somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বেলা যে যায়... : ০২

০২ রা জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই বয়সেই আরিফের ছেলেটা বেশ কথা শিখেছে। মাশাআল্লাহ, তার কথা খুব স্পষ্ট। আমার সাথে বসে খুব সমঝদারের মতো কথা বলে। যেন আড়াই বছর নয় আমি আশি বছরের কোনো বুড়োর সাথে কথা বলছি।
“দাদ্দাভাই তুমি বই পড়ো?” আদো আদো মুখে বলে। প্রতিটি শব্দে যেন মিশে থাকে এক ধরণের মিষ্টতা। ইচ্ছে হয় সবগুলো শব্দসমেত বাচ্চাটাকেও খপখপ করে খেয়ে ফেলি। আমি ওর গালে আমার গাল ঠেকিয়ে বলি, “হ্যাঁ দাদা আমি বই পড়ি। তুমি পড়বে?”
“আমি তো বাচ্চা। বাচ্চারা কী বই পড়ে?” ওর কথা শুনে আমি হাসি। “বড় হলে পড়িও কেমন!” জানি ও বুঝবে না। তবুও বলতে থাকি, “বই পড়া খুব ভালো। বুঝলে দাদা, যখন বড় হবে খুব বই পড়বে। শুধু বই না, যখন যেখানে যা পাবে তা পড়বে। এই জীবনটা পড়ার জন্য খুব খুব কম। কত কী জানার বাকী আছে!” সে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন আমি যা বলছি তার প্রতিটি বর্ণ সে বুঝতে পারছে। উৎসাহিত হয়ে বলতে থাকি, “ধুম করে দেখবে একদিন মরে যাবে। তার আগে যত পারো পড়বে। জানবে। ভাববে। শিখবে। পৃথিবীতে পড়ার মতো মজার আর কিছুই নেই, যদি তুমি তেমন পাঠক হতে পারো। বুঝলে দাদাভাই!” সে হাই তোলে। “দাদ্দাভাই আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমাবো।” ওর তুলতুলে গালটা একটু টেনে দিই। “যাও দাদা, আম্মুর কাছে যাও।” সে দু’পাশ মাথা নেড়ে বলে উঠে, “আমি এখানেই ঘুমাবো। বইয়ের মাঝে।” বলেই টুস করে শুয়ে পড়ে।

কী বিচিত্র এই পৃথিবী! এই আদো আদো কথা থেকে সে একসময় খুব সেয়ানা সেয়ানা কথা বলবে। তারপর একসময় হঠাৎ দেখা যাবে তার ঘাড়টা খুব চওড়া হয়ে গেছে। পুরো একটা পরিবার কিংবা দু-চার, পাঁচটা পরিবারও হয়তো তার ঘাড়ে সওয়ার হবে। তার বিয়ে হবে, বাচ্চা হবে। সেও নাতির সাথে এমন গল্প করবে হয়তো। অথবা হয়তো না...। সে এতকিছু করার আগেই ধুম করে মরে যাবে। তার বাবা-মা ক’দিন খুব কাঁদবে। তারপর তারাও হয়তো মরে যাবে। অদ্ভুত! এই দুনিয়ায় মৃত্যুটাই কেবল সত্যি, আর সব কেমন যেন আবছা আবছা, হয়তো বা হয়তো না...।

আমাকে ভাবন-রোগ এখন পেয়ে বসেছে। বাচ্চাটাকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে ভাবতে বসবো। আশাপূর্ণা দেবী কোন একটা বইয়ে লিখেছিলেন, “নিভৃত চিন্তায় নিমগ্ন হবার গভীর আনন্দ থেকে উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সবাই।” আমার কাছে অঢেল অর্থ না থাকলেও আছে অঢেল সময়। আমি তাই নিভৃত চিন্তায় নিমগ্ন হতে পারি। গভীর আনন্দ লাভ করতে পারি। উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে হয় না আমার।

“মা, ও মা, কোথায় গেলি! তোর বাচ্চাটাকে একটু নিয়ে যা তো মা! ঘুমিয়ে গেছে যে!” হন্তদন্ত হয়ে কোত্থেকে ছুটে আসে আরিফের লক্ষীমন্ত বউটা। “আপনার এখানেই ঘুমিয়ে গেছে। দেখলেন কান্ড!” বলেই তড়িঘড়ি করে বাচ্চাটাকে নিয়ে যায় সে। এবার আরাম করে কিছুক্ষণ ভাবতে বসবো এমন সময় আবার হাজির আরিফের বউ।

“চাচা, আপনার গরম পানি দেয়া হয়ে গেছে। আজ আর ঠান্ডা পানিতে গোসল করবেন না।” আমি হেসে বলে উঠি, “কি দরকার ছিল মা! মাথায় ঠান্ডা পানি না পড়লে তো গোসল করেছি বলে মনেই হয় না। তাই...” মুখের কথা মুখেই থেকে যায়। ধমক দিয়ে বলে উঠে, “ঠান্ডা বাঁধানোর পাঁয়তারা করবেন না। এমনিতে চাচী আম্মা নেই বলে যা খুশী তাই করে বেড়াচ্ছেন।”
“আমি আবার কখন কী করলাম, মা?” বলেই আরো একটা রাম ধমক খেলাম। “আহ, তর্ক করবেন না। মায়ের সাথে তর্ক করতে নেই। সুবোধ ছেলের মতো বাথরুমে যান। সেখানে তোয়ালে-লুঙ্গী রাখা আছে। গরম পানি দেয়া হয়েছে। গোসল সেরে নিন। আর হ্যাঁ, বাথরুমে ঢুকে কোনো ভাবাভাবিতে যাবেন না, সোজা গোসল। ঠিক আছে?” আর কথা না বাড়িয়ে “হ্যাঁ ঠিক আছে।” বলেই বাথরুমে ঢুকে গেলাম।

আরিফের বউয়ের নামটা কী যেন! ভুলে গেছি। প্রায়ই ভুলে যাই। আজকাল বড্ড ভুলোমনা হয়েছি। অনেক কিছুই ভুলে যাই। সেদিন তো গরম পানি বালতিতেই ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। বাথরুমে ঘন্টাখানেক বসে থেকে ঝর্ণার পানিতেই গোসল সেরে বেরিয়েছিলাম। আরিফের বউ সে কী বকাটাই না দিল! মেয়েটা যতই বকা দেয় ততই হাসি পায়। শেষ পর্যন্ত আর না পেরে কেঁদেই দিয়েছিল। “অসুখ বাঁধিয়ে আমাদের আবার এতিম করার উপায় খুঁজছেন, না?” আমি হায় হায় করে উঠি, “এই যে মা কান ধরছি। এমনটা আর হবে না।” ছোটো ছেলের মতো আমাকে কানে হাত দিতে দেখে ফিক করে হেসে দিয়েছিল ও।

মেয়েটা আসলে বড্ড মায়াবতী। মায়া-টায়া এড়াবো বলেই এই গাঁ-গঞ্জে পালিয়ে এসেছিলাম। এখন দেখছি এখানেও রেহাই নেই। কথাবার্তায় আবার বেশ টনটনে। ঠাশ ঠাশ উত্তর দেয়। একেকটা উত্তর তো পিলে চমকে দেয়ার মতো। তার সপ্রতিভ ভাব দেখে একবার রসিকতা করে বলেছিলাম, “মা, তুই এই যুগে কেন জন্ম নিলি বলতো?”
“কেন? এই যুগে জন্মে কী এমন অপরাধ হয়েছে, চাচা?” পালটা রসিকতার সুর তার কথায়। “তোর উচিৎ ছিল শরৎ-যুগে জন্ম নেয়া। তাহলে কী হতো জানিস?” বাঁকা স্বরে জিজ্ঞেস করি।
আমাকে চমকে দিয়ে সে বলে উঠেছিল, “জানিই তো। তাহলে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের নায়িকা হতাম।” মুখ চাপা হাসির উত্তরটা সত্যিই আমাকে অবাক করেছিল। আমাকে চুপ থাকতে দেখে সে নিজেই বলেছিল, “না চাচা, এই ঠিক আছে। আমি আরিফ যুগে জন্মেছি। আরিফ সাহেবের নায়িকা হয়েছি, এই ঢের।” কেমন একটা তৃপ্তি আর গর্বের সুর ছিল তার কথায়।

মেয়েটার যে বেশ পড়াশোনা আছে তা আন্দাজ করলেও, এতটা আছে সেটা বুঝতে পারিনি। প্রথম প্রথম খুব সাধারণ কথা বলত। কথায় আন্তরিকতা থাকলেও একটা সংকোচও বুঝি কাজ করত। মাস দুয়েক পর একদিন হঠাৎ লাইব্রেরী ঘরে এসেছিলো। বলেছিল, “চাচা, আমি একটা অপরাধ করে ফেলেছি। আমাকে ক্ষমা করবেন।” আমি তাজ্জব হয়ে জিজ্ঞেস করি, “কীসের অপরাধ বৌমা? কখন করলে?” আমার কথার জবাব না দিয়ে আবার নিজের কথায় ফিরে গেল। “তার আগে দুটো কাজ করতে হবে আপনাকে।” “কী কাজ? বলো?”
“প্রথমত আমাকে বৌমা ডাকা যাবে না, মা ডাকতে হবে। আর তুমি নয়, তুই করে বলবেন।” তার কথার দাপট আর আত্মবিশ্বাসে আমি অভিভূত হলেও প্রকাশ করলাম না সেটা। “এ আবার কেমন দন্ড! সম্পর্কটা প্রমোশন পেয়ে মা-তে উঠে গেল, আর ওদিকে সম্বোধনটা ডিমোশন নিয়ে তুমি থেকে নেমে গেল তুই তে!” হাসি হাসি মুখ করে বলেছিলাম। “অত শক্ত কথা বুঝি না। আর হ্যাঁ, আমার সাথে আপনার ওই কঠিন কঠিন কথাগুলোও বলা যাবে না।”
“ঠিক আছে, তাই হবে রে মা!”

কিশোরী যেমন তার কথা সব মেনে নেয়া হয়েছে দেখে বেণী দুলিয়ে খুশীতে ডগমগ করতে করতে পুরো বাড়িতে ছুটে বেড়ায়। আরিফের বউটাও তেমন উচ্ছলতায় পুরো বাড়িতে কেমন উচ্ছ্বসিত ভাব নিয়ে এসেছিল।

তার অপরাধটাও ছিল হাস্যকর। সে নাকি আমার বুক শেলফ থেকে চুরি করে বই নিয়ে যেত! শুনে অট্টহাসি দিয়ে বলে দিয়েছিলাম, যত ইচ্ছে বই নিতে পারবে সে। পড়ার জন্য যদি সবগুলো বইও চুরি করে তাহলে আমার বরং আনন্দই হবে। এখানে এসে আমি বই পেয়েছি, মেয়ে পেয়েছি, মা পেয়েছি, মমতা পেয়েছি। এবং পেয়েছি একজন সমঝদার পাঠকও। আরিফের বউ আসলে সত্যিকার পাঠক।

প্রথম পর্ব

সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:৫১
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×