ডায়াবেটিস-কে ভয় নয়, জয় করতে হয়- (১ম পর্ব)
ডায়াবেটিস-কে ভয় নয়, জয় করতে হয়-(২য় পর্ব)
২য় পর্বের পরের অংশ-
ডায়াবেটিসের চিকিৎসা-
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে উপসর্গ মুক্ত থেকে সুস্থ্যভাবে জীবন যাপনের জন্য সঠিক সময়ে সঠিকভাবে চিকিৎসা নিতে হবে। তাহলে ডায়াবেটিসের সঙ্গে সম্পর্কীত জটিলতা যেমন- অন্ধত্ব, হৃদরোগ, কিডণী রোগ, পচন জনিত অঙ্গহানী ইত্যাদি থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এটা মনে রাখতে হবে যে ডায়বেটিস নির্মূল করা যায় না। নিয়মিত ও পরিমিত খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, বিশ্রাম ও প্রয়োজনে ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়।
• পথ্য- ডায়াবেটিক রোগীরা খাদ্যের সাথে কি পরিমাণ চর্বি, আমিষ ও শর্করা গ্রহণ করবেন তা নিকটতম ডায়াবেটিক সেন্টারে গিয়ে অথবা ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান এর নিকট থেকে জেনে নিতে হবে। প্রয়োজনে পথ্যবিশারদের নিকটে গিয়ে পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। তবে একজন ডায়াবেটিক রোগির প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় কার্বহাইড্রেট বা শর্করা ৫০-৬০% (এর মধ্যে আঁশ যুক্ত খাবার ২০-৩৫ গ্রাম), ফ্যাট বা চর্বি ৩০% এবং প্রোটিন বা আমিষ ১০-২০% থাকা প্রয়োজন।
ধরন-২ ডায়াবেটিস- এ আক্রান্তদের সুষম ও কম চর্বিযুক্ত খাদ্য সঠিক পরিমাণে সময়মত গ্রহণ করা উচিত।
• ব্যায়াম- ডায়াবেটিক রোগীদের প্রতিদিন ব্যায়াম করা উচিত। এটা একদিকে যেমন রক্তের গ¬ুকোজ বা শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রনে রাখে, তেমনি ওজন কমাতে ও উচ্চ-রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে সহায়তা করে। যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন না তাদের তুলনায় যারা করেন তারা অনেক কম হারে হার্ট-এ্যটাক ও স্ট্রোকের শিকার হন।
ব্যায়ামের নিয়মাবলী-
o ব্যায়াম আরম্ভ করার পূর্বে এবং বিশেষ করে ব্যায়ামের ধরন পরিবর্তনের সময় ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নেয়া উচিত।
o নিজের শারীরিক উপযুক্ততা অনুসারে আনন্দ- দায়ক ব্যায়ামের বিষয় নির্বাচন করতে হবে।
o প্রতিদিন এবং সম্ভব হলে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে হাঁটতে হবে।
o মাঝে মাঝে হাঁটার আগে ও পরে রক্তে গ¬ুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করে দেখা উচিত।
o হাঁটার সময় শর্করা সমৃদ্ধ কিছু খাবার সাথে রাখতে হবে। যে কোন মূহুর্তে রক্তে গ¬ুকোজের মাত্রা কমে জাওয়ার ভাব অনুভূত হলে তা খেয়ে নিতে হবে।
o জরুরী অবস্থার প্রয়োজনে নিজের সাথে সব সময় ডায়াবেটিক কার্ড বা সর্বশেষ চিকিৎসা পত্রের ফটোকপি সাথে রাখতে হবে।
o হাঁটার আগে ও পরে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ও চিনিমুক্ত তরল খাবার খেতে হবে।
(ব্যায়ামের ধরন ও সময় এবং রক্তে গ¬ুকোজের মাত্রা বেশী বা কম হওয়ার উপর ভিত্তি করে খাদ্য ও ওষুধের ধরন এবং পরিমাণ পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে।)
• বিশ্রাম- সময়মত ও নির্দিষ্ট পরিমাণে বিশ্রাম ও ঘুম ডায়াবেটিস রোগীর জন্য অতি জরুরী। দুপুরের আহার ও প্রার্থণার পর (জায়নামাজ বা শীতল পাটির উপর) ১৫-২০ মিঃ চোখ বুঝে চুপচাপ সটান শুয়ে থাকাত পারলে খুবই ভাল হয়। তবে রাতে ৬-৭ ঘুমানো অপরিহার্য। কারণ রক্তের গ¬ুকোজ নিয়ন্ত্রণে এই ঘুমের বেশ বড় ভূমিকা রয়েছে।
• ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে ওষুধ- ইন্সুলিন ও মুখে খাওয়ার বড়ি দ্বারা ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করা হয়।
o ধরন-১ ডায়াবেটিক- রোগীর শরীরে ইন্সুলিন তৈরি হয় না। তাই ইন্সুলিন ইনজেক্সন নিতে হয়। ইন্সুলিনের ধরণ অনুসারে দিনে একবার থেকে চারবার পর্যন্ত ইনজেক্সন নিতে হয়। কেউ কেউ ‘ইন্সুলিন-পাম্প’ ব্যবহার করে। এটা সব সময় বহন করতে হয় এবং তা থেকে সমস্ত দিনভর নির্দিষ্ট হারে ইন্সুলিন সরবরাহ হতে থাকে। অনেকে আবার শ্বাসের সাথে ইন্সুলিন নেয়ার জন্য ‘ইন্সুলিন-শ্বাসক’ ব্যবহার করে।
o ধরন-২ ডায়াবেটিস- নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ব্যায়াম, খাদ্য পরিবর্তন ও মুখে খাওয়া ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করতে হয়। প্রসূতি ও দুগ্ধবতী মায়েদের চিকিৎসার জন্য ইন্সুলিন ব্যবহার করা যেতে পারে।
• পায়ের যত্ন: ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়শই পায়ের সমস্যায় ভুগে থাকে। ডায়াবেটিস হলে রক্তনালী ও ্লায়ুকোষের ক্ষয় হয় এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। অনেক সময় পায়ে ক্ষত হলে তাতে ইনফেক্সন না হওয়া পর্যন্ত টের পাওয়া যায় না। এমন কি চামড়া ও অন্যান্য কোষে পচন ধরতে পারে। ঠিকমত চিকিৎসা করা না হলে জীবন রক্ষার্থে পা কেটে ফেলার প্রয়োজন হতে পারে। পা কেটে ফেলার যতগুলো কারণ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে ডায়াবেটিস অনেকটা এগিয়ে আছে। সুতরাং পায়ের ক্ষত ও ক্ষতি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে প্রতিদিন পায়ের পরীক্ষা ও পরিচর্যা করতে হবে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে যা করা প্রয়োজন:
• শরীরের ওজন আদর্শ মাপের মধ্যে রাখা ও কর্মময় জীবন যাপন করার মাধ্যমে ‘ধরন-২ ডায়াবেটিস’ প্রতিরোধ করা সম্ভব হতে পারে।
• তবে বর্তমানে ধরন-১ ডায়াবেটিস প্রতিরোধের তেমন কোন উপায় নেই এবং উপসর্গ না থাকলে তা ঢালাওভাবে নির্ণয়ের জন্য যাচাই বাছাই করার তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না।
• ধরন-২ ডায়াবেটিস- এ আক্রান্ত না হয়ে থাকলে এবং কোনরূপ উপসর্গ দেখা না দিলেও যাদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত-
o অতিরিক্ত ওজন বিশিষ্ট শিশুদের ক্ষেত্রে যদি ডায়াবেটিসের সহায়ক আশংকাজনক কারণগুলো বিদ্যমান থাকে, তবে ১০ বছর বয়স থেকে শুরু করে প্রতি ২ বছর পর পর পরীক্ষা করতে হবে।
o অতিরিক্ত ওজন বিশিষ্ট প্রাপ্তবয়স্ক যাদের বিএমআই (ওজন=কেজি /উচ্চতা=মিটার২) ২৫ অপেক্ষা বেশী এবং সেইসাথে ডায়াবেটিসের সহায়ক অন্যান্য আশংকাজনক কারণগুলো বিদ্যমান, তাদের ক্ষেত্রে প্রতি ৩ বছর পর পর পরীক্ষা করতে হবে।
o বয়স ৪৫ বছরের বেশী হলে প্রতি ৩ বছর পর পর পরীক্ষা করতে হবে।
ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতা থেকে রক্ষা পেতে হলে মাঝে মাঝে অর্থাৎ বছরে অন্তত চার বার ডায়াবেটিক হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে। কোন সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
ডায়াবেটিক রোগীকে নিয়মিত যে বিষয়গুলো পরীক্ষা করে দেখতে হবে-
o মাঝে মাঝে রক্তচাপ মেপে দেখতে হবে এবং তা অবশ্যই ১২০/৮০মিমি.মার্কারি বা তার নীচে রাখতে হবে।
o ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলে প্রতি ৬ মাস পর পর HbA1c পরীক্ষা করে দেখতে হবে। নিয়ন্ত্রণে না থোকলে প্রতি তিন মাস অন্তর তা পরীক্ষা করতে হবে। HbA1c এর মাত্রা < ৬.৫% রাখতে হবে।
o প্রতি বছর রক্তের কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা পরীক্ষা করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে রক্তে যেন- এল.ডি.এল < ১০০মি.গ্রাম/ ডেল, এইচ.ডি.এল> ৪০মি.গ্রাম/ডি.এল ও ট্রাইগ্লিসারাইড < ১৫০ মি.গ্রাম/ডি.এল থাকে।
o প্রতি বছর কিডনীর কার্যকারীতা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। বিশেষ করে সেরাম ক্রিয়েটিনিন ও মাইক্রোএলবুমিনিউরিয়া কিরূপ অবস্থায় আছে তা নির্ণয় করে দেখতে হবে।
o প্রতি বছর অন্তত একবার চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ বিশেষ করে যারা ডায়বেটিক রেটিনোপ্যাথি সম্পর্কে অভিজ্ঞ তাদের কাছে গিয়ে চোখ দেখাতে হবে। অসুবিধা থাকলে মাঝে মাঝে যেতে হবে।
o দাঁতের যত্ন নিতে হবে এবং ৬ মাস পর পর দন্ত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে দাঁত পরিষ্কার করাতে হবে।
o চিকিৎসা কর্মীর কাছে গেলে অবশ্যই পা পরীক্ষা করাতে হবে।
o সংক্রামক ব্যাধির প্রতিষেধক নেয়ার ব্যপারে সচেতন থাকেতে হবে।
ধন্যবাদ--
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০১২ সকাল ১১:১১