somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আবর্জনা

১৯ শে নভেম্বর, ২০১৭ ভোর ৬:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


লোকটি চলে গেছে। রাকিব একটু সামনে এগিয়ে দেখে এলো। না নেই, একেবারে হাওয়া। সকালটা মুহূর্তে খারাপ হয়ে গেল তার। এমন করা উচিত হয়নি। আহা কত কষ্ট দেখেছিল ওই দৃষ্টিতে! পরে এমন মনে হলো। তখন নিজেকে দোষারোপ করে হাল্কা হতে পারল না। এমন হলো কেমন করে? কয়েকটি টাকা মাত্র। সে কাজে আর মন দিতে পারল না। খোলা রেলিং’এ দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে দেখতে মনে হলো, সবকিছু ধূসর কপিশ মেঘে ছায়ান্ধকার হয়ে গেছে। তখন মা’এর কথা মনে পড়ে যায়। কত বছর হলো মা চলে গেছে! বয়স্ক মানুষের মুখে শুনেছিল, মা মরার শোক চোদ্দ বছর, বাবার সাত। মা মরে গেছে প্রায় কুড়ি হতে চলল। তার শোক গেল না। জগতের নির্মম নিয়তি জেনেও মন নির্বোধ। ব্যর্থ সান্ত্বনা খোঁজে। দু-চার দিন বাইরে কাটিয়ে এলে মনে হয়, মা বেঁচে আছে...তার ঘরে বসে আছে। কেন এমন হয়?

সেই লোকটি এসেছিল। তখন আকাশে সবে সূর্য উঁকি মেরেছে। সে এসেছিল অস্থির পদক্ষেপে। কথা বলেছে স্খলিত আবদারে। রাকিব তখন বসেছিল কম্পিউটারের টেবিলে। কিছু একটা ডাউনলোড হচ্ছিল। কি সেটা মনে পড়ছে না, হয়তো কোনো এমপিথ্রি বা এমকেভি ফাইল। অথবা কোনো সাইট অপেন হচ্ছে। মজিলা ফায়াফক্সের চাকা ঘুরছে...ঘুরছে চাকা। সেখানে দৃষ্টি রেখে রেখে একদিকে ক্লান্তি আর বিরক্তি খেয়ে ফেলছিল। এই সাত-সকালে নেটের স্পিড এত ধীর! না এবার সার্ভিস প্রোভাইডার পালটে ফেলতে হবে। ঠিক সেই সময়ে দরজায় ঠক ঠক। একবার...দুবার...তিনবার কিংবা। কতবার মনে নেই। সে অস্বস্তি আর বিরক্তি নিয়ে জানালা নিয়ে দৃষ্টি ছুড়ে দেয়।

‘কী চাই?’

লোকটির বয়স আঠাশ বা ত্রিশ অথবা একুশ-বাইশ হতে পারে। বিস্রস্ত বেশবাস। সার্টের উপরের বোতাম খোলা অথবা সেটি নেই। বিশুষ্ক মরুময় দুচোখ। ঘোলাটে হলুদ। চোখের কোণায় ময়লা। কাতর চাহনি।

‘বাবু হামি সুইপার আছি, ভোরে হামার মা মারা গেল...কিছু সাহায্য করেন।’
‘এখন কিছু হবে না...যাও যাও।’

ফায়ারফক্সের চাকা ঘুরছে...ঘুরছে। ঘুরছে দুনিয়া। পৃথিবীতে এলে যেতে হবে একদিন। পালানোর উপায় নেই। এসব নির্ধারিত সত্যের বিপরীতে কোনো আবেগ মায়া থাকার কোনো দরকার নেই। তারপরও একটি জীবন চলে গেছে। হোক সে সুইপার...তারও তো মা আছে, না না ছিল; মা তো। রাকিব তেমন করে ভেবে দেখেনি। মাথায় বিরক্তি। অধৈর্য মনোযোগ। চাকা ঘুরছে।

‘এখন যাও...কোনোকিছু দিতে পারব না।’
‘আচ্ছা বাবু।’

অন্ধকার কালো ছায়া সরে গেল। শোকাচ্ছন্ন সময় চলে গেছে। আর চলে যাওয়ার পর রাকিবের নিজের মা’এর কথা মনে পড়ল। সে দ্রুত ড্রয়ার খুলে কয়েকটি টাকা হাতে নিল। দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। এদিকে ওদিকে ঋণ মহাজন হয়ে গেছে। কয়েকটি টাকা রেখেছিল, চা-পাতা আর দুধ শেষ হয়ে গেছে। বিকেলে কিনে নেবে। আচ্ছা সে না হয় কোনো ব্যবস্থা করে নেবে। সুইপার লোকটিকে সহায়তা করা দরকার। জন্মদাত্রি মা চলে গেছে তার। শ্মশানে নিতে খরচ আছে। অন্যের সাহায্য ছাড়া সে কী করে সবকিছু ম্যানেজ করবে?

রাকিব মনিটরের দিকে আর তাকাল না। চাকা ঘুরতে থাকুক। ঘড়ির গতির মতো পশ্চিম থেকে পুবে। আচ্ছা পৃথিবী তো ঘড়ির উল্টোদিকে ঘোরে নাকি? হয়তো...অথবা নয়, সঠিক গতি মনে পড়ছে না। তবে ঘড়ির বিপরীতে তার গতি এই-ই সত্য। এখন সবকিছু নিয়মের উল্টোদিকে ঘোরে। মানুষজন সমাজ রাজনীতি সব বিপরীত স্রোতে ভাসমান। সে ভাবতে চাইল না। পৃথিবী কেন উল্টোদিকে ঘোরে? সে দ্রুত সার্ট টেনে নিয়ে গায়ে দিতে দিতে বের হয়ে দেখে লোকটি নেই। একেবারে হাওয়া। কোথায় গেল? সামনে একটু এগিয়ে দেখে এলো। না চলে গেছে। আহা বড় অন্যায় হয়ে গেল আজ! অনেক আশা নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়েছিল লোকটি। তার সকল প্রত্যাশার মুখে কেন সে জল ঢেলে দিল? তার মন অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল। ব্যস্ততা দেখে ছুটে এলো মিলি। দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা।

‘কী হয়েছে?’
‘একজন লোক এসেছিল, তার নাকি মা মরেছে, সাহায্য চায়; দিতে পারলাম না।’
‘সুইপার তো? ওসব বাদ দাও...নেশা করার পয়সা নেই, তাই বাহানা করছে।’
‘মনে হয় তা নয়, লোকটির চোখ-মুখ অসম্ভব বিষণ্ন। সত্যি সত্যি মা মরেছে বোধহয়।’
‘শোনো নেশার টাইম হলে মানুষকে শুকনো দেখায়। আর দিতে পারছ না বলে আবার খুঁজছ কেন?’
‘চাকা ঘুরছে।’
‘মানে?’
‘সে তুমি বুঝবে না। মন খারাপ হয়ে গেল মিলি। অকারণ তারপরও...।’
‘মন খারাপ করো না।’

লোকটি ড্রয়ারে টাকাগুলো রেখে দিল। ভেবেছিল, মোড়ের দোকান থেকে চা-পাতা দুধ কিনে নেবে। হাতে কোনো কাজ নেই। একটি কাজ থাকলে কিছু টাকা আসে। দু-মাস হতে চলল। প্রাইভেট চাকুরি...আজ আছে কাল নেই। তার চাকুরি চলে গেছে। খুব কষ্টে দিন চলছে। তার মধ্য থেকে কাউকে আর্থিক সহায়তা করার কথা ভাবতে পারে না। কিন্তু সেই বিষণ্ন দৃষ্টির লোকটি...সুইপার, যে কিনা শহরের অলিগলি মানুষের ড্রেন ল্যাট্রিন সব পরিষ্কার করে দেয়; তার মা মরেছে। হয়তো মিথ্যে বলেনি সে। তাকে সহায়তা করা দরকার ছিল। তারও তো মা মরে গেছে। মা’এর কথা মনে পড়ে। কুড়ি-একুশ বছর কোনো স্মৃতি ম্লান হয়নি তার। মা’এর মতো আপন কে আছে? কাউকে তো পেল না। পাওয়া যায় না। পৃথিবীতে অনেককিছুর বিকল্প থাকে, মা-বাবার বিকল্প নেই।

রাকিব সারাদিন ঘরে বসে রইল। বিষণ্ন উদাস দৃষ্টি। মন খারাপ। এখন সন্ধেয় আবার কম্পিউটারে বসেছে। আবার চাকা ঘুরছে। তার মনের ক্যানভাসে আঁকিবুকি লেখচিত্র এঁকে চলেছে সেই চেহারা। উদভ্রান্ত বিষণ্ন দৃষ্টিতে আকুলতা। সুইপারের চোখ। আবর্জনা পরিষ্কার করে সে। সবকিছুর ময়লা নিজের হাতে মেখে চকচকে ঝকঝকে করে দেয় পরিবেশ। এমন মানুষ কয়জন আছে?

মিলি চা দিয়ে গেল। যতটুকু জমা ছিল তাই দিয়ে তৈরি। বিকেলে নতুন করে চা-পাতা দুধ কেনা হয়নি। ড্রয়ারের কোণে নোট কয়েকটি পড়ে আছে। মনিটরে চাকা ঘুরছে। কেন জানি কাপে চুমুক দিতে মন করছে না। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সকল আবর্জনা তার বুকে জমে গেছে। মা’এর মুখ ভেসে উঠছে। কেমন আছে মা? তার মনে যে আবর্জনা জমে গেছে, মা ছাড়া কে মুছে দেবে? সে আর মানুষ নেই আবর্জনা হয়ে গেছে। তখনো চাকা ঘুরছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৭ ভোর ৬:৪৫
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×