তিন।
ঘটনাটা ১৯৯৪ সালের সম্ভবত। দিন তারিখ মনে নেই। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস হবে হয়তো। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রাত প্রায় ২টার দিকে বাড়ির সামনে পুলিশের ওয়াকি টকির ঘসঘস আওয়াজ কানে এলে ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় দাঁড়িয়ে জানালার ওপর দিয়ে রাস্তার দিকে তাকানোর চেষ্টা করি। কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কেবল কয়েকজন মানুষ নিচু স্বরে কথা বলছে তা বোঝা যাচ্ছিল। তারা ঠিক আমাদের বাড়ির গেইটের সাথেই দাঁড়িয়ে আছে। আমার রুমটা আবার গেইটের খুব কাছেই। তাদের কথোপকথন থেকে একটা ব্যাপার পরিস্কার হল যে তারা আমাদের বাড়িতেই কাউকে খুঁজতে এসেছে। কারণ একজন জানতে চাইছিল, 'এই বাড়িতো ?' আরেকজন নিশ্চিত করছে, 'হ্যাঁ এটাই'। আমি কিছুটা আতঙ্ক কিছুটা বিস্ময় নিয়ে যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় তখনই চাপা কণ্ঠে বাইরে থেকে আমার নাম ধরে অপরিচিত কণ্ঠের ডাক ভেসে এলো। আমি প্রায় প্রস্তুত হয়েই ছিলাম, দ্রুত চাবি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আব্বা-আম্মা টের পেলেন না। অন্য ঘরে মামুন ঘুমাচ্ছে ; সেও কিচ্ছু টের পেল না। বাইরে গিয়ে আমার তো চক্ষু ছানাবড়া ! তিনচারজন পুলিশের সাথে মনিরকে দেখে আমি হতভম্বের মত তাকিয়ে রইলাম। আমাদের বাসার ঠিক উল্টো দিকেই দেয়াল ঘেরা দুই বিঘা জমির ভেতর এককোণে একখানা মেস। তারই বাসিন্দা মনির। খালি জায়গাটাতে সকাল বিকাল ছেলেদের খেলাধুলা চলে। মেস বাসিন্দারা কেউ চাকুরে, কেউ ছাত্র। তবে মেসের ভেতর আমার কিঞ্চিৎ যাতায়াতের একমাত্র কারণ সেলিম। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্টের বন্ধু। মাত্রই মাস্টার্স দিয়ে তাকে হল ছাড়তে হয়েছে। এসে উঠেছে এই মেসে। আমিও সাহিত্য নিয়ে আড্ডা দেয়ার মত একজনকে পেয়ে বেশ আপ্লুত। কিন্তু ঘটনাটা কী, কেন এত রাতে পুলিশ মনিরকে ধরলো, সেলিমের কী কিছু হল, এর মধ্যে আমি কী অপরাধ করলাম- এতসব চিন্তা মুহূর্তের মধ্যে আমার মাথায় ঝড়ের বেগে ঘুরতে লাগলো। মনিরকে জিজ্ঞেস করায় সে শুধু বললো, আমাকে কষ্ট করে একটু থানায় যেতে হবে। ওখানে সেলিমসহ তাদের মেসের আরো দুইজন আটক আছে। অনেক অনুরোধে তাকে সাথে নিয়ে পুলিশ এ পর্যন্ত এসেছে। আমি ছাড়া এখন তাদের হয়ে থানায় কথা বলার কেউ নেই। আমি তো মহা দুশ্চিন্তায় পড়লাম। একবার ভাবলাম বাসায় সব জানাই। পরক্ষণেই চিন্তা করলাম- জানালে আব্বা-আম্মা আমাকে থানায় যেতে দেবে না কস্মিনকালেও । তাহলে এদের কী হবে ? আমি বাসার ভেতরে না গিয়ে পুলিশের সাথে সোজা থানায় চলে এলাম। আমার বাসা থেকে থানার দূরত্ব ২-৩ কিলোমিটার হবে। গভীর রাতে থানায় যাবার অভিজ্ঞতা একেবারেই অন্যরকম একটা ব্যাপার। যা হোক, সেখানে সেলিমসহ আরো দুজনকে দেখলাম লকআপে। পুলিশ কেমন যেন উদাসীন। আমাকে তাদের সাথে পরামর্শ করার জন্য সেলিমকে বাইরে বের করেও দিল পুলিশ। আমি সেলিম আর মনির তিনজনে থানার ভেতর বেঞ্চে বসে শলা-পরামর্শ করছি। ঘটনার বিস্তারিত জানলাম তখনি।
মনির এক লোকের কাছে কিছু টাকা পাওনা ছিল, ৮-১০ হাজার টাকার মত। অনেকদিনেও টাকা পরিশোধ না করায় লোকটার ওপর সে বেশ ক্ষ্যাপা। ঘটনার দিন হঠাৎ বাজারে তার সাথে দেখা হয়ে যাওয়ায় সে লোকটাকে সেখান থেকে প্রায় টেনে টুনে মেসে নিয়ে আসে। তারপর বসে বিচারসভা। সেই সভায় আমিও ছিলাম, তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি সভা থেকে চলে আসি অন্য কাজ থাকায়। যা হোক, বিচারে সাব্যস্ত হয় ওই লোককে সন্ধ্যার আগে টাকা পরিশোধ করতে হবে। তার কাছ থেকে স্যান্ডেল, জামা এবং প্যান্ট খুলে রাখা হয় । তাকে পরিয়ে দেয়া হয় নিজেদের একটা লুঙ্গি। সে টাকা দিয়ে এগুলো নিয়ে যাবে। এই বিচার তার পছন্দ হয় নি। সে সোজা থানায় গিয়ে অভিযোগ করে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা একজন ভদ্রলোককে টাকা-পয়সা-কাপড়-চোপড়-ঘড়ি কেড়ে নিয়ে রাস্তায় উলঙ্গ করে ছেড়েছে। অভিযোগ ভয়াবহ। সুতরাং পুলিশ তার কর্তব্য পালন করতে দেরি করে নি। আমাদের করিৎকর্মা পুলিশ হৈহৈ রৈরৈ করে রাত বারোটার দিকে মেসে এসে তিনজনকে ধরে নিয়ে যায়।
জীবনে এই প্রথম পুলিশের সাথে মধ্যস্থতা করার জন্য স্যার নিনিয়ানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলাম আমি। থানায় পুলিশের সাথে কথা বলতে গিয়ে মনে হল পুলিশ যখন-তখন আমাকেও জেলে পুরে দিতে পারে। তাদের কথাবার্তা এবং চাহনি দেখে নিজকে দাগী আসামী মনে হল মাঝে মাঝে। যে পুলিশের সাথে বিষয়টি রফা করতে হবে সে তো বেঞ্চে সটান হয়ে বিকট নাসিকাগর্জনসহযোগে ঘুমাচ্ছে। এখন উপায় ! তাকে ডাক দিলে সে যদি কুম্ভকর্ণের মত ক্ষেপে গিয়ে আমাকে ডাণ্ডা মেরে বসে! অথবা যদি কোন প্রস্তাবেই রাজি না হওয়ার গোঁ ধরে বসে থাকে ! আমি অপেক্ষা করাটাই যুক্তিযুক্ত মনে করলাম। এদিকে রাত গড়াচ্ছে ভোরের দিকে। একজন পুলিশ জানালো, 'যা করবার তাড়াতাড়ি করেন। ডিউটি চেঞ্জ হইয়া গেলে কইলাম মাইন্কা চিপায় পরবেন।' আমি অস্থির হয়ে শেষ পর্যন্ত ঘুমন্ত পুলিশকর্তাকে ডাকলাম। আমাকে সহযোগিতা করলো সেই কনস্টেবল। মহাশয় অবশ্য ক্ষেপলেন না। জড়িয়ে জড়িয়ে শুধু বললেন, 'কত নিয়া আসছেন' ? আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, একশ টাকা। ' পুলিশকর্তার টাকার অঙ্কটা এক্কেবারেই পছন্দ হল না। তিনি তিনজনের জন্য তিনশ টাকা হেঁকে আবার নাক ডাকতে লাগলেন। অসহায়ের মত তাকিয়ে রইলাম আমি। এবারও উদ্ধার করলো সেই কনস্টেবল। কর্তাকে ডেকে বললো, স্যার আরো একশ টাকা দিতে পারবো কইতাছে। আমি কিন্তু কিছুই বলি নি, তারপরও কনস্টেবলের কথায় সায় না দিয়ে পারলাম না। পুলিশ কর্তা বেঞ্চে শুয়েই হাত বাড়ালেন। আমি তো ভীষণ বেকায়দায় পড়লাম। আমার কাছে সাকুল্যে একশ টাকাই আছে। উপায় কী ! আধ ঘন্টা সময়ের আর্জি জানালাম কনস্টেবলের কাছে। ওদিকে পুলিশকর্তার হাত ঘুমের ঘোরে আবার আগের যায়গায় ফিরে গেল। কনস্টেবল কর্তার কাছ থেকে আধ ঘন্টা সময় মঞ্জুর করলেন। ছুটলাম বাসার দিকে। ফাঁকা রাস্তায় প্রায় দৌড়ে তিন কিলোমিটার পাড়ি দিলাম। বাসায় এসে ঘুম থেকে তুললাম আম্মাকে। আব্বা তখনও ঘুমাচ্ছেন। আম্মার কাছে ঘটনার সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত জানিয়ে দুইশ টাকা নিয়ে ছুটলাম থানায়। মাথায় তখন ঘুরছে, যদি ইতোমধ্যে ডিউটি বদলে যায় ? যদি সেই কনস্টেবল বা অফিসার না থাকে তাহলে তো একেবারে সর্বনাশ ! আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। আমি ছুটছি থানার দিকে। দৌড়াতে দৌড়াতে থানায় এসে বেঞ্চে শায়িত গর্জনশীল পুলিশ কর্তাকে দেখে বুকে ঠাণ্ডা জলের স্রোত বয়ে গেল। বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে তার হাতে দুইশ টাকা দিয়ে বিশ্ববিজয়ীর মত আমরা চারজন থানা থেকে বেরিয়ে এলাম। তখন ফজরের আযান দিচ্ছে। মিরপুর রোডের দুইপাশে বিশ্রামে থাকা বাসগুলোর ভেতর থেকে দুইএকজন বেরিয়ে আসছে, ঘুমঘুম চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নিশ্চয়ই তারা ভাবছে আমরা বখাটে। তাদের কেউ কেউ বাসের স্টার্ট চেক করছে, কেউ দাঁতের পরিচর্যায় ব্যাস্ত। আমরা ভোরের ঠাণ্ডা বাতাসে মহা হৈচৈ করতে করতে হেঁটে বাড়ি ফিরছি, যেন নতুন জীবন ফিরে পেলাম; নতুন করে বাঁচার আনন্দে আমাদের চোখেমুখে এক উচ্ছ্বল চাঞ্চল্য। যেতে যেতে পুরো ঘটনার খুঁটিনাটি ব্যবচ্ছেদ হল। কার কতখানি দোষ, কতখানি দায় এ নিয়ে তর্কও হল।
কিন্তু বাড়ির কাছে এসে সেলিম আমার কাছে পঞ্চাশটা টাকা চেয়ে যা বললো তাতে আমি জীবনে সবচেয়ে বড় বিস্ময় আর ঘৃণার মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম। পুলিশ নাকি তাদের টাকাপয়সা, মানিব্যাগ, ঘড়ি সবই নিয়ে গেছে। বাড়িতে তল্লাশির নামে তাদের ঘর তছনছ করে সব তো নিয়ে গেছেই, এমনকি তোষকের নিচে রাখা খুচরা টাকা, ড্রয়ার ঘেঁটে কলম এবং চশমাও বাদ দেয়নি !! আমার বিশ্বজয়ের আনন্দ তখন ঘৃণা আর লজ্জা আর বিবমিষায় বিলীন।
সেই দিনের সেই ঘটনার কথা আজ যখন ভাবি তখন আমার মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতার সীমা থাকে না, যিনি আমার কথায় আস্থা রেখে বিনা প্রশ্নে এমনকি আব্বাকেও ঘুম থেকে না জাগিয়ে দুইশ টাকা আমার হাতে দিয়েছিলেন সেলিমকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনতে। রাত প্রায় তিনটায় কোন্ বাবা-মা তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেকে একা থানায় যেতে দেবে ?
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৫২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




