হলেও 'বুটস' আকারে বেশ বড়ো, প্রায় দেড়ফুট লম্বা। শরীরের বেশির ভাগই সাদা, তবে, মুখে আর পিঠে কালচে কিছু লোম আছে। দেখতে খানিক কুকুর বা প্যান্ডার মতোও লাগে।

এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের নিচে নেমে দেখি আরো কয়েক পুলিশ এবং সিকিউরিটি দাঁড়িয়ে। পূর্বদিকে শ'খানেক গজ দূরে রাস্তায় হাঁটু জল। বৃষ্টি বাদল নয়, আইস জ্যাম থেকে ফ্লাড হয়েছে।

আইস জ্যাম কিভাবে হয় জানেন? নদীতে ভাসমান বরফ কোথাও আটকে গিয়ে যখন পানির স্বাভাবিক প্রবাহের সাথে আর চলতে পারে না, তখনই তৈরী হয় আইস জ্যাম, যা উজান পথে পানির গতিহ্রাস ও জলের উচ্চতা বাড়িয়ে দিয়ে ফ্লাড তৈরী করে। কানাডার অনেক জায়গায় এখনো শীতের বরফ পুরোপুরি গলেনি। আমাদের এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের কাছেই দুই কিলোমিটারের মধ্যেই আতাবাস্কা নদী।
পুলিশ আমাদের হাতে একটা ঠিকানা ধরিয়ে দিয়ে বললো ওই ঠিকানায় গিয়ে আমাদের নাম ফ্লাড ভিকটিমদের তালিকাভুক্ত করতে। মিনিট দশেক গাড়ি চালিয়ে গেলাম মাঠের মতো এক খোলা জায়গায়। সেখানে আমাদের মতো আরো কয়েকশ মানুষ জড়ো হয়েছে নিজনিজ গাড়ি নিয়ে। শতশত গাড়ি লাইন ধরেছে মাঠের চারপাশে। সিটি কর্পোরেশনের কর্মচারী আর স্বেচ্ছাসেবীরা মিলে আমাদের জন্য কোথায় সাময়িক থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় তা নিয়ে কাজ করছেন।

স্বেচ্ছাসেবীদের মাঝে মিস আলবারটাকেও দেখলাম। আহামরি সুন্দরী মনে হলো না, তবে, তাঁর অন্য অনেক গুণও হয়তোবা আছে। সনাক্ত করলাম তাঁর বুকে মিস আলবার্টা ব্যাজ দেখে। এদেশে স্বেচ্ছাসেবী কাজ করার সুযোগ পেলে সেলিব্রিটিসহ অনেকেই মাঠে নেমে পড়ে, এটাই কালচার। এমন কি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ডাক্তারি বা তেমন প্রতিযোগিতামূলক প্রোগ্রামে ভর্তি হতেও আবেদনকারী পড়াশোনার পাশাপাশি কত ঘন্টা স্বেচ্ছাসেবী কাজ করেছে তা খতিয়ে দেখা হয়।

এ শহরে প্রায় তের হাজার মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এদের সবারই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে সিটি কর্পোরেশনকে। তার উপর আবার কোভিড-১৯ এর ঝামেলা তো আছেই। অবশেষে আমাদের চারজনের নামও রেজিস্ট্রেশনে এলো। ঘন্টা খানেক ড্রাইভিং দূরত্বে ম্যাকলিলেন্ড লেইক লজ'এ তিনটি কক্ষ দিয়ে আমাদের সাময়িক আবাসনের ব্যবস্থা করা হলো। খাবারের ব্যবস্থাও হলো সেখানে। এই লজ'এ প্রায় পাঁচশ মানুষের থাকা খাওয়ার ব্যৱস্থা হয়েছে। বাকিদের আশেপাশের শহরের বিভিন্ন হোটেলে জায়গা দেয়া হলো।

এই লজ'এ আজ আমাদের পঞ্চম দিন। থাকা খাওয়া ফ্রি, সমস্যা বলতে তেমন কিছু নেই। লজ এর একটি বড়ো কক্ষে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগও করে দেয়া হয়েছে। প্রতি রুমে এয়ারকন্ডিশনার, টিভি এবং বাথরুম আছে। অনেকটা হোটেলের মতোই। প্রতিদিন ইমেইল বা ফোনে সিটি কর্পোরেশন ও অন্যান্য অফিস হতে আমাদের জানানো হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে। সামনের সপ্তাহের শুরুর দিকে সম্ভবত বাসায় ফিরে যেতে পারবো তেমন ইঙ্গিতই পাচ্ছি।

ম্যাকলিলেন্ড লেইক লজ'এ এক প্রকার আরামেই আছি বলতে পারেন। তারপরও ছেলে দুটোর মন ভালো নেই। তাদের চিন্তা পোষা বেড়াল বুটস'কে নিয়ে। নাম ধরে ডাকলে কাছে আসে, পায়ের আশপাশে ঘুরে বেড়ায়, মাঝে মাঝে লাফ দিয়ে কোলে বসে পরে, আদর নিতে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে; আহ, কি যে মায়া!

বুটস কিন্তু আমাদের সাথে নেই। এনিমেল কন্ট্রোল ডিপার্টনমেন্ট ওকে তাদের গাড়িতে চড়িয়ে নিয়ে গেছে আমরা বাসা ছেড়ে নিচে নামার পরপরই। তার আগে আমাদের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে বিড়ালটির নাম, জন্ম তারিখ কবে, নিউটার করেছি কিনা, ভেকসিন আপ টু ডেট আছে কিনা, কি খাবার পছন্দ করে, অন্য বিড়ালদের সাথে ফ্রেন্ডলি কিনা, ইত্যাদি। বুটসকে পুলিশের কাছে হস্তান্তরের সময় আমাদের আয়মান কান্নাকাটি শুরু করে দিলে উপস্থিত মহিলা পুলিশ তাকে আশ্বস্থ করে বললেন, 'আমরা সুযোগমতো তোমার সাথে বুটসকে মিট করার ব্যবস্থা করবো; কেঁদো না।' এর কিছুক্ষনের মধ্যে সুদৃশ্য পুলিশ কারে চড়ে বুটস অদৃশ্য হয়ে গেলো। চোখ ঝাপসা হলো আমাদেরও।

সমস্যা বলতে এই এক জায়গায়। তাড়াহুড়ো করে বাসা ছাড়তে গিয়ে লুঙ্গি নিতে ভুলে গেছি। বাসায় লুঙ্গি পড়ার অভ্যাস আমার দীর্ঘদিনের। লুঙ্গি ছাড়া নতুন জায়গায় এসে কিছুটা অস্বস্তিতে আছি দেখে আমার স্ত্রী বললো লুঙ্গির পরিবর্তে তার একটা পেটিকোট পড়তে। প্রথমত রাজি হলাম না এ কারণে, মেয়েদের কাপড় পরছি দেখে মানুষ আবার কি বলে! ব্যাপারটি তাকে জানালে সে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলো, 'এখানে তো আমরা ছাড়া আর কোন বাংলাদেশী নেই; তারা কি করে জানবে ওটা ছেলেদের না মেয়েদের পোশাক?' - বাহ্, সত্যি তো! সাহস করে পরে ফেললাম, কেউ আজও কিছু বলেনি। তারা হয়তো ভেবেছে, আমাদের কালচারে ছেলেরা ওধরণের কাপড় পরে। করোনায় নাই হয়ে যাই ভয়ে নূরানী চেহারা বানাতে গুছি দাড়ি রেখেছি। মাথা ন্যাড়া করেছি তারও কিছুদিন আগে। এ অবস্থায় গায়ে শার্ট, পরনে গেরুয়া রঙের পেটিকোট, আর পায়ে জুতো; এমন কোন পুরুষকে দেখতে কেমন লাগতে পারে ভাবুন তো বন্ধুরা! আপনারা আনফ্রেন্ড করতে পারেন ভয়ে ফেইসবুকে ছবি দিতে পারলাম না! - - -

বন্যার পানি নেমে গেছে বলে আজ জানলাম। তবে, ক্ষতিগ্রস্থ বাড়িঘরগুলো আবাসযোগ্য হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করতে আরো কিছু সময় লাগছে। তাই, আমরা এখনো অস্থায়ী আবাসনেই আছি। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হতে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই সরবরাহ করছে সিটি তথা সরকারের তরফ হতে। তার উপর আবার বন্যার কারণে আমাদের যে ভোগান্তি হচ্ছে তার জন্য আমাদের কিছু আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে বলেও গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। বাহ্, জামাই আদরের চেয়েও বেশি কিছু নয় কী?

সামান্য হাঁটুজলেই কানাডা তার সাধারণ নাগরিক, এমনকি তাদের পোষা প্রাণীদের সেবায় যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছে তা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ভাবলে কেমন যেন লাগে। সামান্য বৃষ্টিতেই তো ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো বড়ো শহরেও হাঁটু, বা কোমর জলে দেশের নারী পুরুষ একপ্রকার সাঁতরাতে থাকে। জানি, বাংলাদেশ ততটা ধনী নয়। তারপরও, সিটি কর্পোরেশন বা সরকারের তরফ হতে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের ভালোমন্দের সামান্য খোঁজখবরও নেয়া হয় কি? নগরবাসীরা কিন্তু সিটি কর্পোরেশনকে ট্যাক্স ঠিকই দেন, আমরা যেমন দেই কানাডায়।

- এম এল গনি/ কানাডা/ ১ মে, ২০২০
[email protected]

সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জানুয়ারি, ২০২১ ভোর ৪:১১
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×