somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোলাও-কোর্মা-ঝাল মাংস

২২ শে এপ্রিল, ২০১০ বিকাল ৪:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জরিনা বেগম হিজলা গ্রামে বাস করেন। তিন কাঠা জমির উপর একটা পৈত্রিক ভিটা ছাড়া তার বা তার স্বামীর আর কোন সম্পদ নেই। তার স্বামী হেমায়েত আগে ভ্যান চালাতেন। কিন্তু তাতে তার নাকি অনেক কষ্ট হয়। তাই এখন হেমায়েত কিছুই করেন না। সারাদিন ঘোরাঘুরি করেন, টি স্টলে আড্ডা দেন এবং তাশ খেলেন। সুখের জীবন তার।
স্বামী কিছু না করাতে তিন সন্তান নিয়ে বেশ বিপদেই পড়েছে জরিনা। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যে অগ্নিমুল্য! তাই বাধ্য হয়ে জরিনা বেগম গেল “সুখী ব্যাংকে”, মাইক্রো ক্রেডিট লোন নেবার জন্যে । গাভী পালনের শর্তে সুখী ব্যাংক তাকে ১০ হাজার টাকা লোন দিল। বাড়ি ফিরল ৯ হাজার ৫০০ টাকা নিয়ে। বাকি ৫০০ টাকা সার্ভিস চার্জ । টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতেই হেমায়েত জরিনার হাত থেকে ২ টা ৫০০ টাকার নোট নিয়ে বাজারে গেল। পোলাওয়ের চাল-দেশী মোরগ-কিসমিস-ডিম-গরম মশলা নিয়ে বাড়ি ফিরল। অনেক দিন পর বাড়িতে কোরমা-পোলাও-ঝাল মাংশ রান্না হল। রান্নার ঘ্রানে আশপাশের সাত গৃহস্থ পাগল হয়ে গেল। তাদের সবাইকে বাটি ভরে তরকারী পাঠিয়ে দিয়ে জরিনারা পেট ভরে ডিনার করল। ডিনারের পর সুখের ঢেকুর । ঢেকুরের মৃদু শব্দ মুলিবাশের তৈরি ঘরের বেড়ায় প্রতিধ্বনীত হল, অবিরত।
এর দুইদিন পর হাটবার। জরিনা হাটে গিয়ে নিজের জন্যে একটা পাবনার শাড়ি, হেমায়েতের জন্যে একটা লুঙ্গি এবং তিন ছেলেমেয়ের জন্যে তিন সেট ড্রেস কিনে বাড়ি এল। এরপর যে টাকা অবশিষ্ট থাকল তাতে আর গরু কেনা হবেনা, গরুর দাম অনেক। প্লান করতে বসল জরিনা-হেমায়েত। তিন দিন পর সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হল, হেমায়েত আমজাদ মিয়ার পুরাতন ফনিক্স সাইকেলটা আড়াই হাজার টাকা দিয়ে কিনল এবং বাকি টাকা দিয়ে জরিনা ১০ টা হাঁসের বাচ্ছা কিনে তার ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করল। এরপরও হাজার খানেক টাকা হাতে থাকল জরিনার । সেখবর অবশ্য হেমায়েত জানেনা। জরিনা-হেমায়েতের ছেলে মেয়েরা প্রতিদিন হাসিমুখে স্কুলে যাতায়াত শুরু করল।
এর মধ্যেই প্রথম কিস্তি শোধ করার সময় এল। জরিনা জমানো ১ হাজার টাকা থেকে পর্যায় ক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় কিস্তি শোধ করল। এই কদিন বাড়ির খাওয়া দাওয়াও বেশ ভালোই হল। হেমায়েত প্রতিদিন সারা গায়ে সরিষার তেল মেখে গোসল করে। তারপর আবারও গায়ে তেল মেখে-চুলে তেল দিয়ে-চিরুনি দিয়ে আঁচড়িয়ে টি স্টলে গিয়ে চা খায়। আড্ডা দেয়।
কদিন পর। জরিনার হাতের টাকা শেষ। পর পর চার সপ্তাহ কিস্তির টাকা শোধ না করায় সুখী ব্যাংকের লোকজন এসে ঘুরে গেল। জরিনা তাদের কাছে মাফ চাইলেন এবং প্রতিজ্ঞা করলেন আগামী সপ্তাহেই সব পাওনা শোধ করে দেবেন। কিন্তু কিভাবে দেবেন? হাত তো পুরোপুরি খালি। চিন্তায় ঘুম আসেনা জরিনার, কিন্তু চিন্তা নেই হেমায়েতের, সে সব প্লান ঠিক করে রেখেছে। জরিনাকেও বলল। জরিনারও প্লানটা পছন্দ হয়েছে, আবার ভয়ও করছে।
এভাবে আরও ১ মাস কেটে গেল। ১ টাকাও শোধ করতে পারেনি জরিনা। আরও ১ মাস কেটে গেল। জরিনারা অনেকদিন পোলাও ভাত খায় না। একদিন সুখী ব্যাংকের লোকজন এসে হেমায়েতের সাইকেল এবং জরিনার হাঁসগুলি ধরে নিয়ে গেল। হাঁসগুলি তখনও ডিম দেওয়া শুরু করেনি। আগের প্লান অনুযায়ী এই ঘটনার পরদিনই জরিনা-হেমায়েত গেল “নিজের পায়ে চলি” নামক এক এনজিও’র অফিসে। “নিজের পায়ে চলি” বা নিপাচ সুখী ব্যাংকের বিরোধী পাটি। নিপাচ’র কথা হল, শুধু ঋণ দিলে হবে না, দরিদ্র মানুষদের সাথে সর্বক্ষণ থাকতে হবে-তাদের পথ বাতলে দিতে হবে এবং দারিদ্র বিমোচনে হাতে হাত ধরে কাজ করতে হবে। শুধু ঋণ দিলে গ্রামের মানুষ তা নষ্ট করে ফেলবে। খুবই সত্য কথা। নিজের পায়ে চলি’র বড় আপা জরিনা-হেমায়েতের সব ঘটনা শুনলেন, নোট লিখলেন, ছবি তুললেন, পরদিন জাতীয় দৈনিকে ছবি সহ রিপোর্ট এল, “মাইক্রো ক্রেডিট নিয়ে সর্ব শান্ত জরিনা বেগম”। নিপাচ জরিনা কে নগদ টাকা দিল যাতে সে সুখী ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে পারে, সাইকেল হাঁস ছাড়িয়ে আনতে পারে। আবারও পোলাও-কোর্মা-ঝাল মাংস। তারপর শুরু হল জরিনা বেগমের সেলাই মেশিন চালনা প্রশিক্ষন। সেই সাথে প্রতিদিন ১০০ টাকা ভাতা। ১ মাস প্রশিক্ষন শেষে নিপাচ তাকে একটি সেলাই মেশিন দিল। কিস্তিতে এর দাম শোধ দিতে হবে । বাড়িতে ফিরে গিয়ে জরিনা শুরু করল “জরিনাস্ ফ্যাশন হাউজ”, কিন্তু সমস্যা হল গ্রামের মেয়েরা তো আর দিনে ২ সেট করে জামা বানায় না, তাই ফ্যাশন হাউজ করে মাছ-ভাত নিশ্চিত করে কিস্তির টাকা শোধ করা হচ্ছে না। বাকি পড়ল ১ মাসের কিস্তি। জরিনা গোপনে সুখী ব্যাংক থেকে আবারও লোন নিল। আবারও পোলাও-কোর্মা-ঝাল মাংশ, আবারও শাড়ি-লুঙ্গি-নতুন ড্রেস। নিপাচ এর কিস্তিও দেওয়া হচ্ছে নিয়মিত। এভাবে সুখী ব্যাংকের টাকায় সেলাই মেশিনের কিস্তিশোধ এবং বাদশাহী খাওয়া চলতে থাকল। এমন সময় একদিন নিপাচ এর বড় আপা এসে মনে করিয়ে দিয়ে গেলেন জরিনার প্রথম এককালীন লোনের কথা। ওহ্হো জরিনাতো ভুলেই গিয়েছিল! জরিনার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। তবে ঠিক মাথার উপর পড়ল না। মাথার উপর ছিল একটা কনক্রিটের ছাদ তার উপর পড়ল আকাশ । এই ছাদের নাম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই যাত্রায় বেচে গেল জরিনা। নির্বাচন উপলক্ষে নিপাচ এবং সুখী ব্যাংক, সবাই চুপচাপ। পর্যবেক্ষন করছে। যেদল জিতবে তার সাথে খাতির করে আবারও কাজ শুরু করা হবে। এদিকে নির্বাচন উপলক্ষে গ্রামে ব্যাপক টাকার ছড়াছড়ি। মিছিলে গেলেই টাকা, শ্লোগান দিলেই টাকা, পোষ্টার লাগালেই টাকা, প্রতিদিন কড়কড়ে টাকা পকেটে নিয়ে ফিরছে হেমায়েত। আবারও পোলাও-র্কোমা-ঝাল মাংশ। ইলেকশানের পোলাও-র্কোমা-ঝাল মাংস । ইলেকশনের আগের দিন রাতে নগদ ১০ হাজার টাকা পেল হেমায়েতÑজরিনা। নিচিন্তে কেটে গেল আরও দুই মাস। সুখী ব্যাংকের ম্যানেজার এবং নিপাচ এর বড় আপা দুজনেই জরিনাকে চাপ দিতে থাকল কিস্তি পরিশোধ করার জন্যে । কিন্তু ততদিনে জরিনা শিখে ফেলেছে কিভাবে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকা যায়। জরিনা নানান ভাবে ঘোরাতে লাগল ম্যানেজার-বড় আপাকে।
এমন সময় একদিন তিন যুবক এল জরিনার বাড়িতে জরিপের কাজে। হেমায়েতের সাথে কথা হল:
: আপনি যদি আমাদের একটু সহযোগিতা করতেন?
: তাতে আমার কি লাভ?
: জ্বি, আপনাদের জীবনমান কিভাবে উন্নত করা যায় তা নিয়ে আমরা জরিপ করছি।
:তাতো বুঝলাম কিন্তু আমার লাভ কি? (হেমায়েত ডান হাতের বুড়া আঙ্গুল এবং মধ্য আঙ্গুল ঘষে টাকা নির্দেশ করল)
:জ্বি আপনাদের জন্যে একটা সুন্দর মগ আছে।
:আমরা মগ দিয়ে পানি খাইনা। কল দিয়ে ডাইরেক্ট খাই। আপনারা এইখান থেকে যান। ভাগেন।
:আচ্ছা ঠিক আছে আপনাকে ৫০ টাকা দেওয়া হবে।
:আমরা ৫০ টাকায় ইন্টারভু দেইনা। মিনিমাম ৫০০। দিলে দেন নাইলে ভাগেন।
অগত্যা সার্ভেকারীরা ১০০০ টাকা দিয়ে হেমায়েত-জরিনার ইন্টারভিউ নিল। আবারো পোলাও-কোর্মা-ঝাল মাংশ। কিস্তির টাকা ফেরত না পেয়ে ম্যানেজার-বড় আপা জরিনাকে আবারও লোন অফার করল। যাতে জরিনা নতুন করে ব্যাবসা করে পুরান-নতুন দুই কিস্তিই শোধ দিতে পারে। জরিনা গোপনে দুই পক্ষের কাছ থেকেই নতুন করে লোন নিল। আবারো পোলাও-কোর্মা-ঝাল মাংস । পরপর দুই মাস ঠিক মত কিস্তি দিয়ে জরিনা আবারও কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করে দিল। এভাবেই চলতে থাকল জরিনার দারিদ্রের বিরুদ্ধে অভিযান। যুদ্ধ।
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০১


জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।

আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭



২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

×