ভারতের গোয়ায় নামি দামি সব দেশের নেতারা জড়ো হয়েছেন সম্মেলন করার জন্যে, এই গোয়া সম্মেলনের প্রস্তুতি চলছে গত এক বছর ধরে। হুলুস্থুল অবস্থা। যদিও এই সম্মেলনের সাফল্য নিয়ে সবার মধ্যেই সংশয় আছে তবুও মিডিয়ায় এই সম্মেলনের ব্যাপক প্রচার চলছে। যদিও উন্নত-অনুন্নত দেশগুলি ষ্পষ্টতই বিপরীত অবস্থানে দাড়ানো তবু সবাই কেন যেন গোয়া সম্মেলনের সাফল্য নিয়ে আশাবাদী! এখন থেকে ঠিক দুইশ বছার আগে ২০০৯ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে ঠিক এই রকমই একটি সম্মেলন হয়েছিল। সেটি হয়েছিল পরিবেশ দূষন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্যে । সেই সম্মেলনটিও ব্যার্থ হয়েছিল। আপনারাতো জানেনই গত দুইশ বছরে পৃথিবী অনেক পাল্টে গেছে। বাংলাদেশ-মালদ্বিপের মত অনেক নিচুদেশ তলিয়ে গেছে সাগরের তলে। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসেনা । এই দেশগুলি বিশ্ব অর্থনীতির জন্যে কোন ফ্যাক্টর ছিল না। বরং ঢাকা-মালে এখন আন্ডার ওয়াটার সিটি নামে পরিচিত বিখ্যাত টুরিষ্ট ষ্পট । ভারতীয় পর্যটন কর্পোরেশনের অনুমোদন নিয়ে সেখানে ব্যাবসা করছে বেশ কয়েকটি টুরিষ্ট কোম্পনি, ফাইভ স্টার হোটেল। ঢাকার গুলশানে র্নিমিত হয়েছে “এনজেলস্ বাথটাব”, পৃথিবীর সবচেয়ে লাক্সারিয়াস আন্ডার ওয়াটার ফাইভ স্টার হোটেল। বিপুল অর্থ উপার্জন হচ্ছে এই আন্ডার ওয়াটার সিটি থেকে।
যাই হোক গোয়া সম্মেলন ২২০৯ আয়োজন করা হয়েছে “মানব দূষণ” রোধ করার জন্যে। যদিও এই সম্মেলনের ভবিষ্যতও ২০০৯ সালের কোপেনহেগেন সম্মেলনের মত হবে তবুও এই সম্মেলনকে দেখা হচ্ছে পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় সবচেয়ে বড় উদ্যোগ হিসেবে। নুহয়ের নৌকার মতই গুরুত্বপূর্ণ এই উদ্যোগ। ভারত-চীন-ব্রাজিল-মেক্সিকান মিডিয়ায় বিশাল তোড়জোড়। সম্মেলন স্থলের ঠিক বাইরেই মানববাদীদের বিক্ষোভ মিছিল। তারা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী-চীনা প্রেসিডেন্টের কুশাপুত্তলিকা দাহ করেছে। একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর একজন জুনিয়র এক্সিকিউটিভ গায়ে অকটেন ঢেলে আগুন জ্বেলে আতœহত্যার হুমকি দিয়েছে। সব ক্যামেরাম্যান-সাংবাদিক-ফটোগ্রাফারের দৃষ্টি তার দিকে । কখন আগুন জ্বালাবে? দুর্লভ ছবি-খবর, মিস করা যাবে না। মুহূর্তের মধ্যে এই ছবি-খবর বিশ্ববাসীকে জানাতে পারলে ক্যামেরাম্যান-সাংবাদিক-ফটোগ্রাফার হিট। একটি ড্রামে অকটেনও রেডি দেখা যাচ্ছে। কখন আগুন জ্বালাবে??
ঘন্টা খানেক আগে উদ্ধোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। বিশ্বনেতাদের বতৃতা শেষে ভারতীয় বিখ্যাত মুম্বাই ফিল্মের নাচ শুরু হল। কথক নৃত্য আর কামসুত্রের ফিউশন এই নাচ সারাবিশ্বে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে। তারপর সম্মেলনের মুল প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে মঞ্চে উঠলেন ব্রাজিলিয়ান শ্রমিক নেতা “লুলা ডি তামা”। তামা শুরু করলেন-
“লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান। যদিও আপনারা জানেন, তবুও আমার প্রবন্ধের শুরুতে ইতিহাসের কিছু ঘটনা আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর বিশ্বব্যাপি এক নতুন বিপ্লব শুরু হয়েছিল যার নাম “শ্রম বিপ্লব” এই শ্রম বিপ্লবের ফসল হিসেবে পৃথিবীতে একের পর এক বহুজাতিক এবং আর্ন্তজাতিক কোম্পানীর জন্ম হয়। শ্রম বিপ্লবের ফলে পুঁজির প্রবাহ এবং ব্যবহার অনেক বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীর অর্থনীতি অনেক গতিশীল হয়। পৃথিবী সামনে এগিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের র্দূভাগ্য তৎকালীন পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধুরাষ্ট্র সমুহ এই শ্রম বিপ্লবকে অপব্যবহার করে নিজেদের পুঁজি বৃদ্ধির হার নিশ্চিত করতে চেয়ে ছিল শুধু। একেক জন শ্রমিককে তারা ১২-১৪ ঘন্টা এমন কি ১৬ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য করত। বড় বড় পোষ্ট-মোটা বেতন-বাড়ি-গাড়ির লোভ দেখিয়ে তারা শ্রমিককে কাজ করাতে বাধ্য করত। সেখান থেকেই “মানব দুষন” শুরু। তার পরের ইতিহাস আপনারা সবাই জানেন। ১৯৯০ সালের পর সমাজতন্ত্রী অর্থনীতির পতনে এই কর্পোরেট অপকালচার এবং সেকারণে মানব দুষনের হার বাড়তে থাকে। যদিও তখনও এই “মানব দুষন” টার্মটির জন্ম হয়নি।
আর এখন! মানুষ এখন ২৪ ঘন্টা অফিসে-কারখানায় থাকতে চায়। কেউ বাড়িতে যেতে চায় না। সম্পূর্ণ বিনা কারণে অফিসে সবাই সবার বসের বুট জুতা চাটে, চেটে পরিস্কার করে দেয়। ব্যাংকাররা সারা দিন বসে বসে টাকা গুনছে। অকারণে টাকা গুনছে। মুখ থেকে থুতু নিয়ে টাকা গুনছে। গুনতে গুনতে এক সময় মুখের থুতু ফুরিয়ে যায়। তারপর আরেক জনের মুখের থুতু লোন নিচ্ছে। চড়া সুদে। তারপর থুতু গ্রহিতার মুখে যখন পরে আবার থুতু ফিরে আসছে সে তখন তার ঋনের থুতু ফেরত দিচ্ছে, সুদে-আসলে। পুরো ব্যাংক পাড়ায় থুতু বানিজ্য।
সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভরা প্রোডাক্টের গুনাগুন নিয়ে জিকির করতে করতে ধ্যানে নিমগ্ন হচ্ছে। ধ্যানে গিয়ে তারা বিভিন্ন গায়েবী নির্দেশ পাচ্ছেন। এদের কোন কোনটির নাম ছহি সাবান নামা, মোবাইল সিম শরিফ ইত্যাদি । ধ্যান ভেঙ্গে তারা একেকটি খানকাহ শরীফ খুলে নিয়ে বসছেন। নতুন ধর্ম প্রচার শুরু করেছেন। “সিম শরীক” ফলোকারী সিম ধর্মাবোলম্বিদের সংখ্যা এখন অনেক বেশী, কোটি কোটি। “ছহি সাবান নামা” ফলোকারী সবান ধর্মাবোলম্বিদের অধিকাংশই অবশ্য নারী। এদের বিশ্বাস পরকালে এরা ঐশ্বরীয়ার মত সুন্দরী হবে।
ফিনান্স ম্যানেজাররা হিসাব করে বের করেছে তার কোম্পানীর এমপ্লয়ীরা প্রতিদিন কত লিটার ঘামে। সেই ঘাম দিয়ে কি পরিমান জলীয় বাষ্প হয় । সেই জলীয় বাষ্প দিয়ে কি পরিমান মেঘ হয়। সেই মেঘ দিয়ে কি পরিমান বৃষ্টি হয়। সেই বৃষ্টি দিয়ে কতটুকু ফসল ফলে। তারপর তারা এইচ আর ম্যানেজারকে বলে কৃষকের কাছে ঐ পরিমান ফসল দাবী করতে, কারণ তা এই কোম্পানীর এমপ্লয়ীদের ঘাম শুকানো ফসল। পরিমানে কম হলেও এইচ আর ম্যানেজার এই ফসল কেটে নিয়ে আসে। এটা তাদের অধিকার। তারা অধিকার সম্পর্কে অনেক সচেতন।
প্রিয় বিশ্বনেতৃবৃন্দ। এই হল বর্তমান অবস্থা, এই অবস্থায় বিশ্ব অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে এইরূপ মানব দুষনের হাত থেকে আমাদের শ্রমিক সমাজকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। আর সেই সাথে এটাও মনে রাখতে হবে মানব দুষন প্রতিরোধের নামে যাতে বর্তমান অর্থনীতির গতি যাতে হ্রাস না পায়। মানব দুষন যাতে রোধ হয় সেদিকে যেমন নজর রাখতে হবে তেমনি মহান শ্রম বিপ্লবের সুফল যাতে সবাই ভোগ করতে পারে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। এজন্যে আমাদের একটি কৌশল ঠিক করতে হবে। সেই কৌশল ঠিক করতে পারলেই এই সম্মেলন সফল হবে। আসুন আমরা সবাই মিলে সেই কৌশল ঠিক করি। আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।
এই “কৌশল” কি তা নিয়ে শুরু হল বিতর্ক। উন্নত বিশ্ব ভারত-চীন-ব্রাজিল-মেক্সিকো-চায়না চাচ্ছে শ্রমিকের জন্যে অবশ্য পালনীয় কর্মঘন্টা ১৮ থেকে নামিয়ে ১৪ ঘন্টা করতে। আপর দিকে দরিদ্রদেশ যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-ফ্রান্স-জার্মানী চায় তাদের শ্রমিকদের দিয়ে কোন অবস্থাতেই ৮ ঘন্টার বেশী কাজ করানো যাবেনা। কিন্তু বেতন দিতে হবে বর্তমান স্কেল অনুযায়ী। সম্মেলনের শেষ দিনেও যখন এবিষয়ে ঐক্যমত হলনা; তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রচেষ্টায় সবাই একটা চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করল। যে চুক্তিপত্রের মূল কথা হল, “এ বিষয়ে আমরা আবারও আলোচনায় বসব”।
সম্মেলন শেষে বিশ্ব মিডিয়ায় ফলাও করে প্রাচার করা হল। গোয়া সম্মেলন শতভাগ সফল। সমাপনী অনুষ্ঠানে আবারো শুরু হল মুম্বাই ফিল্মের ফিউশন নাচ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





