নিচের লিংকে আগে পড়ুন-
ডায়াবেটিস-কে ভয় নয়, জয় করতে হয়- (১ম পর্ব)
ডায়াবেটিস- এই নামটি এখন সবাই কম-বেশী জানে। কেউ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে শুনলেই ভয়ে আঁতকে ওঠে। ভাবে, সব খাওয়া দাওয়া ছেড়ে গালে হাত দিয়ে মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনতে হবে। ব্যপারটা আসলেই কি তাই? না, মোটেই তা নয়। বরং মধ্যপন্থা অবলম্বন করে কম আর বেশীর মাঝামাঝি অর্থাৎ পরিমিত মাত্রায় সময়মত আহার করতে হবে। গালে হাত দিয়ে বসে না থেকে নিয়মিত হাঁটতে হবে ও হালকা শরীর চর্চা করতে হবে। আর তাহলেই একজন ডায়াবেটিক রোগী সেইসব মানুষদের চেয়ে ভালভাবে সুখে সাচ্ছন্দে দিন কাটাতে পারবেন যারা ডায়াবেটিস হয়নি ভেবে বেশী বেশী খেয়ে ভুঁড়ি বানান আর অলসভাবে সময় কাটান। একজন ডায়াবেটিক রোগী যদি রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন তবে সুস্থভাবে জীবন কাটাতে পারবেন। তবে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে তো তাকে ভুগতেই হবে। এমনও অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে যে, ডায়বেটিক রোগীদের মধ্যে অনেকেই ৪০-৪৫ বছর যাবত রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন এবং বয়স ৮০ বছর পার করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, নিয়ম মাফিক জীবন যাপনের ফলে তারা ডায়াবেটিস হয়নি এমন অনেক বৃদ্ধের তুলনায় বেশ ভাল অছেন। এজন্য একজন ডায়াবেটিক রোগীকে ঘুমের ব্যপারে যেমন নিয়ম মানতে হবে তেমনি জেগে থাকা অবস্থাতেও নাওয়া, খাওয়া, প্রার্থণা, দৈনন্দিন কাজ-কর্ম, চলাফেরা, ব্যায়াম, পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতা, ওষুধ সেবন ইত্যাদি সব বিষয়েই নির্দিষ্ট রুটিন মেনে চলতে হবে। এগুলো জানার আগে ডায়াবেটিস রোগটি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকলে বুঝতে সুবিধা হবে।
১ম পর্বের পরের অংশ-
‘ধরন-১ ডায়াবেটিসে’-এর কিছু উপসর্গ-
• অবসাদ, পিপাসা বৃদ্ধি পাওয়া, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, বিবমিষা, বমি হওয়া, ক্ষুধা বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও ওজন কমে যাওয়া।
‘ধরন-১ ডায়াবেটিস’ রোগীদের ক্ষেত্রে এই উপসর্গগুলো খুব কম সময়ের মধ্যেই প্রকাশ পেয়ে থাকে এবং জরুরী অবস্থার মধ্য দিয়ে এটি নির্ণীত হয়।
‘ধরন-২ ডায়াবেটিসে’-এর কিছু উপসর্গ-
• ঝাপসা বা অস্পষ্ট দৃষ্টি, অবসাদ, ক্ষুধা বৃদ্ধি পাওয়া, পিপাসা বৃদ্ধি পাওয়া, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া।
যেহেতু ধরন-২ ডায়াবেটিস ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়, তাই কিছু কিছু ব্যক্তির রক্তে উচ্চ মাত্রায় গ্লুকোজ থাকা সত্ত্বেও তারা এই উপসর্গগুলো আদৌ বুঝতে পারেনা।
‘ধরন-২ ডায়াবেটিস’ -হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে-
1. বয়স ৪৫ বছরের বেশী হলে,
2. পিতামাতার কোন একজন, ভাই অথবা বোন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে,
3. গর্ভধারনকালীন ডায়াবেটিস হলে অথবা ৯ পাউন্ড অপেক্ষাবেশী ওজনের বচ্চা প্রসব করলে,
4. হৃদরোগ থাকলে,
5. রক্তে উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরল বা চর্বি থাকলে,
6. অতিশয় স্থুলতা থাকলে,
7. পর্যাপ্ত ব্যায়াম না করলে,
8. মহিলাদের পলিসিস্টিক ওভারি ডিসিজ অর্থাৎ ডিম্বাশয়ে টিউমার হলে,
9. রক্ত পরীক্ষায় গ্লুকোজ বা শর্করার সহনশীলতা জনিত বৈকল্য (IGT) থাকলে,
10. কোন কোন বিশেষ সংস্কৃতির অধিকারী জনগোষ্ঠি।
ডায়াবেটিস সনাক্তকরণ পরীক্ষা ও মূল্যমান-
• প্রাথমিকভাবে প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমে তাতে গ্লুকোজ বা শর্করা এবং চর্বি ভেঙ্গে যাওয়ায় সৃষ্ট কিটোন বডির উপস্থিতি নির্ণয় করা যায়। তবে ডায়াবেটিস সনাক্তকরণের জন্য প্রস্রাব পরীক্ষার উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করা উচিত নয়।
ডায়াবেটিস সনাক্তকরণের জন্য রক্তের গ্লুকোজ বা শর্করা নির্ণয়ের কিছু পরীক্ষা ও মাত্রা-
• অভুক্ত অবস্থায় রক্তের গ্লুকোজ বা শর্করার মাত্রা (FBS) -> যদি পর পর দু’বার ১২৬ মিলিগ্রাম/ডি.এল অর্থাৎ ৭.০মিলি.মোল/ ডি.এল বা তা অপেক্ষা বেশী হয় তবে ডায়াবেটিস হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। এই মাত্রা ১০০ থেকে ১২৬ মিলিগ্রাম/ডি.এল বা ৫.৬ তেকে ৬.৯ মিলি. মোল/ডি.এল এর মধ্যে হলে তাকে উপবাসকালীন হানিকর শর্করা অর্থাৎ ডায়াবেটিস হওয়ার পূর্ব-অবস্থা হিসেবে ধরে নেয়া হয়। এই মাত্রাগুলোকে ধরন-২ ডায়বেটিসে আক্রান্ত হওয়ার বিপদ সংকেত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
• মুখে খাওয়া গ্লুকোজের সহনশীলতা পরীক্ষা (GTT)-> মুখে (৭৫ গ্রাম) গ্লুকোজ খাওয়ার ২ ঘন্টা পর রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করার মাত্রা ২০০ মিলিগ্রাম/ডি.এল অর্থাৎ ১১.১মিলি. মোল/ডি.এল বা তা অপেক্ষা বেশী হলে তাকে ডায়াবেটিস ধরা হয়। এই পরীক্ষা ‘ধরন-২ ডায়বেটিস’ সনাক্ত করার জন্য বেশী ব্যবহৃত হয়। এই মাত্রা ১৪০ মিলিগ্রাম/ডি.এল থেকে ১৯৯ মিলিগ্রাম/ডি.এল অর্থাৎ ৭.৮ থেকে ১১ মিলি. মোল/ডি.এল এর মধ্যে হলে এই অবস্থাকে Impaired glucose tolerance (IGT) হিসেবে ধরা হয় এবং যা ভবিষ্যতে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার ইংগিত বহন করে।
• ভুক্ত অবস্থায় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা (RBS)-> ২০০মিলিগ্রাম/ডি.এল বা ১১.১মিলি.মোল/ডি.এল অপেক্ষা বেশী হলে এবং সেই সঙ্গে ডায়াবেটিসের উপসর্গ যেমন অতিরিক্ত পিপাসা, ঘন ঘন প্রস্রাব, অবসাদ ইত্যাদি থাকলে ডায়াবেটিস হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে রোগ সনাক্তকরণের পরবর্তী ধাপ হিসেবে 'মুখে খাওয়া গ্লুকোজের সহনশীলতা পরীক্ষা' অর্থাৎ (GTT) অবশ্যই করে নিতে হবে।
• উপরের পরীক্ষাগুলো ছাড়াও প্রতি ৩-৬ মাসের মধ্যে অন্তত একবার হিমগ্লোবিনের A1c (HbA1c) পরীক্ষা করে দেখা উচিত। এই HbA1c নিরূপণের মাধ্যমে পূর্বের ২-৩ মাস সময়ের মধ্যে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কেমন ছিল তা অনুমান করা যায়। ডায়াবেটিসের চিকিৎসার ফলাফল বোঝার জন্য যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারো A1c এর মাত্রা ৫.৭ থেকে ৬.৪ এর মধ্যে হলে তাকে ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ হবার জন্য ঝুকিপূর্ণ হিসেবে ধরে নেয়া হয়।
ডায়াবেটিসের জরুরী বা তাৎক্ষণিক জটিলতাসমূহ-
১). ডায়বেটিক হাইপারগ্লাইসেমিক হাইপার- অসমোলার কোমা
(Diabetic hyperglycemic hyperosmolar coma.)
২). ডায়বেটিক কেটোএসিডোসিস
(Diabetic ketoacidosis.)
ডায়বেটিসের দীর্ঘমেয়াদি জটিলতাসমূহ-
১). এ্যথেরোস্ক্লেরোসিস -> রক্তনালীতে চর্বি জমে ছিদ্রপথ সরু হয়ে যাওয়া। (Atherosclerosis).
২). করোনারি আর্টারি ডিজিস-> হৃদপিন্ডের ধমনীর রোগ। (Coronary artery disease.)
৩). ডায়বেটিক নেফরোপ্যাথি -> ডায়বেটিস জনিত কিডনী রোগ। (Diabetic nephropathy).
৪). ডায়বেটিক নিউরোপ্যাথি-> ডায়বেটিস জনিত ্লায়ূ-রোগ। (Diabetic neuropathy).
৫). ডায়বেটিক রেটিনোপ্যাথি-> ডায়বেটিক জনিত চোখের রেটিনার রোগ। (Diabetic retinopathy).
৬). ইরেক্সন প্রব্লেম-> পুরুষের লিঙ্গোত্থান সমস্যা। (Erection problems).
৭). হাইপারলিপিডিমিয়া-> রক্তে চর্বির মাত্রা বেড়ে hvIqv|(Hyperlipidemia).
৮). হাইপরটেনশন-> উচ্চ রক্তচাপ। (Hypertension).
৯). ইনফেক্সন অফ স্কিন এন্ড ইউরিনারী ট্রাক্ট-> চর্ম এবং প্রস্রাবের নলীর ইনফেক্সন। (Infections of the skin and urinary tract).
১০). পেরিফেরাল ভাস্কুলার ডিজিস-> প্রান্তিক রক্তনালীর রোগ। (Peripheral vascular disease).
১১). স্ট্রোক-> মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ বা ইনফার্কশন জনিত সমস্যা। (Stroke).
রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অনেক বেড়ে যাওয়া যেমন ভাল নয়, তেমনি হঠাৎ করে যেন খুব বেশি কমে না যায় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারন উভয় ক্ষেত্রেই জীবনের জন্য হুমকি স্বরূপ জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে যারা ইনসুলিন নিচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রে বেশি খেয়াল রাখতে হবে। এসব ক্ষেত্রে কি কি উপসর্গ হতে পারে তা জানা থাকলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়া সহজ হয়। অবস্থা গুরুতর হওয়ার আগে রোগীকে হাসপাতালে নিলে ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা খুব বেড়ে গেলে (হাইপারগ্লাইসেমিয়া) যেসব উপসর্গ হতে পারে সেগুলো হল-
পেটে ব্যথা, ঘন ঘন দীর্ঘ-শ্বাস নেয়া, পিপাসা ও প্রস্রাব বৃদ্ধি পাওয়া, অবসাদ, জ্ঞান হারিয়ে ফেলা, প্রশ্বাসে মিষ্টি গন্ধ।
রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা খুব কমে গেলে (হাইপোগ্লাইসেমিয়া) যেসব উপসর্গ হতে পারে সেগুলো হল-
বিভ্রান্তি, শরীরের প্রত্যঙ্গগুলোর ভয়ানক আলোড়ন অথবা অচৈতন্য, মাথা ঘোরা, দ্বৈত-দৃষ্টি, ঝিমানো বা নিদ্রালুভাব, মাথাব্যথা, দূর্বলতা, সমঝতার অভাব
রক্তে গ্লুকোজ স্বল্পতা জনিত আচ্ছন্নতা বা প্রচন্ড ইন্সুলিন প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে গ্লুকোজ, চিনি বা হাতের কাছে বর্তমান মিষ্টি জাতিয় খাবার খাওয়াতে হবে অথবা গ্লুকোজ-ইনজেক্সন দিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। (ক্রমশ চলবে........)
ডায়াবেটিস-কে ভয় নয়, জয় করতে হয়-(শেষ পর্ব)
View this link