somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কী লিখবেন কীভাবে লিখবেন

২৯ শে মার্চ, ২০১৮ দুপুর ১২:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লেখালেখির জগতে যা কিছু লিখি না কেন, সেটি লেখা ও প্রকাশনা শিল্পের প্রেক্ষিত বিচারে নতুন সৃজন। কথাটি সৃজনশীলতার নিরিখে সত্য। ব্যতয়গুলোর উল্লেখ করছি না। ক্রমে সেই সৃজনগুলো লেখক ও পাঠকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একজন কবি যখন কবিতা সৃজন করে চলেন আর সৃষ্টির আনন্দ গ্রহণ করেন, পরে পাঠক সেই কবিতা পড়ে নির্মাণের আনন্দ গ্রহণ করেন। তিনি সেই লেখা থেকে তার ব্যক্তিজীবন, সামষ্টিকজীবন এমন কি আদর্শগত বিষয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে মানবিক উৎকর্ষতার উজ্জীবন ঘটাতে পারেন। তাই লেখালেখির বিষয়ে প্রথমেই চিন্তা করতে হবে, কী জন্যে লিখবেন? কেন লিখবেন? কাদের জন্য লিখবেন? কোন্‌ বিষয়ে লিখবেন কিংবা আপনার পছন্দ ও সাহজিকতা কোন্‌ বিষয়ের প্রতি? এরপর যুক্ত হয় লেখকের পছন্দ ও দক্ষতার বিষয়। পাঠকপ্রিয়তার ক্ষেত্রও লেখককে অনেকাংশে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করতে পারে।

অনেকে লিখতে আগ্রহী; কিন্তু কেউ কেউ নিজের মধ্যে একধরনের ‘নেতিবাচক’ ভাবনা পোষন করেন যে, যা লিখতে চাই হয়তো সেটি প্রয়োজনীয় তথ্য সম্ভারে পূর্ণ হবে কি না, কিংবা আদৌ তুলে ধরা সম্ভব হবে কি না। তারা প্রমুখ বিখ্যাত লেখকদের লেখা এবং তাদের জীবনপ্রবাহ ও অভিজ্ঞতা থেকে অনেককিছু জানতে পারেন। সুতরাং লেখালেখির প্রাথমিক সূচণা করতে হয় পড়ার মধ্য দিয়ে। এর কোনো বিকল্প নেই। পড়ার মাধ্যমে যে অভিজ্ঞতা ও দিব্যদৃষ্টি লাভ হয়, নবীন লেখকের জীবনবোধ এবং নিজেকে, মানুষকে, সমাজ ও পরিবেশকে বুঝতে অনেক সহায়তা করে। ভাবনা ও মননের যতগুলো স্তর চেনা ও বিশ্লেষণ করার দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে তিনি পাঠককে তত বেশি সৃজনশীলতা দিতে পারবেন ও তার লেখা পাঠকপ্রিয়তা ও গুরুত্বলাভ করে।

প্রথমেই যদি এই প্রশ্ন ধরে চিন্তা করি যে, কী উদ্দেশ্যে লিখছি? তা হলে অনেকেই হয়তো জবাবে সহজবোধ করবেন না। কেননা, বনের পাখি আপন মনে গান গায়, তার আবার উদ্দেশ্য কি? কিন্তু যৌক্তিক কথা এই যে, পাখি কিন্তু এমনি এমনি গান গায় না। তার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য আছে। গানের পাখি কোকিল গাছের ফাঁকে লুকিয়ে যখন ডাকে বা গান গায়, সেই সুর শুনে আমরা মুগ্ধ হলেও ওই পুরুষ কোকিলের উদ্দেশ্য বায়স-ফিঙেকে তার বাসা থেকে বের করে আনা, যাতে স্ত্রী কোকিল সেখানে ডিম পাড়তে পারে। তাই প্রতিটি লেখার পেছনে কোনো উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে। লেখককে সেই উদ্দেশ্যের সঙ্গে কাদের জন্য লিখছেন তার সমন্বয় ঘটাতে হয়। সেইসঙ্গে এই লেখা কতদিন পর্যন্ত জাগ্রত থাকতে পারে তার একটি ‘মেয়াদ’ সম্পর্কিত ভাবনা কল্পনা চোখে এঁকে দেখতে পারেন। যেমন: একটি খবর, যা আর্জেন্টিনা ফুটবল খেলোয়াড় মেসির ঢাকা আগমন উপলক্ষ্যে লেখা সেটি দুদিন পর বাসি হয়ে যাবে। জেনে যাওয়া লোকের কাছে তার তেমন কোনো মূল্য থাকবে না। কিন্তু তার ঢাকা আগমন, নাইজেরিয়া দলের সঙ্গে প্রীতি খেলা ও সে খেলায় বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে মেসির ভূমিকা নিয়ে যেকোনো নিবন্ধ অনেকদিন পর্যন্ত পাঠকমনে আনন্দ ও অন্যান্য উপলব্ধি জাগরুক করে চলতে পারে।

আমরা নিবন্ধ, প্রবন্ধ, আলোচনা, কবিতা, গল্প, উপন্যাস যা লিখতে চাই তার পেছনে অবশ্যই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য আছে। সেটা প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য যাই হোক। এখন আমরা দেখতে চাই, কত সহজে লেখা যায়। লেখার জন্য প্রথমেই দরকার চিন্তা ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা। বলা হয়ে থাকে, চিন্তার স্তর যত বেশি তার বিশ্লেষণী ক্ষমতা তত বেশি। ভালো চিন্তা পরিচ্ছন্ন লেখার মৌলিক শর্ত। সুতরাং আমরা যে বিষয়ে লিখতে চাই, প্রথমেই সেটি নিয়ে চিন্তা করব। অনেকটা ডাক্তারের রোগি দেখার মতো। কী রোগ, কি কি কারণে হলো, সেই কারণগুলোর পেছনের কারণ কি কি ইত্যাদি চিহ্নিত করা। বিষয়টা এ রকম যে, problem identification, its causes and its manifestations। যত গভীরে যাওয়া যাবে তত পরিস্ফুট হয়ে উঠবে আপনার কল্পনা শক্তি ও তার সঙ্গে বাস্তবের বিশ্লেষণ। তবে একটি সতর্ক বার্তাও আছে যে, অতিবিশ্লেষণ লেখনীকে পক্ষাঘাতগ্রস্থ করে তুলতে পারে। সুতরাং অতিবিশ্লেষণ সম্পর্কে লেখক নিজেই সিদ্ধান্ত নেবেন।

লিখুন প্রাণ খুলে। জুলভার্ন যদি তার সময়ে এই সত্য উপলব্ধি করতেন যে, চাঁদে যাওয়া অসম্ভব, কিংবা এইচজি ওয়েল্‌স যদি বুঝতেন সময়ের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করা যায় না, তা হলে হয়তো চন্দ্রাভিযান কিংবা টাইমমেশিন লেখা হতো না। তা হলে কী উদ্দেশ্য এই উপন্যাসদুটো লেখা হলো? বস্তুত মানবের অন্যতম মানবিক গুণ বাস্তব ও কল্পনার জগতে ভেসে বেড়ানোর মধ্য দিয়ে সত্য উপলব্ধি করা, তার শ্রেষ্ঠত্বের ও মানবিকতার জয়গান করা। এর মধ্য দিয়েই সময়ে সময়ে বিশিষ্টজনেরা সমাজ পরিবর্তনে ইতিবাচক ভূমিকা ও অবদান রেখে চলেছেন। তাই লেখককে লেখার শুরুতে কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হয়। যেমন:

১. যে বিষয় নিয়ে লিখতে চাই সে সম্পর্কে যথাসম্ভব সঠিক ধারনা থাকা আবশ্যক। পূর্ণাঙ্গভাবে জেনে এবং বুঝে লিখতে হবে।
২. সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে সমসাময়িক বিষয় নির্বাচন করা উত্তম। তবে যে বিষয়ে লিখি না কেন, নির্বাচিত বিষয়টি নিয়ে আসলে কী বলতে চাই স্পষ্টভাবে নির্ধারন করতে হবে।
৩. আমি লিখতে পারি এটি প্রদর্শন কিংবা কাউকে মুগ্ধ করার আগ্রহের পরিবর্তে যা বলতে চাই সেটি সহজভাবে লেখা উত্তম।
৪. প্রথমে একটি কাঠামো তৈরি, তারপর চিন্তা বা বিশ্লেষণ এবং শেষে লেখা শুরু করতে হবে।
৫. পরিচিত ও নির্ভুল শব্দের ব্যবহার, করা উচিত। ছোট ছোট সহজবোধ্য বাক্য ও প্যারাগ্রাফ পাঠককে আকর্ষিত করে। সর্বপোরি নির্দিষ্ট ও পরিচ্ছন্ন ভাষারীতিতে লেখা উত্তম। একই কথার পুনরাবৃত্তি, ভুল বানান, দুর্বোধ্যতা ও বিশেষণের বাহুল্য পরিহার লেখাকে সহজ ও সুখপাঠ্য করে তোলে।
৬. সঠিক তথ্য প্রদান করতে হবে। যা জানা নেই তার উল্লেখ না করা উত্তম। এবং বিষয়টি যে জানা নেই তার প্রচার করা যাবে না। সবাইকে সবকিছু জানতে হবে এমন কোনো কারণ নেই। একইসঙ্গে সেকেন্ডহ্যান্ড ইনফরমেশন দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৭. লেখার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ প্রামাণ্য উদ্ধৃতি লেখার বস্তুনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করে। সহায়ক গ্রন্থের নাম ও লেখকের নাম উল্লেখ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে তার পৃষ্ঠা নম্বর, প্রকাশক, প্রকাশনার কাল ও প্রকাশকের পরিচিতি দেয়া দরকার।
৮. লিখতে গিয়ে কোনোক্রমেই বিচারকের ভূমিকা নেয়া উচিত হবে না।
৯. প্রচারণামূলক, পক্ষপাতিত্বমুলক ও অহং দোষে দুষ্ট এমন লেখা থেকে বিরত থাকা একটি ভালো গুণ।
১০. সকল লেখার কেন্দ্রবিন্দু হোক মানুষ ও জীববৈচিত্র, যার মাধ্যমে মানবিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

(সূত্র: ছোটগল্পের নির্মাণশৈলী/মাহবুব আলী। প্রকাশনা বইমেলা ২০১৮, জয়তী বুকস, ঢাকা।)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১৮ দুপুর ১২:২৬
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×