গাছের ডালের মত বড় একটা রাস্তা থেকে যেখানে মাঝারি একটা রাস্তার জন্ম হয়েছিল সেই মোড়ে দাঁড়িয়েছিল উসাইন বোল্ট। চেহারায় ঘুম আর জাগরণের মধ্যকার দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। কখনও ঘুম প্রাধান্য বিস্তার করছে কখনও জাগরণ। আর সেই সাথে প্রতীক্ষা। একটা বড় সাইজের হলুদ রঙের বাস মোড় ঘুরেই বোল্টকে অতিক্রম করে এগিয়ে গেল প্রায় ৫০ ফুট। ঘটনাটা ঘুমের মাথায় টং করে একটা বাড়ি মারল। মুহুর্তে জাগরণ তার শক্তি প্রকাশ করল। কোন প্রকার বন্দুক ফোটার আওয়াজ ছাড়াই উসাইন বোল্ট দৌড় শুরু করল। একি! উসাইন বোল্ট বাসের পিছনে ছুটছে কেন?
নাকি সে উসাইন বোল্ট নয়, উসমান বাবু। তার দেশ তো মনে হচ্ছে জামালপুর, জ্যামাইকা নয়। তার আসল নাম উসমান গনি বাবু। হালÑফ্যাশন হল দুই শব্দের নাম, তাই ‘গনি’ বেচারা আত্মগোপন করে উসমান বাবুর ইজ্জত রক্ষা করেছে। কিন্তু জামালপুরের উসমান বাবু এত দ্রুত দৌড়ানো শিখল কোথায়? বাবুর বাবা নিম্ন পদের সরকারী কর্মচারী আর মা সারা জীবন সেলাই মেশিনের ঘটর ঘটর ছাড়া অন্য যে কাজটা করেছে তা হল, বাবুকে পড়ার টেবিল থেকে উঠতে দেয়নি। খেলাধুলা প্রথম প্রথম সে করত স্বপ্নে, পরেতো স্বপ্ন থেকেও হারিয়ে গিয়েছিল। সেই উসমান বাবু এত দ্রুত দৌড়াচ্ছে? বিশ্বাস হচ্ছে না। নাকি ও উসাইন বোল্টই। আমি কি ভুল দেখছি? একই রকম দৌড়!
উসমান বাবুর অচেনা ফেসবুক ফ্রেন্ড মেহজাবিন কাজি, একবার তার সাথে চ্যাট করার সময় মেহজাবিন বাবুকে বলেছিল-
Ñআমি আপনাকে সেদিন দেখলাম।
Ñকোথায়?
Ñঐ যে রাস্তার মোড়ে, বাসে উঠছিলেন।
Ñওহ্ হো, আমি তো তাহলে সেদিন আমার এক বন্ধুকে মিস করলাম।
Ñকাকে?
Ñআপনাকে! আপনি আমাকে দেখলেন আর আমি আপনাকে দেখতে পারলাম না।
এরপর চ্যাটের আলোচনা অবশ্য অন্য দিকে টার্ন নিয়েছিল। কিন্তু সেই কথা মনে পড়ায় উসমানের পা দুটো একটু দ্বিধায় পড়ে যায়। মেহজাবিনের মত তার কোন ফেসবুক ফ্রেন্ড কি তার এই দৌড় দেখছে? তাহলে তো ইজ্জত আর থাকবে না। তার কি এভাবে দৌড়ানো উচিৎ হচ্ছে? কিন্তু এই বাসটা মিস্ হলে ৯টার মধ্যে অফিসে পৌছানো যাবে না, একদিনের বেতন কাটা যাবে। না এই বাসটা মিস্ করা যাবে না। উসমান বাবু উসাইন বোল্ট হয়ে ওঠে। দৌড়।
বাবুর বন্ধু নুপুর। একটা বেসরকারী টিভির অ্যাসিস্টেন্ট প্রোডিউসার। ট্রাফিক জ্যামের উপর একটা ডকুমেন্টারী শ্যুট করতে গিয়ে নুপুর দেখেছিল বাবু বাসের দরজায়, “দরজার খোলা পাল্লার” মত ঝুলে ঝুলে যাচ্ছে। শুধু যে নুপুর দেখেছিল তাই নয় ক্যামেরায়ও রেকর্ড হয়েছিল। এডিটিং এর সময় নুপুর ইচ্ছা করে ফুটেজটা ফেলে দিয়েছিল। বন্ধুর ঝুলন্ত ছবি টিভিতে গেলে বন্ধু মাইন্ড করতে পারে, তাই। গল্পটা আবার ইউনিভার্সিটির সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নুপুর বাবুকে বলছিল, আর সেই সাথে সাবধানে পথ চলার উপদেশ। জবাবে অবশ্য বাবু “আরে এটা কোন বিষয় না, কত জনেইতো বাসে ঝোলে” বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন হঠাৎ করে মনে হল, এই মুহুর্তে কি কোন টিভি ক্যামেরা তাকে তাক করে রেখেছে? কাল স্যাটেলাইটে ট্রাফিক জ্যামের নিউজে তার দৌড় প্রচারিত হবে? তারপর কি? অসংখ্য ফোন আর ফেসবুক ওয়ালে কমেন্ট? এভাবে কি দৌড়ানো ঠিক হচ্ছে? ইস্ বাসটা তো প্রায় ভরেই গেল। ওঠা যাবে তো?
স্থিতি জড়তায় আবদ্ধ মধ্যবিত্ত শরীর থেমে যেতে হয়। আর মুদ্রাস্ফীতিতে কাতর নিম্নবিত্ত মন দৌড়াতে চায়। একেই কি বলে ক্লাস কনফ্লিক্ট? বিত্ত নিয়ে ভালোই বিপদে পড়েছে উসমান। কার্ল মার্কস্কে একটা ফোন দেয়া দরকার। মার্কস ভালো বলতে পারবে। আচ্ছা মার্কসের মোবাইলের ওয়েলকাম টিউনে কোন গানটা থাকতে পারে? “জাগো জাগো জাগো সর্বহারা..” নাকি “এই পতাকা শ্রমিকের রক্ত পতাকা..”
আর ক্লাস সেভেনের ছেলেদের সাথে ক্লাস এইটের ছেলেদের যে কনফ্লিক্ট, ওটাওতো ক্লাস কনফ্লিক্ট। তাই না?
কার্ল মার্কস্ নিয়ে মজার কথা ভাবতে ভাবতে বাবু তার বা হাত দিয়ে বাসের দরজার লোহার রডটা ধরে ফেলে। ডান পায়ের পাতার সামনের অর্ধেকটা তুলে দেয় বাসের পা-দানির শেষ খালি জায়গাটুকুতে, সেই সাথে মুখজোড়া বিজয়ের হাসি। আর ঠিক তখনই বোল্টের বুক ছিড়ে ফেললো সিল্কের ফিতাটা। তার নিজের মত করেই উদযাপন করল বিজয়টা। দর্শকদের সামনে ‘বা’ হাতটা ৪৫ কোণে উচু করে, হাতের আঙ্গুল বরাবর তাকিয়ে এবং ‘ডান’ হাতটা বুক বরাবর ‘বা’ হাতটাকে অনুসরণ করে বোল্ট তার ‘লাইটেনিং বোল্ট’ প্রতীকটা দেখালো দর্শকদের। যথারীতি শরীরের অধিকাংশ ভর ডান পায়ের উপর।
আশ্চর্য্য! বাবু যেভাবে বাসের দরজায় রডটা ধরে ঝুলে আছে সেটাও বোল্টের সেই ‘লাইটেনিং বোল্ট’ বিজয় চিহ্নের মতই। জ্যামাইকার উসাইন বোল্টের সাথে আমাদের জামালপুরের উসমান বাবুর কত মিল!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





