দুই।
গত রোজার ঈদের একদিন পরের ঘটনা। সম্ভবত ২২ আগস্ট।
সত্তরোর্ধ রহমতুল্লাহ সাহেব বাড়িতে একা আছেন। তার স্ত্রী গেছেন পাশের বাড়িতে জা এর কাছে- ঈদ সাক্ষাৎ দিতে। মেয়ে আর মেয়ের জামাই একমাত্র ছেলেকে নিয়ে থাকে নিচের ফ্ল্যাটে। রহমতুল্লাহ সাহেব তার বাড়ির উল্টো দিকে ছোট্ট এক চিলতে মসজিদে আছরের নামায আদায় করে কেবল ঘরে ফিরেছেন আর অমনি এসে হাজির তার বাসার ১৩-১৪ বছরের কাজের মেয়ে লতিফার বাবা-মা। তারা মেয়েকে নিয়ে যেতে চায়, পরে আবার নিয়ে আসবে। রহমতুল্লাহ সাহেব বিরক্ত হলেন। মাত্র মাস খানেক আগে অনেক খুঁজেপেতে টাকাপয়সা খরচ গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন। ঈদ উপলক্ষে মা-মেয়েকে কাপড়চোপড় দিয়েছেন, তাদের আসা-যাওয়ার খরচ দিয়েছেন, আর এখন একমাস মানে ঈদ যেতে না যেতেই তারা মেয়েকে নিয়ে যেতে চাইছে। তিনি জানেন এ মেয়েকে আর দিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। এমন উদাহরণ আগে আরো দেখেছেন। রহমতুল্লাহ সাহেব অনেকক্ষণ ধরে তাদের বোঝানোর পর আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না। ক্ষেপে গিয়ে বললেন, লতিফাকে এখন দেবেন না। কিছুতেই না। তার স্ত্রী আসুক তারপর দেখা যাবে কি হয়। উত্তেজনার এক পর্যায়ে তিনি লতিফার মা-বাবাকে বাড়ি থেকে একরকম তাড়িয়েই দিলেন। লোকটা দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে- মুহুর্তের উত্তেজনায় কি ভুল যে তিনি করলেন তা তিনি নিজেই জানেন না।
মাগরেবের নামায পড়ে বাসায় আসার পরপরই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে লতিফা এগিয়ে যায় দরজা খুলতে। বাড়িতে তখনো গৃহকর্ত্রী নেই। রহমতুল্লাহ সাহেব ভাবলেন সারা বিকেল দুই জায়ে গপ্পোসপ্পো শেষে বোধ হয় এখন ফিরলো। কিন্ডু তাকে বিস্মিত করে ঘরে ঢুকলো পুলিশ। সাথে লতিফার মা-বাবা।
তারপরের ঘটনা রীতিমত ভয়ংকর, ঘৃণ্য এবং আতঙ্কিত হওয়ার মত।
এলাকার একজন সম্মানিত মুরুব্বি, মসজিদ কমিটির প্রাক্তন সেক্রেটারি, একজন নির্লোভ-নিরীহ-মৃদুভাষী মানুষকে ( এই বিশেষণগুলো রহমতুল্লাহ সাহেবের প্রাপ্য), পুলিশ ঠিক চোরের মত টেনেটুনে গাড়িতে তুললো। তার বাসা থেকে বন্দী কাজের মেয়ে লতিফাকে উদ্ধার করা হয়েছে- ঠিক এমন একটা ঘটনার নাট্যরূপ দেখলো বাড়ির দ্বিতীয় তলায় থাকা মেয়ের জামাই হারুন। পুলিশের পিছুপিছু গেল থানায় । সেখানে তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলো কি ঘটেছে বাস্তবে আর মেয়ের মা-বাবা কি বুঝিয়েছে তাদের। কিন্তু পুলিশের এক কথা-অতসব বুঝিনা, মেয়ের বাবা-মায়ের অভিযোগ, মেয়েকে আটকে রাখা হয়েছে তার ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে, সেসূত্রে মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছে তার বাসা থেকে এবং একা রহমতুল্লাহ সাহেবই ছিলেন। কিছুতেই পুলিশকে বোঝানো গেল না যে অভিযোগটি সাজানো। পুলিশ যেন পণ করেছে, লতিফার মা-বাবার অভিযোগই ঠিক আর বৃদ্ধ রহমতুল্লাহই অপরাধী এ ছাড়া অন্য কোন কথাই তারা মানবে না। হারুন তার বন্ধুদের সহযোগিতায় থানায় একের পর এক তদবির চালাতে থাকে । থানার ওসির কাছে বিভিন্ন দিক থেকে ফোন যায়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। পুলিশের সাথে আর্থিক লেনদেনে পটু কয়েকজন বন্ধুও থানায় এসে বিষয়টার রফা করতে চায় কিন্তু তাতেও কাজ হয় না। এদিকে রাত বাড়তে থাকে। অস্থিরতাও বাড়তে থাকে হারুণের। রহমতুল্লাহ সাহেবকে লকআপে রাখা হয়েছে, তাকে সে একনজর দেখতে চায় আবার চায় না। কি করে দেখবে এ অবস্থায় ? তারপরও তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে, এলাকার কয়েকজন মুরুব্বীকে নিয়ে আসা যায় কিনা। থানার ওসি-ও কয়েকবার বলেছে, উনার কি মুরুব্বী কেউ নাই আমাদের সাথে কথা বলার মত ? তাদেরকে কী করে বোঝাবে যে, রহমতুল্লাহ সাহেব নিজেই তো এলাকার গণ্যমান্য মুরুব্বী। কিন্তু হারুনের এ প্রস্তাবে রহমতুল্লাহ সাহেব সোজাসুজি 'না' বলে দিলেন। এলাকায় বিষয়টা জানাতে তার মন সায় দেয় নি। অগত্যা চলতে থাকলো সমঝোতার চেষ্টা। একদিকে পুলিশের সাথে অন্যদিকে লতিফার মা-বাবার সাথে। রাত ১২ টার দিকে লতিফার মা-বাবার সাথে একপ্রকার সমঝোতা হয়েই গেল, তারা অভিযোগ তুলে নেবে। কিন্তু বেঁকে বসলো পুলিশ। মেয়ে নাকি তাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছে তার ওপর রহমতুল্লাহ সাহেব শারীরিক নির্যাতনও চালাতো। সুতরাং এরপর তাকে কোনভাবেই ছাড়া যাবে না। পুলিশের এই নতুন অভিযোগে হতাশ ও বিস্মিত হয় হারুন আর তার বন্ধুরা। কখন লতিফা এ কাজ করলো তাই তারা বুঝে উঠতে পারলো না। পুলিশের ধমকে লতিফার মা-বাবা সমঝোতার রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ালো। তার পর থেকে পুলিশ বলতে থাকলো বিষয়টা মিডিয়ায় জানাজানি হয়ে গেছে , নারী ও শিশু নির্যাতন কেস, সামলানো যাবে না। সুতরাং তাদের কিছুই করার নেই। সকালে কোর্টে চালান হয়ে যাবেন রহমতুল্লাহ সাহেব। মুক্তিযুদ্ধের একজন সম্মুখযোদ্ধা, ধার্মিক ও সহজসরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত রহমতুল্লাহ সাহেব।
চোখেমুখে অন্ধকার দেখলো হারুণ। এবার তবে কি ? মিডিয়ার কথা বলার মানে হল পুলিশ এখন কোন সমঝোতাই করবে ন। হারুণের বন্ধুরা বিষয়টাকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মিটমাট করতে চেয়েছিল তা বোধ হয় আর সম্ভব হল না। শেষ পর্যন্ত গভীর রাতে, প্রায় ভোরের দিকে পুলিশের সাথে অন্য এক সমঝোতায় আসা হয়, কোর্টে পাঠালেও এমন ধারায় মামলা দেয়া হবে যাতে বৃদ্ধ লোকটিকে রিমান্ডে যেতে না হয় আর সত্বর জামিন পাওয়া যায়। এই সমঝোতা করতেই পকেট থেকে মোটা টাকা বেরিয়ে গেল। সেই টাকার কোন কূল কিনারা করা যেত না যদি এটিএম বুথ না থাকতো। যা হোক, একটি পুরোরাত্রি রহমতুল্লাহ সাহেব থানার লকআপে কাটালেন সকালে বা দুপুরে বা বিকেলে তাকে কোর্টে হাজির করা হবে এমন দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে। হারুণ দুএকবার তার কাছে পরামর্শ চাইতে লকআপের গরাদ পর্যন্ত গ্যাছে। ওই শুভ্র চাপদাড়িবেষ্টিত মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারেনি। মধ্যরাতে আমেরিকা প্রবাসী শ্যালক ফোন করে তার উদ্বেগের কথা জানিয়ে কান্নাকাটি করেছে, আর মেয়ের কান্নাকাটি শুনতে শুনতে তো সকাল হয়ে গেল। নিজকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে হারুনের । সারারাত তার শ্বশুর থানার লকআপে, সে কিছুই করতে পারলো না। তার বন্ধুরা একে একে চলে গেল যারযার নিজস্ব ডেরায়, এক অনিশ্চিত সকালের অপেক্ষায় বসে রইল সে।
ওদিকে লতিফার মা-বাবাও থানায়। তবে তাদের চোখেমুখে কোন উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা নেই। একবার শুধু লতিফার বাবা বললো, আমি তো শুধু থানায় বলছি আমার মেয়েরে আটকাইয়া রাখছে, মেয়ে ফিরাইয়া দেন। তাতেই পুলিশ এত কিছু করলো !
এ ঘটনার দশ দিন পর জামিনে ছাড়া পেয়েছেন রহমতুল্লাহ সাহেব। কিন্তু তিনি এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন নি। তার বাড়ির দরজার লাগোয়া মসজিদ, যেখানে তিনি দিন-রাত যাওয়া-আসা করতেন, আর যান না। ঘরে কেবল স্ত্রীর সাথে দরকারি কথাটুকু বলেন। সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে বসে কী যেন ভাবেন। তাদের বুকের ভেতর কী ঘটে যাচ্ছে তার হদিস কে রাখে ? মসজিদে যাতায়াতকারী মুরুব্বীরা নিয়ে নানারকম কথা বলেন। কেউ কেউ তাকে সান্ত্বনা দিতে বাসায় গেলেও রহমতুল্লাহ সাহেব ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকেন। তিনি এখন জ্যান্তে-মরা।
পুনশ্চ : একটি অসমর্থিত সূত্র রহমতুল্লাহ সাহেবের মেয়ের জামাইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি বেশ হইচই করেছিলেন এবং পুলিশকে একহাত দেখে নেয়ার হুমকিধামকিও দিয়েছিলেন তাই পুলিশ তাকে একটা শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু এমন শিক্ষা পুলিশকে কে দিতে শিখিয়েছে যা একটি বৃদ্ধ ও সম্মানিত মানুষকে বিনা অপরাধে বাকি জীবনের জন্য মৃত্যু যন্ত্রণার চেয়ে ভয়ংকর কোন শাস্তি পেতে হবে ?
(চলবে...)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




