প্রাণী জগতের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল তারা খুব অল্প দিনেই শোক ভুলে যায়। হয়তো তা-না-হলে সারাদিন প্রাণী জগৎ বসে বসে কান্নাই করত, বিলাপ করত। অন্য কিছু করতে সময় পেত-না। হায় হায়! তাহলে কোর্টেÑহাসপাতালেÑজমি রেজিস্ট্রেশনের অফিসে দালালি করতো কে? নেতাদের পিছ পিছ চামচামি করতো কে? বক্ষ সর্বশ্বা সংবাদ পাঠিকাকে টিভিতে সুযোগ করে দিত কে? রাত জেগে ঘেউ ঘেউ করত কে? কিন্তু তা নয়, প্রাণী জগত সহজেই শোক ভুলে যায়। আজ মরে গেলে কাল দুইদিন। পরশু তিনদিন। এক মাস পর ত্রিশ দিন। এক বছর পর ৩৬৫ দিন। দশ বছর পর... দশ বছর পর... ধুর কে এখন ক্যালকুলেটর চাপাচাপি করে।
বিশেষ করে মানুষ। নিজের শরীরের কোন একটা অঙ্গ যেমন হাত-পা-চোখ হারানোর মত ব্যাথাও মানুষ একদিন ভুলে যায়। শুধু যে ভুলে যায় তাই নয়, এই নিয়ে তারা ব্যবসা করতেও নামে। ঢাকায় যত পঙ্গু ভিক্ষুক আছে তাদের অনেকেই রোড এক্সিডেন্টে বা বোমা বিস্ফোরণে বা অন্য কোনভাবে পঙ্গু হয়েছে। তারপর তারা সেই পঙ্গুত্ব দেখিয়ে প্রতিদিন ভালো অ্যামাউন্টের ভিক্ষা আদায় করে নিচ্ছে। একেই হয়তো বলে শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করা। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সালে দেশ ব্যাপি যখন একের পর এক বোমা-গ্রেনেড হামলা হচ্ছিল তখন ঢাকার রাস্তায় পঙ্গু-ঝলসানো ভিক্ষুকও বেড়ে গিয়েছিল। যত শোক তত শক্তি। যত শোক তত টাকা। শক্তি = টাকা।
যাই হোক বল্টুর অপারেশন এবং তার পরবর্তী পরিবর্তনের ধাক্কা লাল্টু অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। এর পুরোপুরি ক্রেডিট অবশ্য ওলির। ওলিই তাকে জীবনের নতুন পথ চিনিয়েছে। দিয়েছে নতুন রং-রূপ-গন্ধের সন্ধান। অবশ্য মানুষের উপর দারুণ ক্ষেপে আছে লাল্টু। ওলি বাদে পৃথিবীর সকল মানুষকে ঘৃণা করে লাল্টু। লাল্টু তখন খুব ছোট, এই মাত্র ২/৩ মাস বয়স। ওলির মা প্রতিদিন সকালে লাল্টুর মায়ের ওলান টিপে দুধ দুইয়ে নিত। আর একটু দূরে লাল্টুকে শক্ত করে ধরে রাখত হোসেন। দুধ দোয়াতে দোয়াতে ওলান যখন প্রায় শূন্য তখন লাল্টুকে ছেড়ে দেওয়া হত। লাল্টু ওলানে মুখ লাগাতেই স্রষ্টা তার যাদুকরী ক্ষমতা বলে সেই শূন্য ওলান আবার পূরণ করে দিত। কিন্তু স্রষ্টা যতটা মহান তার সেরা সৃষ্টি মানুষ ততটা নয়। ২ বার ওলানে চোষা দিতে না দিতেই ওলির বড় ভাই হোসেন তাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে আসত।
আবারও ওলান টিপে দুধ দোয়াতো ওলির মা। চোয়াৎ চোয়াৎ...। ওলির মায়ের দুই উরুর মাঝে চকচকে অ্যালুমিনিয়ামের বালতি। চোয়াৎ চোয়াৎ...। তৃষ্ণায় গলা ফেটে যেত লাল্টুর। কিন্তু হোসেনের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে নিজের মায়ের দুধ খাওয়ার শক্তি ছিল না তার। আবারও যখন ওলান শূন্য হয়ে যেত তখন আবার ও লাল্টুকে আনা হত স্রষ্ঠার ভান্ডার থেকে আরো কিছু দুধ খালাশ করে আনতে। খালাশ যদিও লাল্টু করছে কিন্তু তাতে তৃষ্ণা মেটানোর ক্ষমতা তার নেই্ বরং তা বিক্রি হয়ে যেত গ্রামের হাটে। এভাবে লাল্টুর নাম ভাঙ্গিয়ে দুধ আনতে আনতে যখন স্রষ্ঠার ভান্ডারও খালি হয়ে যেত তখন লাল্টুকে ছেড়ে দেওয়া হত। রাগে গজগজ করত সে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই, তার বেশি কিছু করার ক্ষমতা তার নেই।
আধুনিক মহিলারা নিজেদের বাচ্চাদের নিজেদের বুকের দুধ না খাইয়ে গরুর দুধ খাওয়াচ্ছে। নিজেদের বুকের দুধ খাওয়ালে নাকি বুকের শেপ নষ্ট হয়! এতে গরুর বাচ্চাও তার মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গরুর বাচ্চা-মানুষের বাচ্চা সব শিশুই যার যার মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ অবিচার মেনে নেওয়া যায় না। হয় মানুষের বাচ্চা এবং গরুর বাচ্চা যার যার মায়ের বুকের দুধ খাবে; আর না হয় যদি মানুষের বাচ্চা গরুর দুধ খায় তাহলে গরুর বাচ্চাকেও মানুষের দুধ খেতে দিতে হবে। কোনটা মেনে নেবেন এখনই ডিসিশন নিন। কেউ খাবে কেউ খাবেনা, তা হবেনা তা হবেনা। কেউ কেউ আবার বলেন, মানুষের বুকের দুধ নাকি মানুষের বাচ্চাদের জন্যে যথেষ্ঠ নয়, কম। অস্ট্রেলিয়ার-নিউজিল্যান্ডের গরুদের তো ওষুধ পত্র খাইয়ে ওলান ফুলিয়ে ফেলেছেন, নিজেরটা করছেন না কেন? একবার করে দেখুন কেমন লাগে। মোটা-তাজা করণ। বড়ঃ বড়ঃ।
দুই চারবার তিড়িং বিড়িং লাফ দিয়ে শান্ত হয় লাল্টু। এভাবেই সবলেরা চিরকাল দুর্বলদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে। আর ঈশ্বর চিরকাল ছিল সবলদের পক্ষে কারণ কোরবানীর সময় সবচেয়ে বড় গরুটা কোরবানিতো সবলই দিতে পারে। দূর্গা পুজায় সবচেয়ে বড় মূর্তি তো সবলরাই বানাতে পারে। ঈশ্বর তাতেই খুশি। ঈশ্বর লোভী-স্বার্থপর-সুবিধাভোগী। কমরেডদের ভাষায় বললে ঈশ্বর বুর্জোয়া শ্রেণী ভুক্ত। ঈশ্বরের অ্যাকাউন্ট স্টার্ন্ডাড র্চার্টাড-এইচএসবিসি ব্যাংকে। গ্রামের সোনালী ব্যাংকে ঈশ্বর যান না। সেখানে লম্বা লাইন, তার পছন্দ এটিএম বুথ।
ছোট বেলায় লাল্টুর মা লাল্টুকে অনেক গল্প শুনিয়েছে। কোরবানীর ঈদের গল্প, জমি চাষ করার গল্প, কলুর বলদের গল্প, ষাঁড়ের লড়াইয়ের গল্প, গরুর গাড়ির গল্প, নিজেদের রক্ত পানি করে মানুষের উপকার করারÑএতটুকু আনন্দ দেওয়ার গল্প। সব শুনে মানুষের উপর ক্ষেপে যায় লাল্টু। সিদ্ধান্ত নেয় জীবনে কোনদিন মানুষকে সাহায্য করবে না। তাতে কপালে যা থাকে। কিন্তু হায়! যে যত কঠিন প্রতিজ্ঞা করে সে-ই তত সহজে তা ভঙ্গ করে। এর কয়েক দিন পরেই ওলির সাথে পরিচয় হয় তার। কয়েক দিন মিশে, কথা বলে মানুষ সম্পর্কে ধারণা পাল্টে যায় তার।
শুধু ভয়ের গল্প নয়, লাল্টুর মা তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ঝিঝি পোকার। রাতের বেলা শত শত ঝিঝি পোকা এক সাথে কোরাস করে বিচিত্র গান গেয়ে ওঠে। সন্ধার পর ছবেদা গাছটা ভরে যায় জোনাকি পোকায়। এক সাথে জ্বলে ওঠে এক সাথে নেভে। জোনাকিকে দেখে লাল্টু ছড়া কাটেÑ
জোনাকি, ও জোনাকি!
তোমার সাথে খেলতে আমার মানা কি?
তবে এটাও ঠিক হাজার বছর ধরে মানুষের সাথে এক সঙ্গে আছে বলে গরুদেরকে বন্য হিংস্র জীবন যাপন করতে হয় না। এজন্যে মানুষের প্রতি কিছুটা কৃতজ্ঞ লাল্টুর মা। তবে মানুষ যদি আরেকটু সদয় হত তাদের প্রতি। তাহলে মানুষÑগরুর এই দীর্ঘ বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হত। গরুরা মানুষের আরও উপকার করতে পারত। কিন্তু কি আর করা। ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন।
আর একটা জিনিস শিখেছে লাল্টু। শুধু লাল্টু নয়, মানুষ বাদে উদ্ভিদ এবং প্রাণী জগতের সবাই এই বিদ্যা জানে। পৃথিবী সৃষ্টির আদি থেকে আজ পর্যন্ত যত ঘটনা ঘটেছে। যত শব্দ উচ্চারিত বা উৎপন্ন হয়েছে। যত বাতাস প্রবাহিত হয়েছে এবং তাতে যা কিছু ভেসে গেছে তা ইচ্ছা করলেই জানতে পারে সকল উদ্ভিদÑ সকল প্রাণী। এবং এতেই লুকিয়ে আছে পৃথিবীর আসল রহস্য। পৃথিবী সৃষ্টির আদি থেকে আজ পর্যন্ত ঘটা সকল ঘটনা পরপর সাজালে তাতে একটা ছন্দ বা সুত্র পাওয়া যায়। আর তা থেকেই বোঝা যায় পৃথিবীর পরিণতি কি এবং তা কত দিনে ঘটবে। কাজেই মানুষ বাদে সকল প্রাণী এবং উদ্ভিদ জানে পৃথিবীতে ভবিষ্যতে কি ঘটতে যাচ্ছে এবং তা কবে ঘটবে। অথচ এই জিনিসটি জানার জন্যেই পৃথিবীর তাবত বিজ্ঞানী-শিল্পী-দার্শনিক-চিন্তাবিদ জীবন উৎসর্গ করে যাচ্ছে। যেদিন মানুষ এই সূত্র আবিস্কার করতে পারবে সেই দিনই মানুষ সৃষ্টি কুলের অন্য সদস্যদের সমকক্ষ হবে। সেদিনই হবে মানুষের সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের শেষ দিন। সেদিন মানুষও হয়ে যাবে গাছের মত শান্ত প্রাণীর মত উপকারী।
যখন কোন ঘটনা ঘটে তখন তাতে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে আসলে আমরা তা দেখি। কিন্তু আমরা দেখলে বা না দেখলেই এই প্রতিফলিত আলো নিঃশেষ হয়ে যায় না। বরং তা ক্রমাগত বিভিন্ন শক্ত বস্তুতে বাধা প্রাপ্ত হয়ে প্রতিফলিত বা স্বচ্ছ বস্তুতে প্রতিসরিত হতে হতে টিকে থাকে। পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল যে বিরাট বিস্ফোরণের মাধ্যমে, সেই বিস্ফোরণের প্রতিফলিত আলো এখনও পৃথিবীতে টিকে আছে। তা দেখার ক্ষমতা হয়তো কোন মানুষের নেই কিন্তু একটি মেহগনি গাছের আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকায় কে কে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এবং কে কে ভন্ড মুক্তিযোদ্ধা তা হয়তো আমরা বের করতে পাড়ছি না কিন্তু একটা কোকিল পাখিও তা দুই দিনে খুঁজে বের করতে পারবে-
কুয়ু-কুয়ু, না দুইদিন নয়, পুরো ১ সপ্তাহ লাগবে, কুয়ু-কুয়ু।
কেন, এত দিন লাগবে কেন? তুইও দেখি সরকারি অফিসার হয়ে গেছিস-রে কোকিল!
কারণ ইদানিং অনেক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার নাম শোনা যায় ৭১’ এ যারা ৮ বছরের চেয়েও ছোট ছিল। এই শিশুরা কিভাবে যুদ্ধ করেছিল তা নিয়ে গবেষণা করতেই ৫ দিন লাগবে, বাকি ২ দিন খোঁজাখুঁজি। “ভুয়ামুক্তিযোদ্ধা” জিন্দাবাদ।
জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ!
কোন শব্দ উৎপাদিত হলে এর পাশের বায়ুস্তরে যে কাঁপনের সৃষ্টি হয় তা আর কখনও থামে না। কাঁপতেই থাকে। মানুষের ক্ষমতার বাইরে চলে যায় বলে মানুষ আর শোনে না। কিন্তু অন্যদের ক্ষমতা মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। শব্দের উৎস স্থল থেকে এই কম্পিত বায়ুস্তর ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে। পুকুরে ঢিল মারলে যেমন ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে সারা পুকুরে, তেমনি। রোমিও যেদিন প্রথম কিস্ করছিল জুলিয়েটকে, আর তাতে চুক্ করে যে শব্দ হয়েছিল তা এখনও চাইলেই শুনতে পারে যেকোন পুঁটি মাছ। কিন্তু জুলিয়েটকে রোমিও কিস্ করল না রেপ করল তাতে পুটি মাছের কিছু যায় আসে না। তাই তারা এটি শুনতেই চায় না। তবে কিছু দুষ্টু পুটি মাছ আছে। এরা মানুষের পাদের শব্দ নিয়ে রিসার্চ করছে। তারা আবিস্কার করেছে মানুষের পাদের শব্দ এবং গন্ধ পরস্পর ব্যাস্তানুপাতিক। অর্থাৎ শব্দ বেশি হলে গন্ধ কম আর গন্ধ বেশি হলে শব্দ কম। এবং এই সূত্রে একটা কনসট্যান্ট আছে। এই কনস্ট্যান্টের ভ্যালু আবিষ্কার নিয়েই এখন ব্যস্ত ঐ দুষ্টু পুঁটির দল।
বল্টুর ক্যাস্ট্রেশানের পর থেকে পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেছে লাল্টু। একেকটা ঘটনা জানছে এবং ওলিকে বলছে। শুনে শিউরে উঠছে ওলি। সেই রোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে আধুনিককালে সুদানের দারফুর, সব জায়গাতেই যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকদের নপুংসক করে দিয়েছে বিজয়ী যোদ্ধারা। এরপর পরাজিতদের স্ত্রী-কন্যাদের সঙ্গে নারকীয় তাণ্ডব করেছে বিজয়ী বীরেরা তাদেরই চোখের সামনে। বীর! এরা বীর? ইয়ার, বিজয়ীরা চিরকালই বীর। বীর ভোগ্যা বসুন্ধরা। শুনে ওলি মাথা নিচু করে ফেলে।
সিমা কিয়ান নামের একজন বিখ্যাত চীনা ঐতিহাসিককে নপুংসক করেছিল চীনের সম্রাট। তার অপরাধ সে সম্রাটের সমালোচনা করেছিল। প্রেমিকার জনৈক আত্মীয়ের রোষানলে পড়ে পুরুষত্ব হারিয়েছিল ফ্রেঞ্চ ফিলোসফার পিয়েরে অ্যাবলার্ড। স্কটিশ বিপ্লবী উইলিয়াম ওয়ালেসকে ঐ একই শাস্তি দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। অস্বাভাবিক যৌন আচরণের শাস্তি হিসেবে ক্যাস্ট্রেশনের বিধান করে ভার্জিনিয়ার আদালত ১৭৭৮ সালে। এর নাম হাইকোর্ট!
আবার ইরানের রাজা লতিফ আলি খান নপুংসক করে দিয়েছিল বিদ্রোহী মোহাম্মদ খান কাজারকে। এরপর কাজার যখন রাজ্য দখল করে নিল তখন তিনিও আবার খোঁজা করে দিলেন লতিফকে। কি দারুণ প্রতিশোধ। এই সবকিছু লাল্টু জেনেছে ইতিহাস থেকে। ওলি চুপ। তার বলার কিছু নেই।
মানুষের নিষ্ঠুরতার প্রমাণ তো ওলির চোখের সামনেই ঘটছে অহরহ। লাল্টু প্রায়ই এই সব বিষয় নিয়ে ওলিকে খোটা দেয়। তবে হ্যাঁ, সে জানে ওলি আর দশজন মানুষের মতো নয়। সে কাউকে কষ্ট দেয় না। পারলে উপকার করে।
বল্টু এখন আর ওলি-লাল্টুর সঙ্গে আসে না। সে যায় মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে জমি চাষ করতে। বল্টুর অবর্তমানে সেই জায়গা অনেকটাই দখল করে নিয়েছে ওলি। ওলি প্রথমে ছিল লাল্টুর খুব ভালো বন্ধু। এরপর তার দুঃখের দিনের সাথী, একমাত্র অবলম্বন। আর এখন, এমন কিছু যাকে ছাড়া এক মুহূর্ত চলা যায় না। ওদের মধ্যে কি প্রেম? ও মাই গড! তাও কি সম্ভব? মানুষে-গরুতে প্রেম? কেন নয়? সবার রক্তই তো লাল। রক্ত লাল হলেই কি প্রেম হয়? কেন নয়? এসব নিয়ে ওরা দুজনেই ভাবে, আলাদাভাবে। কেউ কারো সঙ্গে শেয়ার করেনি। প্রকাশ্যে কেউ কাউকে বলেনি, তবু দুজনেই জানে, দুজনের মনের কথা, চোখের ভাষা।
একদিন তালতলায় বসে জাবর কাটতে কাটতে লাল্টুই প্রথম তুলল প্রসঙ্গটাÑ
তুই কি জানিস হেলেনা তোকে ভালোবাসে ?
জানি। (ওলি নির্লিপ্ত)
তুই কি ওকে ভালোবাসিস?
তোর কি মনে হয়?
মনে হয় বাসিস না।
হুঁ, বাসি না।
কেন?
জানিনা।
এই বিষয়ে ওলির নির্লিপ্ততা লাল্টুর ভালোলাগে কিন্তু প্রকাশ করেনা। অন্য বিষয়ে কথা খোঁজে কিন্তু পায় না। এরপর দুজনে অনেক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। কেউ কোন কথা বলে না। কথা খোঁজে, পায় না। রাজ্যের কথা মাথার ভিতর কিন্তু ঠোঁট কাঁপে না। হঠাৎ করে লাল্টুর মাথার উপর কিছু একটা পড়ল। চমকে উঠল লাল্টু। ওলি তাকিয়ে দেখে একটা বট গাছের ফলের বিচি। ওলি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে একটা বাদুর উড়ে যাচ্ছে। বটগাছের প্রজনন খুবই আজব প্রকৃতির। বটের ফল মাটিতে লাগালে কখনই চারা গজায় না। বটের পাকা ফল যদি কোন পাখি খায় এবং মল ত্যাগের সময় যদি ফলের বিচি পড়ে এবং সেই বিচি যদি নরম কোন মাটিতে পড়ে কেবল তবেই বটের চারা জন্মে। এত গুলি “যদি” পেরিয়ে আসতে হয় বলেই বটগাছ এত রেয়ার। আর রেয়ার বলেই হয়তো হিন্দুরা এর পূজা করে। পৃথিবীতে যা কিছু কম পাওয়া যায় তার দাম বেশি হয়, যেমন হীরা। একটা জিনিস বাদে, তা হলো “ভালো মানুষ”। পৃথিবীতে ভালো মানুষ যেমন পাওয়া যায় কম তেমনি তার দামও কম। দাম বেশি উকিল-সাংবাদিক-পুলিশ-ব্যবসায়ী-পলিটিশিয়ানদের। তারা সিআইপি, অর্থাৎ চরম ইমর্পটেন্ট পারসন।
ওলি কলমি ফুল দিয়ে মালা গাঁথে। তালের পাতা চিরে বানানো সুতার মালা। তারপর তা পরিয়ে দেয় লাল্টুর দুই শিং এর উপর। লাল্টুর গলার নিচের নরম চামড়ায় হাত বুলিয়ে দেয় ওলি। আরামে চোখ বন্ধ করে লাল্টু। নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছে, যেন আরামের কোন ক্ষুদ্র অংশও মিস্ করতে চায় না। হঠাৎ করে বাতাসের গতি বেড়ে গেছে। বিশাল খোলা মাঠে শো-শো শব্দ হচ্ছে। বড় বড় তালের পাতা একটা আরেকটার সাথে ঘষা লাগছে। তাতেও শব্দ হচ্ছে। এই সব শব্দ ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে ওলি-লাল্টুর হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন। একটা চার প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট অন্যটি তিন প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট।
চলবে....
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০১০ সকাল ১১:৩৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





