সন্ধ্যায় বেরিয়েছিলাম চা খেতে, বাসা থেকে বড় জোর ১০০ গজ দূরে। কাছাকাছি যেতেই মনে হল বেশ একটা শোরগোল চলছে ওদিকে। অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে রাস্তায়। পুলিশ দেখা গেল। নাহ্ , ঘটনা নিশ্চয়ই বড় কিছু। কাছে গিয়ে দেখি রিভলভার হাতে এক সাদাপোশাকের পুলিশকে ঘিরে আছে অনেক মানুষ। তার আশেপাশে আরো দুএকজন পুলিশ দেখা গেল। ইউনিফর্ম পরা। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম রিভলভার হাতে পুলিশটি তার অন্য হাতে কলার চেপে ধরে আছে যে ছেলেটিকে সে আমার প্রতিবেশী, শরিফ। পলিটেকনিকে পড়ে। অত্যন্ত বিনয়ী এবং নিরীহ স্বভাবের ছেলে। তাকে ছাড়িয়ে নেবার জন্যই এত মানুষ হৈচৈ করছে। আর ইন্সপেক্টর রিভলভার উঁচিয়ে জনতাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে সরে যাবার জন্য। আমি বেশ অবাক হলাম, কী এমন ঘটনা যে শরিফকে পুলিশ প্রায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে ! শুনলাম ওদের ফার্মেসিতে নাকি হাতাহাতি, ভাংচুর হয়েছে। বিপ্লব নামের এক ছেলে মোবাইলে ১০ টাকা রিচার্জ করতে গেলে শরিফের রড়ভাই ২টাকা বাড়তি দাবি করায় তর্ক-বিতর্কের সূত্রপাত। এককথা দুকথায় হুমকি-ধমকি, পরে জামা ধরে টানাটানি, অবশেষে হাতাহাতি-ঘুষাঘুষি । বিপ্লব নামের ছেলেটা সম্পর্কে ভাল কিছু জানা যায় না। বিএনপির মিটিং-মিছিলে নেতাদের আশেপাশে থাকে আর দল করে বলে গলা ফাটিয়ে তা জানান দেয়। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড় অবস্থা আর কি ! তো সেই ছেলের পক্ষে দোকানে ভাংচুর চালানো খুবই স্বাভাবিক এবং শরিফের বড় ভাইয়ের গায়ে কিলঘুষি চালিয়ে দেয়াও তেমন কোন ব্যাপার না। আমি চট্ করে ফার্মেসিটা একবার দেখে এলাম। যা শুনেছি ঠিকই। ওষুধের দোকানটায় ধ্বংসের চিহ্ন, শরিফের বড় ভাই রফিকের গায়ে আঘাতের। কিন্তু বিপ্লব তো কোথাও নেই ! আর ঘটনা ঘটালো বিপ্লব-রফিক, কিন্তু পুলিশ শরিফকে নিয়ে যাচ্ছে কেন ? সেখানে এসে হাজির হল এলাকার আরো দুচারজন মুরুব্বি। পুলিশকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, আসলে কী ঘটেছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। শরিফকে নিয়ে তারা রওনা হল থানায়। সমবেত এলাকাবাসীর কাকুতি-মিন তি,প্রতিরোধ কাজে এলো না। আমি নেহাত বিবেকের তাড়নায় পিছন পিছন থানায় গেলাম। সাথে এলাকার আরো দুএকজন, শরিফের ভাই, বাবাও গেল। থানায় গিয়ে আমি তো অবাক, ওয়ার্ড বিএনপির নেতা রতন বসে আছে দারোগার সামনে। প্রথমে ভেবেছিলাম কোন কাজে হয়তো এসেছে। কিন্তু একটু পরেই টের পেলাম তার উপস্থিতিও একই কারণে। রতন আমার স্কুলজীবনের কিছুসময়ের সহপাঠি। জানতে চাইলাম সে বিপ্লবকে কতদিন চেনে, আর যে ছেলেটিকে ধরে আনা হল, তাকে চেনে কিনা ? জবাবে সে জানালো, বিপ্লব তার দলের কর্মী, মিছিলে থাকে। তার বাসায় এসে কেঁদেকেটে নালিশ করেছে যে, তাকে মারধর করা হয়েছে, তার বাড়িতে হামলা চালিয়েছে কিছু ছেলে। তার গায়ে মারের চিহ্নও সে দেখিয়েছে। রতন যেন এর একটা উচিৎ জবাব দেয়। রতন তাই থানায় এসে ওসিকে বলেছে এক্ষুণি ব্যবস্থা নিতে। ব্যস্ এতেই এতসব ঘটনা ঘটে গেল। শাসক দলের নেতা বলে কথা ! কিন্তু শরিফকে বা তাদের পরিবারকে রতন চেনে না এমনকি বিপ্লবের বাসাটা কোথায় তাও সে জানে না। আমি হতভম্বের মত রতনের কথা শুনলাম। তাকে বোঝালাম যে ছেলেটাকে ধরে আনা হয়েছে তার এবং তার পরিবার সম্পর্কে ভুল ধারণা তাকে দেয়া হয়েছে । তাছাড়া ঘটনাটিতে বিপ্লবের দায়ই বেশি। কিছুক্ষণ বোঝানোর পর রতন আমার কথা বিশ্বাস করলো মনে হয়, ওসিকে এর আপোষরফার দায়িত্ব দিয়ে সে চলে গেল। এরপর শুরু হল পুলিশের খেলা।
শরিফের বৃদ্ধ বাবা, তার বড় ভাই আর আমি পুলিশের সাথে টাকা-পয়সার বোঝাপড়ায় নামলাম। শরিফের বাবা ধার্মিক মানুষ, নিরপরাধ ছেলের জন্য পুলিশকে টাকা দেয়া তার কাছে অত্যন্ত অপমানজনক মনে হল। তিনি বেঁকে বসলেন। অনেকক্ষণ পার হল তাকে পথে আনতে। পুলিশকে সবাই মিলে এটুকু বোঝাতে পারলাম যে, আপোষ রফায় অভিযোগকারীরও স্বাক্ষর থাকতে হবে। এবার খোঁজ পড়লো বিপ্লবের। ওদিকে বিপ্লব রতনের কাছে ধর্ণা দিলো আবার। কাজ হল না। রতন তাকে বললো থানায় গিয়ে মীমাংসা করতে। পুলিশের খাঁচায় এবার দুই শিকার। রাত তিনটা পর্যন্ত চললো দর কষাকষি। আমি আর টিকতে না পেরে বাসায় ফিরে এলাম। পরের দিন শুনলাম শরিফকে সকালে থানা থেকে ছাড়া হয়েছে। কত টাকায় রফা হল জানতে চাইলে শরিফের বাবা এড়িয়ে গেলেন। শুধু বললেন, বিপ্লবকেও টাকা দিতে হয়েছে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। সেই শরিফ এখন ভাল চাকুরি করছে। এখনো তার নম্র-ভদ্র ব্যবহারের সুনাম এলাকাতে আগের মতই। কিন্তু পুলিশ কেন জানি না, শরিফদেরকেই লক-আপে ভরে আর বিপ্লবদেরকে চোখেই দেখে না। দোর্দল্ডপ্রতাপশালী ওয়ার্ড নেতার এককথায় পুলিশ একটা পুরো পরিবারকে যে হয়রানির মধ্যে ফেলেছিল তার বিচার কে করবে? আর আপাদমস্তক একটা ভাল ছেলেকে যে সারাজীবনের জন্য মনের দিক থেকে পঙ্গু করে দিল তার নিরাময় কোথায় ?
(চলবে..)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




