somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উন্নয়নকর্মীর স্মৃতি- ২: পত্নীতলায় আদিবাসী পল্লীতে হামলার ঘটনার তথ্য সংগ্রহ ও প্রতিবাদ

২৬ শে জুন, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সেটা সম্ভবত ২০১০ সালের কথা। আমি তখন ব্রতী নামে একটি জাতীয় পর্যায়ের এনজিও’র রাজশাহী অফিসে অ্যাসিসটেন্ট প্রোগ্রাম অফিসার হিসাবে কাজ করতাম। রাজশাহী’র তানোরে ছিল আমার অফিস।

আমাদের প্রকল্পের কাজের অন্যতম একটা বিষয় ছিল স্থানীয় আদিবাসী জনগণের অধিকার সুরক্ষার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
আমার অফিস তানোরে হলেও উপজেলার পাঁচন্দর ও বাধাইড় ইউনিয়নের পাশাপাশি নওগাঁ জেলার মান্দা আর মহাদেবপুর উপজেলাতেও কাজ ছিল আমাদের। এছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, নওগাঁর পত্নীতলা, পোরশা যেখানেই আদিবাসীদের উপর কোন ধরনের আক্রমণ হতো আমরা ছুটে যেতাম সেখানে।

দিন, মাস, তারিখের হিসাব এখন আর মনে নেই এত বছর পরে। তবে আমার কোন সহকর্মীর মনে থাকতে পারে। সাল ২০১০ এর কোন এক মাসে একদিন সকালবেলায় খবর এলো নওগাঁ জেলার পত্নীতলায় আদিবাসী পল্লীতে হামলা করে তাদেরকে গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। অফিস থেকে দায়িত্ব পড়ে গেল ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। আরো বেশ কয়েকজন অ্যাসিসটেন্ট প্রোগ্রাম অফিসার থাকলেও এসব রিস্কি কাজে অফিস আমাকে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতো। আমিও মাথা পেতে নিতাম দায়িত্ব।

পরের দিন সকালে আমি তানোর থেকে রওনা হলাম অফিসের মোটরসাইকেল নিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল, দিনে গিয়ে কাজ করে আবার ফিরে আসতে হবে। আমি মান্দা গিয়ে পৌঁছলে আমার সাথে যুক্ত হলো আমার তৎকালীন সহকর্মী আলমগীর হোসেন আর ফটোগ্রাফার মিলন। ওরা দু’জনেই খুবই উৎসাহী আর সাহসী কর্মী ছিল আমাদের। মান্দা থেকে রওনা দিয়ে আমরা যখন পত্নতলা পৌঁছলাম তখন প্রায় ১ টা বাজে। লাঞ্চের সময়। কিন্তু আমরা লাঞ্চ না করে সরাসরি চলে গেলাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। আমরা আগেই খবর পেয়েছিলাম অনেক আদিবাসী আহত হয়ে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। হাসপাতালে গিয়ে তাদের খোঁজ-খবর নিলাম। জানা গেলো ঘটনা মর্মান্তিক।

হাসপাতাল থেকে বের হয়ে উপজেলার পাশেই একটা মাঠ ছিল তখন সেখানে আদিবাসীরা জমা হয়েছিল প্রতিবাদ করতে। আমরাও গিয়ে যুক্ত হলাম সেই প্রতিবাদে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের তৎকালীন সভাপতি প্রয়াত অনিল মারান্ডি দা আর সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ সরেন (রবিনদা)। রবিনদা এখন অবশ্য আদিবাসী পরিষদের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রথমে বিক্ষোভ মিছিলের পরিকল্পনা তাদের না থাকলেও আমার উৎসাহেই তারা মিছিল করতে সাহস পায়। উপজেলা চত্ত্বর এবং বাজার এলাকায় একটা বিক্ষোভ মিছিল করি আর তার দুইদিন পরে আবার মানববন্ধন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

তারপর কোনমতে একটু কিছু খেয়ে ছুটলাম আদিবাসী পল্লীর দিকে যেখানে হামলা হয়েছে। তখন ছিল বর্ষাকাল তাই চারদিকে পানি আর কাদা। মাঠের ভেতর কাদা-পানি মাড়িয়ে সেই গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হলাম। সেখানে গিয়ে দেখি কোন বাড়ি-ঘর নেই। আছে শুধু ধ্বংসাবশেষ। সেখানে আদিবাসীদের পাশে কয়েকঘর দরিদ্র শ্রমজীবী মুসলিম পরিবারও ছিল। তাদেরকেও উচ্ছেদ করা হয়েছে একইসাথে।

আমরা আদিবাসীদের নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ফিরছিলাম। হঠাৎ বাজার এলাকায় এসে দেখি অবস্থা বেগতিক। স্থানীয় ক্ষমতাবান যারা আদিবাসীদের উচ্ছেদ করেছে তাদের জমি দখল করে নেবার জন্য তারা জনা পঞ্চাশেক মানুষ দাঁড়িয়ে জটলা পাকাচ্ছে। আর আর আমরা মাত্র ৩ জন। আদিবাসীরাও সাথে কেউ নেই আমাদের। ওরা আমাদের ঘিরে ধরলো। কি আর করা? আমাকে জিজ্ঞেস করলো আপনারা করা? আমি মিথ্যে করে বললাম, সাংবাদিক। কারণ এনজিও পরিচয় দিলে সেদিন ওরা আমাদের কি যে অবস্থা করতো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আত্মরক্ষার জন্য আমার দেওয়া সাংবাদিক পরিচয়ে তারা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল সে সময়। এই ফাঁকে মোটর সাইকেল নিয়ে পালিয়ে ফিরে আসি কোন রকমে। মোটর সাইকেল টান দিতেই ওরা পেছনে পেছনে ধাওয়া করে কিন্তু আমাদের আর ধরতে পারেনি সেদিন।

দু’দিন পরে আবার যাই পত্নীতলায় প্রতিবাদী মানববন্ধনে অংশ নিতে। সেদিন আমাদের সাথে যুক্ত হন আমাদের তৎকালীন প্রোগ্রাম অফিসার সোহেল রানা ভাই। তারপর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অফিসে গিয়ে স্বারকলিপি প্রদান করি সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবিতে। সেদিনও আদিবাসী পরিষদের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন সভাপতি প্রয়াত অনিল মারান্ডি দা আর সে সময়ের সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ সরেন (রবিনদা)সহ আরো অনেক নেতৃবৃন্দ। তবে সেদিন ফিরে আসবার সময় আর কোন সমস্যা হয়নি।

এমন হাজারো স্মৃতি এখনো ঘুরে বেড়ায় মনের আনাচে-কানাচে। মন পড়ে রয় মানুষের মাঝে। মনে হয় একটা জীবনে অন্যায়ে প্রতিবাদ করে বেঁচে থাকতে পারার ভেতরে অনেক শান্তি বিরাজিত আছে।

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:০২
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×