ডায়াবেটিস- এই নামটি এখন সবাই কম-বেশী জানেন। কেউ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন শুনলেই ভয়ে আঁতকে ওঠেন। হয়ত ভাবতে থাকেন, সব খাওয়া দাওয়া ছেড়ে গালে হাত দিয়ে মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনতে হবে। ব্যপারটা আসলেই কি তাই? না, মোটেই তা নয়। বরং মধ্যপন্থা অবলম্বন করে কম আর বেশীর মাঝামাঝি অর্থাৎ পরিমিত মাত্রায় সময়মত আহার করতে হবে। গালে হাত দিয়ে বসে না থেকে নিয়মিত হাঁটতে হবে ও হালকা শরীর চর্চা করতে হবে। আর তাহলেই একজন ডায়াবেটিক রোগী সেইসব মানুষদের চেয়ে ভালভাবে সুখে সাচ্ছন্দে দিন কাটাতে পারবেন, যারা ডায়াবেটিস হয়নি ভেবে বেশী বেশী খেয়ে ভুঁড়ি বানান আর অলসভাবে সময় কাটান। একজন ডায়াবেটিক রোগী যদি রক্তে গ্লুকোজ অর্থাৎ শর্করা/ চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন তবে সুস্থভাবে জীবন কাটাতে পারবেন। তবে রক্তে গ্লুকেজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে তো তাকে ভুগতেই হবে। এমনও অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে যে, ডায়বেটিক রোগীদের মধ্যে অনেকেই ৪০-৪৫ বছর যাবত রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন এবং বয়স ৮০ বছর পার করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, নিয়ম মাফিক জীবন যাপনের ফলে তারা ডায়াবেটিস হয়নি এমন অনেক বৃদ্ধের তুলনায় বেশ ভাল অছেন। এজন্য একজন ডায়াবেটিক রোগীকে ঘুমের ব্যপারে যেমন নিয়ম মানতে হবে তেমনি জেগে থাকা অবস্থাতেও নাওয়া, খাওয়া, প্রার্থণা, দৈনন্দিন কাজ-কর্ম, চলাফেরা, ব্যায়াম, পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতা, ওষুধ সেবন ইত্যাদি সব বিষয়েই নির্দিষ্ট রুটিন মেনে চলতে হবে। এগুলো জানার আগে ডায়াবেটিস রোগটি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকলে বুঝতে সুবিধা হবে।
ডায়াবেটিস কি?
ডায়াবেটিস অর্থাৎ ডায়াবেটিস মেলাইটাস বলতে শারীরিক এমন এক অস্বাভাবিক অবস্থাকে বোঝায় যার লক্ষণসমষ্টি শরীরে গ্লুকোজ অর্থাৎ শর্করা/চিনির মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে প্রকাশিত হয়।
ডায়াবেটিক রোগীর রক্তে উচ্চ মাত্রায় গ্লুকোজ থাকে। তার কারণ-
• তাদের প্যাংক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয় পর্যাপ্ত পরিমাণে ইন্সুলিনউৎপাদন করতে পারে না।
• তাদের মাংসপেশী, চর্বি ও লিভারের কোষগুলো ইন্সুলিনের প্রতি স্বাভাবিকভাবে প্রতিক্রিয়া করেনা।
• অথবা একসাথে উভয়টিও হতে পারে।
ইন্সুলিন হলো এক ধরনের হর্মোন, যা প্যাংক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয় থেকে উৎপন্ন হয়ে রক্তের গ্লুকোজ/শর্করার মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ডায়াবেটিস কি তা বুঝতে হলে দেহে খাদ্য কিভাবে ভাঙ্গে ও শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় তা জেনে রাখা উচিত। খাদ্য হজমের সময় বেশ কিছু ঘটনা ঘটে-
• খাদ্য হজমের পর যে গ্লুকোজ বা শর্করা রক্তে অনুপ্রবেশ করে তা দেহে জ্বালানীর প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে।
• আমরা আগেই জেনেছি যে, প্যাংক্রিয়াসে ইন্সুলিন তৈরি হয়। এটি রক্তের মধ্যে প্রবাহিত গ্লুকোজকে মাংসপেশী, চর্বি ও লিভারের কোষে নিয়ে যায়। সেখানে এই গ্লুকোজ জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ডায়াবেটিস প্রধানত ২ ধরনের হয়-
• ধরন-১ ডায়াবেটিস, এটি সাধারনত শিশুকালেই লক্ষণ দেখে নির্ণয় করা যায়। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে ২০ বছর বয়স পার হবার পর ধরা পড়ে। এই ধরনটিতে শরীরে খুবই কম ইন্সুলিন তৈরী হয় অথবা একদমই তৈরী হয় না। ফলে প্রতিদিন ইন্সুলিন ইনজেক্সন নিতে হয়। ডায়াবেটিসে আত্রান্তদের ৫%-১০% কে এই ধরনটিতে ভুগতে দেখা যায়। এর প্রকৃত কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে জেনেটিক, ভাইরাস এবং সতোপ্রতিষেধক সমস্যা বা জটিলতা হয়ত এ ব্যপারে কিছুটা ভূমিকা পালন করে।
• ধরন-২ ডায়াবেটিস, এটি ধরন-১ অপেক্ষা অনেক বেশী সাধারণ প্রকৃতির। বেশীর ভাগ ডায়াবেটিক রোগী এর অন্তর্ভূক্ত। এটি সাধারনত পূর্ণ বয়সেই দেখা যায়। তবে যুবক-যুবতীরাও দিন দিন অনেক বেশী হারে এর অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিসে আত্রান্তদের মধ্যে ৯০% - ৯৫% কে এই ধরনটিতে ভুগতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে ‘প্যাংক্রিয়াস’ রক্তের গ্লুকোজ বা শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক রাখার জন্য পর্যাপ্ত ইন্সুলিন তৈরী করতে পারেনা এবং প্রায়শই ইন্সুলিনের প্রতি দৈহিক প্রতিক্রিয়া ঠিকমত হয় না। অনেকে আক্রান্ত হয়েও অনেকদিন যাবত বুঝতেই পারেন না যে তারা এ ধরনের ডায়াবেটিসে ভুগছেন। অথচ এটি কিন্তু একটি জটিল অবস্থা। যত দিন যাচ্ছে, অতিশয় স্থুলতা ও ব্যায়াম বিমুখতা- মূলত এ দু’টি কারণে এই ধরনের ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই।
এছাড়াও রয়েছে-
• গর্ভধারণকালীন ডায়াবেটিস- এটি গর্ভাবস্থায় দেখা যায়। এক্ষেত্রে গর্ভবতীর রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা গর্ভকালীন যে কোন সময়ে বৃদ্ধি পায়। অথচ গর্ভবতী হওয়ার পূর্বে তাদের ডায়াবেটিস ছিল না। সেই সমস্ত স্ত্রীলোক সাধারনত এই ডায়াবেটিসে ভোগেন যারা স্থুলকায় এবং যাদের পরিবারের অন্যান্য (রক্ত-সম্পর্কীয়) সদস্যরা ডায়াবেটিসে ভুগছেন। গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে মায়ের রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা অবশ্যই স্বাভাবিক রাখতে হবে। তা না হলে বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে। যারা গর্ভধারনকালীন ডায়াবেটিসে ভোগেন তাদের মধ্যে ৫%-১০% স্ত্রীলোককে পরবর্তীতে ‘ধরন-২ ডায়াবেটিসে’ ভুগতে দেখা যায় এবং এক্ষেত্রে ২০%-৫০% এর ৫-১০ বছরের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে।
• অন্য নির্দিষ্ট ধরনের ডায়াবেটিস- এটি বিভিন্ন কারণে হয়, যেমন- জিনগত অবস্থা, শল্যচিকিৎসা, ওষুধ, পুষ্টিহীনতা, ইনফেক্সন ও অন্যান্য অসুস্থতা। ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের মধ্যে ১%-৫% এই ধরনটিতে ভোগেন। (ক্রমশ চলবে......) নিচে দেখুন-
ডায়াবেটিস-কে ভয় নয়, জয় করতে হয়-(২য় পর্ব)
ডায়াবেটিস-কে ভয় নয়, জয় করতে হয়-(শেষ পর্ব)