___"শ্যামলী থিকা; নীলক্ষেত। স্টুডেন্ট।"___ কথা লক্ষ্য করে চেয়ে দেখি কন্ডাক্টর মামা বেজার মুখে টাকাটা নিয়ে অন্য যাত্রীর দিকে এগুচ্ছেন।
ফোনের দড়ি কানে গুঁজে বাসের জানালায় মুখ বুজে শুক্লপক্ষের দ্বাদশীতে চোখ রেখে ফিরছিলাম। অগ্রীম টিকিট কিনতে গিয়েছিলাম ঈদের। বাস মালিকে রাতারাতি সংসদের চালকে পরিণত হবার হাতাহাতিতে টিকেট বিক্রি বন্ধ রেখেছে তাদের। আবার যেতে হবে তাই। এই ছন্নছাড়া প্যাড়ার শহরে কোন ন্যাড়ায় একাধিকবার জ্যামের বেলতলায় যেতে চায়? তার ওপরে আবার এই কাঁঠাল পাকা গরমে! মেজাজ তো ভাই থাকবেই চড়ে চরমে। পাশের সিটে ভোলা। বাসেই দেখা; কন্ডাক্টরকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো ওর-ই বলা।
হাফ-ভাড়া দিতে চাওয়ায় মনটা আরো গেল খিচড়ে। রাতের কাঁটা আছে এখন সাড়ে আটটার ঘাড়ে চড়ে! দিতি ওরে অরিজিনাল ভাড়াটা; আরো ৫ টা টাকা বেশি! নীতি-ফিতীর কথায় পরে আসি__শহরে যারা চরে টিউশুনি করে, ৫ টাকার মূল্য তারাই শুধু মর্মে মর্মে অনুভব করে। ও আর আমি আবার সেই জমায়েতের একেবারে প্রথম কাতারে। নিজেও যে এমনটা কভূ করিনি তা কিন্তু না। তবুও কেন জানি আজ উল্টো বিরক্তি জন্মালে, মনে সায় দিলে না।
আকাশ দুলালীর রূপালী বর্ণচ্ছটাও আজ তাই মনে হতে লাগলো মরচে ধরে মরা। সে চাঁদও পড়ছে ঢাকা বার-বারে গাছ-গাছালী, বিল্ডিং, বিলবোর্ড-হোল্ডিং ছবির আড়ে আড়ে। বেখাপ্পা এ শহর, বেখাপ্পা অশৌখিন-আনাড়ি তার পতি, শওহর।
বাসের জানালায় পুনরায় নজর রেখে এমনি ভাবছিলাম সাতে পাঁচে। ততক্ষণে বাস মানিক মিয়া-আড়ংয়ের জ্যামে জমে গেছে। কোলের পরে কী যেন একটা ঠপ্ করে পড়লে। টাকা দরের একটা সস্তা চকলেট রাতের আলোয় চেয়ে হাসলে!
মুখ তুলে দেখি___
এই বছর তেরোর মতো হবে আর কী!
টিউশন করে ফেরার পথে আগেও দেখেছি ওরে।
খালি হাত, খালি পা, ময়লা সালোয়ার কামিজে তেল চিটচিটে ওড়নাটা ফেলে রাখে মাথার 'পরে।
কোথাও কোনো কথা বলে না, ১টা করে চকলেট দিয়ে যায় শুধু।
নিরাসক্ত থমথমে মুখে, মরু সাহারার বিরান বালি ধূ ধূ!
বিনিময়ে কেউ সাহায্যে দু-পাঁচ টাকায়, কেউ শুধু ফেরায় চকলেটটাই।
৩২-এর কাছাকাছি কোথাও যেন নেমে যায়।
ও দেখলাম মানি ব্যাগ বের করে।
"কী করে?"___আড়চোখে চাইলাম কৌতূহল দমাতে না পেরে। ২০ টাকার নোটটির উঁকি ছাড়া আর কিছু এলো না নজরে। নাসিরের দোকানে শুধু এক প্লেট খিচুড়িই হবে হলে ফিরে।
কী যেন একটু ভেবে নোটেতে চকলেট মুড়ে ওর হাতে গুঁজে দিলে। কৌতূহলে কানের এয়ারফোন খুলে মুখে চাইতেই হেসে বললে,
___"কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে! দেখ্।" দু'চোখ জ্বালা করে উঠলে।
লুকোতে তাড়াতাড়ি চাইলাম বাইরে।
মনে মনে ভাবি...কী অভিরাম সত্যের দাবি!
রাতের এই অহেতুক হাফ ভাড়া... নিজের খাবারের সম্বলটুকু অসহায়ায় দিয়ে সুন্দর কী হাসির তোড়া!
একটু আগের মরচে মরা চাঁদকে হলুদ গায়ে বিয়ের নতুন কনে মনে হল।
আমারি মনের ভাষায় যেন সে দুলে দুলে হেসে উঠল! উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ের পাহাড়ে পাহাড়ে লুকিয়ে খেলছে লুকোচুরির খেলা। কী সুন্দরই না উঠলে ভরে আশায় আশায়, অপ্রাপ্তি অহেতুক হতাশায় ডালা!!
#ভোলানাথ
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০২২ রাত ১০:৫৬