তৃণার প্রানের বন্ধু মিলি। এক মহল্লাতেই থাকে। চরিত্রিক বৈশিষ্ট্যে তৃণা অতি সহজ-সরল এবং সুমনা। কোন কিছুর ঘোরপ্যাচের মধ্যে নেই। আর মিলি কিছুটা চালাক চতুর, হিসেবী এক কথায় একজন বুদ্ধিমতী মেয়ে যাকে বলে। সেদিন হঠাৎ দুপুরে তৃণা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বন্ধুকে বলল, ‘সর্বনাশ! আমার হাতের আংটিটা পাচ্ছি না- আমার বিয়ের আংটি।’
মিলি চোখ কপালে তুলে বলল, ‘সে কী রে!’ তারপর তৃণার বাহাতের অনামিকা সামান্য তুলে ধরে মুখ খুলল ‘দূর্দান্ত ছিল আংটিটা, অমন আংটি আমি আর একটাও দেখিনি! হারালি কী করে? পড়েটরে গেছে বোধ হয়!’ দুদিকে মাথা নাড়াতে নাড়াতে তৃণা বলল-‘অসম্ভব! ইদানীং আংটিটা ভীষন টাইট হয়ে গিয়েছিল। আঙ্গুলে কেটে বসত প্রায়। হাত থেকে ওটা কিছুতেই খুলে পড়তে পারে না!’ কপালে কয়েকটা ভাঁজ ফেলে মিলি জিঙ্গেস করল, ‘আংটিটা কোথাও খুলে রেখেছিলি তুই?’
‘না।’
‘ নিশ্চয়ই খুলেছিলি। না খুললে হাতে বসা আংটি কোথায় যাবে?’ আকাশ পাতাল ভেবে নেয়ার পরে তৃণা বলল, ‘সকালে হাতমুখ ধোয়ার সময় একবারই খুলি। খুলে বেসিনে রাখি। তারপর আবার পরে নেই।’
‘রোজ পরিস, আজ ঠিক পরতে ভুলে গেছিস।’ মিলির কপালের টানটান চামড়ায় আগের ভাঁজগুলো বেশিক্ষন থাকেনি। আবার ভাঁজ পড়ল কপালে। একটু কেটে কেটে মিলি প্রশ্ন করলো. ‘যা জিঙ্গেস করব, একটু ভেবে উত্তর দিবি। হাতমুখ ধুয়ে বেরুবার পরে কে ঐ বাথরূমে ঢুকেছিল? ’
‘আমি বেরুবার পরে? ও- ।’
‘আরে বাবা, শিমুল তো আর তোর আংটি সরাতে যাবে না। ওর পর আর কে ঢুকেছিল?’
তৃণাকে উদ্ভান্তের মতো দেখাচ্ছিল। ‘বড় বাথরুমটায় তো অনেকেই ঢোকে-।’
‘আজ কে কে ঢুকেছিল? কার পরে কে? একটু ভেবে বলতো।’
‘ও বেরুবার পর ঢুকেছিল শারমিন।’
‘শারমিন মানে কাজ করে যে বউটা- সে কি?’
‘হ্যাঁ।’
‘তারপর আমাদের বাড়ির কাজের ছেলেটা - ঝন্টু।’
কপালের ভাঁজগুলো আবার মিলিয়ে গেছিল মিলির। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর প্রশ্ন করলো ‘আর কেউ?’
‘ ড্রাইভার ঢুকেছিল একবার।’
‘ড্রাইভার !’
‘না, ওই বাথরূমটা ও কখনও ব্যবহার করে না। গাড়ির চাবি নিতে এসে পানি চেয়েছিল একবার। তা আমি শারমিনকে বলেছিলামÑপানির সঙ্গে একটা মিষ্টি দিও। মিষ্টি খাওয়ার পরে ড্রাইভার বাথরুমে ঢুকে বেসিনে হাত ধুয়েছিল।’
‘বেসিনে?’
‘হ্যাঁ, বেসিনটাই তো সামনে।’
‘এরা ছাড়া আর কেউ ঢুকেছিল বাথরুমে?’
উদ্ভান্ত ভাবটা জমাট হয়ে বসেছিল তৃণার চোখেমুখে। ‘কী জানি, আর কারও কথা তো মনে পড়ছে না।’ বন্ধুকে সোফায় বসিয়ে মিলি ঘরের মধ্যে পায়চারি করলো কিছুক্ষন। তারপর নীচু গলায় বলল ‘আমার সন্দেহের তালিকায় তিনজন-এক শারমিন, দুই ঝন্টু, তিন- ড্রাইভার। - না, না দুই হচ্ছে ড্রাইভার তিন ঝন্টু।’ তৃণার চোখে অকুল সমুদ্রে তাকানোর দৃষ্টি। মিলি উল্টো দিকের চেয়ারে বসে বলল ‘শোন, তোকে খুব ঠান্ডা মাথায় এগোতে হবে।’ কাল সকালে শারমিন কাজে এলে তুই একটা ফাঁকা ঘরে ওকে ডেকে নিয়ে বলবি- ‘তুমি আমাকে আংটিটা ফেরত দাও।’
উত্তরে ঝড়ের গতিতে মাথা নাড়লো তৃণা। ‘ও আমি পারব না। অসম্ভব মুখরা মেয়ে শারমিন, সঙ্গে সঙ্গে চেচামেচি করে হুলুস্থুল বাঁধাবে। যা- তা শোনাবে। শুধু বাড়িতে নয় রাস্তায় গিয়েও চেচাঁবে। এ-বাড়ি সে-বাড়ি গিয়ে আমার বদনাম করবে। এটা সেটা সরানো ওর বরাবরে স্বভাব, কয়েকদিন আমার চোখেও পড়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারিনি। ’
‘না বলে ভালই করেছিস। দিনকাল এখন একদম পাল্টে গিয়েছে। একটা সময চুরি করে ধরা পড়লে লোকে কান্নাকাটি করতো। এখন রুখে দাঁড়ায়। কেউ কেউ বলে -ছোটখাটো ব্যাপারগুলো নাকি চুরি নয়। তোকে একটু কায়দা করে এগোতে হবে। তুই শারমিনকে বলবি ওটা আমার বিয়ের আংটি। তুমি ওটা আমাকে ফেরত দিলে আমি তোমাকে অন্য একটা দামী জিনিস দেব। ওরও তো বিয়ে হয়েছে। একটু সেন্টিমেন্ট মিশিয়ে কথা বলবি। বলবি শীঘ্রই আমাদের বিয়ের পাঁচ বছর পূর্তি হবে। ঐ সময় বিয়ের আংটি না হলে চলে। ’
ঢোক গিলে তৃণা বলল ‘বিয়ের পাঁচ বছর হতে অনেক দেরী। এইতো সবে দেড় বছর পেরুলাম।’
মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল প্রানের বন্ধু ‘ আর কয়েক মাস গেলেই দুই বছর। পাঁচ বছর আসতে আর কতক্ষন। তোকে যা বলছি করতো।’
কীভাবে কি বলতে হবে- বেশ ভাল রকমের তালিম দিয়ে বন্ধুকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল মিলি।
দুই
পরদিন সকাল হতেই বুকের ভেতরটা ঢিবঢিব করতে শূরু করে দিল তৃণার। কাজের মেয়ে শারমিন ঠিক সময় কাজ করতে এসেছিল। ওর মন মেজাজ ভাল থাকলে গুন গুন করতে করতে কাজ সারে। শারমিনের বয়স ২৫/২৬। তিন বছরের একটা ছেলে আছে। ছেলেটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। গলির মোড়ে একটা বিউটি পারলার আছে। মাসে অন্তত একদিন ঐ পারলার থেকে ঘুরে আসে শারমিন। তৃণার রূপচর্চায় কোথায় কোথায় খামতি আছে তাই নিয়ে প্রায় ছোটখাটো লেকচারও দিয়ে থাকে ও।
হাতের কাজ সারছিল শারমিন। সামনে দিয়ে বার কয়েক ঘোরাঘুরি করার পরে নিশ্চিত হলো তৃণা -শারমিনের মুড এখন বেশ ভাল। পাশের ফাঁকা ঘরটায় ঢুকে গলা সামান্য তুলে তৃণা ডাকল ‘শারমিন একবার এ ঘরে এসোতো।’ চেঁচিয়ে উত্তর দিল শারমিন ‘কাজ ফেলে যাব কী করে? আপনি এখানে আসুন না ভাবী।’ তৃণার ভেতরটা শুকিয়ে গিয়েছিল। ঢোক গিলে বলল ‘ ঠিক আছে কাজ শেষ করে এসো, দরকারি কথা আছে।’ শারমিন কখনো আঁচলে হাত মোছে না। হাত মোছার জন্য ছোট একটা তোয়ালে রেখে দেয় বাাথরুমের এক ধারে। মিনিট পনের বাদে সেই তোয়ালায় হাত মুছতে মুছতে এ ঘরে এসে জিঙ্গেস করলো ‘ কি বলবেন বলুন।’ কথাগুলা যেন মুখের মধ্যে জমানো ছিল তখন থেকে। কেমন একটা ধাক্কা দেওয়া গলায় তৃণা বলে উঠল ‘কাল আমি ভুল করে হাতের আংটিটা বাথরূমের বেসিনের উপর ফেলে এসেছিলাম। ওটা তুমি আমাকে ফেরত দাও। আমি এমনি এমনি ফেরত চাইছি না। ফেরত দিলে আমি তোমাকে একটা দামী জিনিস উপহার দেব।’
তৃণা একবারের জন্যও শারমিনের চোখের দিকে তাকায়নি, কি প্রতিক্রিয়া বুঝতে একটুও অসুবিধা হচ্ছিল না। রান্নাঘরে গ্যাস বার্ণারের সামনে দাঁড়ালে গায়ে যেমন তাপ লাগে। শারমিনের দিকে তাকিয়ে ঐরকমই একটা তাপ এসে তৃণার গায়ে লাগছিল। দম ফুরিয়ে আসছিল তৃণার। বাকী কথাগুলা এখনই বলে ফেলা দরকার, না হলে আর হয়তো বলাই হবে না। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ও বলল, ‘শারমিন ওটা আমার বিয়ের আয়টি। মেয়েদের কাছে বিয়ের আংটির কি দাম - তোমাকে তো সে কথা আর বুঝিয়ে বলার দরকার নাই। তুমি ওটা আমাকে ফেরত দাও। ওটার বদলে আমি তোমাকে অনেক মূল্যবান জিনিস দেব।’
শারমিনের দিক থেকে শান্ত অথচ কঠিন কথা ভেসে এলো, ‘ আংটিটা যে আমি নিয়েছি আপনি কি করে বুঝলেন।’ প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গিয়েছিল তৃণা। মিলির শেখানো সম্বাব্য প্রশ্নোত্তরের মধ্যে এটা ছিল না। কয়েক মুহুর্ত থেমে থাকার পর বলল, ‘বারে আমি বাথরুমে আংটি ফেলে আসার পরে তুমি ঢুকলে বাথরুমে। তারপরে আমি বাথরুমে ঢুকে দেখি ওটা আর নেই। তুমি ছাড়া আর কে নেবে?’ শারমিনের মুখের দিকে একবারও তাকায়নি তৃণা। আবার সেই শান্ত আর কঠিন গলা ভেসে এলো। ‘বাথরুমের কাজ সারার পরে আমি এদিকের আরো অনেক কাজ সারি। কালকেও সেরেছি। তো কাল আমাকে আংটির কথা জিঙ্গেস করলেন না কেনো?’ তৃণার হঠাৎ সন্দেহ হলো। শারমিন বোধ হয় একটু আধটু ওকালতির বই পত্র পড়েছে। ঘাবড়ে যাওয়ার কিছুক্ষন বাদে বলল- ‘আমি ভেবেছিলাম তুমি নিজে থেকে বলবে। বলবে, ভাবী আপনি এই আংটিটা বাথরুমে ফেলে এসেছিলেন। এই নিন-।’ হঠাৎই খিলখিল করে হেসে উঠল শারমিন। তাপরপর বলল,‘ভাবী আপনার বয়স খুব বেশী নয় , কিন্তু আপনি বড্ড সেকেলে। কাজ করতে এসে কাজের লোক এটা সেটা পেলে কখনো সেটা ফেরত দেয়না। দেবেই বা কেনো। ওগুলো তো ওদের প্রাপ্য। অনেকদিন ধরেই তো এভাবে চলে আসছে, আপনি বোধ হয় একেবারেই জানেন না ! ’ শারমিনের কথায় তৃণা বেশ অপমানিত বোধ করলো। আর অপমানের মাত্রা বেশী হলে একটু সাহসও দেখা দেয়। বহুক্ষন বাদে শারমিনের দিকে তাকালো ও। তারপর চোখে চোখ রেখে বলল, ‘তোমার বরাবরই একটু হাতটানের স্বভাব আছে। তোমার ধারনা আমি কি সেসব জানি না? চারভাঁজ করা একটা থলি নিয়ে ঢোক এ বাড়িতে। বেরোও যখন থলিটা পেটমোটা হয়ে যায় কি করে? তুমি কি ভাব আমি কিছুই বুঝি না? ’
‘কেন বুঝবেন না? একটা বাচ্চা ছেলেও বুঝতে পারবে। এবার বলুন চুরি করা কোন জিনিস কেউ কি গেরস্তের নাকের উপর দিয়ে নিয়ে যায়। যায় কি-?’ প্রশ্নের সামনে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল তৃণা। আবার সেই বেয়ারা সংশয়টা দানা বেঁধে উঠলো- শারমিনের কি দুই চারখানা আইনের বই পত্তর পড়া আছে!
কাউকে কব্জায় ফেলে চোখ মুখের ভঙ্গি যেমন হয় শারমিনের ভঙ্গি এখন অবিকল সেই রকম। নিজের প্রশ্নের উত্তর ও নিজেই দিল। ‘ না ভাবী চুরি করা জিনিস নিয়ে ওভাবে ড্যাং ড্যাং করে বেরোনো যায় না। ওটুকু জিনিস আমাদের প্রাপ্য। কি টাকা দেন বলুন তো? এই মাইনে কারো সংসার চলে?’
পায়ের তলার মাটি একটু দুলে উঠলেও সরেনি তৃণার। তারপর শক্ত গলায় তৃনা বলল, ‘এটুকু কাজের জন্য ১৫০০ টাকা কি কম?’
‘ঐ টাকা দিয়ে একবার দোকান বাজার যান না? সংসারের অল্প কয়েকটা জিনিসপত্র কেনার পরই দেখবেন হাতে মাত্র কয়েকটা পয়সা পড়ে আছে। পাঁচটা বাড়িতে কি এমনি এমনি খেটে মরছি ভাবী।’ শারমিনের গলাটা শেষের দিকে ধরে এসেছিল। তৃণার মনটা খুব নরম। পরের দুঃখ একেবারে সহ্য করতে পারে না। সামান্য একটু সহানুভূতির ভাব দেখিয়ে বলল ‘ এত খেটে মরো কেন? তোমার বরতো মোটর মেকানিক। গাড়ি সারাতে শুনেছি ভালই পয়সা আসে। ’
হাতের তোয়ালে কাঁধে ফেলে শারমিন বলল ‘ মিথ্যে কথা বলব না ভাবী। গাড়ির কাজে ও সত্যি ভাল রোজগার করে। গাড়ির মালিকরা বিশ্বাস করে ওর হাতে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। ও-----ও, গাড়ির আসল পার্টস সরিয়ে লোকাল মাল চালিয়ে দেয়। এতে বেশ ভাল লাভ থাকে। কিন্তু আমার কাছে পুরোটাই লোকসান। ’
‘কেন! লোকসান কেনো?’
‘ওর রোজগারের বেশিরভাগ টাকাটাই চলে যায় নেশা ও আর জুয়ায়। ’
‘তুমি কিছূ বলতে পার না?’
‘অনেক বলেছি। হুজ্জুত করেছি। পাড়ার ছেলেদের দিয়ে মারও খাইয়েছি একবার। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় নি। খুব অশান্তি করলে বড়জোর দুই একদিন চুপচাপ থাকে। কিন্তু আবার যে তা সেই। সংসারের সব খরচ ধরতে গেলে আমাকে সামলাতে হয়। একটা আইবুরো ননদ ছিল তার বিয়ে দিয়েছি। ও যদি একটু ঠিক থাকতো তাহলে আমাকে এত মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হতো না। ’
তৃণা অবসর সময় একটু জনকল্যাণ করে। দু তিনটা সেন্টারে যায়। গরিব দুঃখী, পথভ্রষ্ট মানুষদের অল্পস্বল্প সাহায্য করার চেষ্টা করে। এখন ভরসা দেওয়ার গলায় বলল। ‘শারমিন তোমাকে আমি একটা মাদকাসক্ত নিরাময় সেন্টারের ঠিকানা দেব। টেলিফোনে সব আমার বলাও থাকবে। তুিম তোমার বরকে ওখানে একবার নিয়ে যেতে পারবে?’
শারমিনের ভ্র“ প্লাগ করা। বাঁকা ধনুকের মতো দুটি ভূরু কপালের দিকে সামান্য ঠেলে দিয়ে বলল, ‘কেন?’
‘ওটা একটা খুব ভাল সেন্টার। যারা ওষুধের নেশা, মদের নেশার শিকার-তাদের কাউন্সেলিং দেওয়া হয়। মানে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অল্পস্বল্প ওষুধ দিয়ে নেশা ছাড়ানো হয়-। ’
শুনে ঠোঁট উল্টে শারমিন বলল ‘যাকে মার দিয়েও শায়েস্তা করা যায় না, তাকে বোঝানো তো বেকার।’
‘না, না এ বোঝানো একেবারে অন্য ধরনের বোঝানো। ডাক্তাররা বোঝাবে। একদিন নয়, দিনের পর দিন। দরকার হলে কিছূদিনের জন্য নার্সিং হোমেও ভর্তি করে নেবে। ’
‘সে তো অনেক খরচ। ’
‘এটা একটা দাতব্য প্রতিষ্ঠান। পাঁচজনের সাহায্যে চলে। তোমাকে অবশ্য কিছু খরচ করতে হবে। কিন্তু তার পরিমান সামান্যই।’ মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল শারমিনের। ‘আমাদের কাছে তো ঐ সামান্যই অনেকখানি। যা খরচ তাই সামলাতে পারি না। ছেলের লেখাপড়ার পেছনেই অনেক খরচ চলে যায়। ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুল। হাজার রকমের বায়নাক্কা, ঢং। এটাসেটার নাম করে প্রায়ই বাড়তি টাকা নেয়। মাসে আবার একবার করে অভিভাববকের সঙ্গে দেখা করে মিস্রা। ওখানে যাওয়ার জন্য ভাল শাড়ি ব্লাউজ দরকার। পাঁচ বাড়িতে কাজ করে করে হাতের যে অবস্থা, একবার আধবার বিউটি পারলারেও যেতে হয়। হাত-মুখ-ভুরু চুল ঠিক করে দেয়- ওখানেও খরচা। ছেলের স্কুলে আবার একা যাওয়ার নিয়ম নেই। ছেলের বাবা-মা দুজনকেই যেতে হবে। বড় মিসের মুখোমুখি হলেই বাধা প্রশ্ন-হাজবেন্ড কোথায়? আমারও বাঁধা উত্তর- ট্যুরে।’
আরও কিছুক্ষন নিজের সংসারের দায়দায়িত্ব , অভাব অনুযোগের কথা তড়বড় করে শোনানোর পরে কাঁধের তোয়ালে হাতে নিয়ে বাকি কাজগুলো সারতে চলে গিয়েছিল শারমিন।
তিন
দুপুরে নয়, শেষ বিকেলে বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিল তৃণা। সব শোনার পর মিলি বলল, ‘ও কাঁদুনি জুড়ে দিল - ব্যাস আর তুই ঐ কথাটি তুললি না। ’ মুখ কাল হয়ে উঠেছিল তৃণার। ‘না, শারমিন আংটিটা নেয়নি।’
একটু ধমকে উঠল মিলি ‘কী করে বুঝলি?’
‘নিলে তো বলত।’
‘নেয়নি - সে কথা কি একবারও বলেছে?’
‘না নিলে ওর চোখ মুখের ভাব অন্য রকম হতো। অন্যরকম কথা বার্তা বলত। ওর যা স্বভাব, নির্দোষ হলে নির্ঘাত চেচাঁমেচি শুরু করে দিত। তুই কাল ওকে আবার ধরবি-।’
একটু বুঝি গলা শুকিয়ে এসছিল তৃণার। ‘ধরে কি বলব?’
‘বলবি- কি হলো এনেছ আংটিটা?’ বললেই এক কথায় সে তোকে আংটিটা ফেরত দেবে না। তুই বলবি, আংটিটা তুমি আমাকে ফেরত দাও- আমি তোমাকে একটা দামী উপহার দেব। ’
‘কী উপহার?’
‘তা নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না- ওই বলে দেবে। দিনকাল আজকাল একদম পাল্টে গেছে। কোনটা যে কার অধিকারের মধ্যে পড়ে- আজকাল সবসময় বুঝে ওঠা যায়না।’
পাল্টে যাওয়া দিনকালের হালচাল নিয়ে মিলি একটা লম্বা বক্তৃতা দিল। শুনতে শুনতে ভাল মানুষ তৃণা অবাক হয়ে ভাবছিল; কখন যে এতসব পরিবর্তন হয়ে গেল, কিছুই টের পেলাম না!’
আগামী কালের সম্ভাব্য প্রশ্নোত্তর নিয়ে এক প্রস্থ আলোচনা চালাবার পর মিলি বন্ধুকে বলল ‘এই সব ব্যাপার তুই শিমুলকে কিছু বলতে যাস না-। ’
দুদিকে হাত উল্টে তৃণা বলল, ‘ওকে বলা - না বলা - দুই এ সমান। ওর মাথায় এখন কাস্টমসের কোন কোন আইটেমের উপর কোন কোন ডিউটি বসবে, কোথায়- কোথায় রেড করতে হবে- শুধু এইসব চিন্তা।’
‘স্বাভাবিক, এতবড় চাকরি কি আর এমনি এমনি করে।’
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গার পরই দূর্ভাবনা শুরু হয়ে গিয়েছিল তৃণার। কাল মিলির সঙ্গে কথা বলার সময় কাজটা যতটা সহজ মনে হয়েছিল , আজ ঠিক ততটাই কঠিন বলে মনে হচ্ছে।
যথা সময়ে কাজে এসেছিল শারমিন। এসেই বাথরুমে ঢুকেছিল। কাচাকুচির কাজ সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ছোট তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে মুছতে এ ঘরে এসে বলল ‘তেইশ নম্বর বাড়ির ড্রাইভারের বাড়ির চাকরি গেছে কাল। আমরা তো ভেতরের খবর রাখি, ড্রাইভারেরই দোষ। ড্রাইভারের নাম মধু, ওর লোভ বাড়তে বাড়তে বিচ্ছিরি একটা জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল। কান্ডজ্ঞান বলে কিচ্ছু নেই। পুরো ট্যাঙ্কিই সাফ! আগের দিন মালিক দশ লিটার তেল ঢোকাবার পর গাড়ি গ্যারাজ করল। ওমা! পরদিন গাড়ি অফিস যাওয়ার পথে তিন কিলোমিটার যাওয়ার পরই বন্ধ! কী ব্যাপার? না, ট্যাঙ্কে তেল নেই।’
বিস্ময়ের চাপে চোখ বড় বড় হচ্ছিল তৃণার। ‘ড্রাইভার গাড়ির তেল চুরি করেছিল !’
একটু বুঝি বিরক্ত হলো শারমিন। ‘গাড়ির ড্রাইভার তেল চুরি করবে না তো হলুদ গুড়ো চুরি করবে! সব ড্রাইভারই তেল চুরি করে। কিন্তু এই মধুটা একে বারে মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সন্ধের দশ লিটারই সকালে পুরোটা হাওয়া।’
বিস্ময়ের চাপের সঙ্গে বিবেকের চাপও জুড়ে গিয়েছিল তৃণার। গলার স্বর সামান্য উপরে তুলে বলল, ‘ওভাবে কথা বলে না শারমিন- সবাই চোর নয়-।’
আবার একটু বুঝি অসন্তুষ্ট হলো শারমিন। ‘জিনিসপত্রের যা দাম বেড়েছে, একটু চুরি না করলে কোন ড্রাইভারেরই চলে না। না খেয়ে খেয়ে ড্রাইভার অসুস্থ্য হয়ে পড়লে অ্যাকসিডেন্ট হবে। আর অ্যাকসিডেন্ট হলে গাড়ির লোকদের কি অবস্থা হবে একবার ভেবে দেখুন তো-।’
‘আহা- শারমিন তুমি বড্ড বাজে কথা বলো। সবাই চোর না। তুমি কি বলতে চাও আমাদের ড্রাইভার হালিম চাচাও কি---?’
তৃণার কথাটা আর শেষ করতে না দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠেছিল শারমিন। তারপর হাসতে হাসতেই চেঁচিয়ে উঠল ‘ঝন্টু, ও ঝন্টু এদিকে একবার আয়তো। ও ঝন্টু-।’
ছোট্ট একটা ধমক দিয়ে উঠল তৃণা। কিন্তু ধমকটাকে একটুও পাত্তা না দিয়ে শারমিন বলল ‘ড্রাইভারের খবর ওই সবচাইতে ভাল রাখে। ও ঝন্টু-।’
‘ও এখন মুদির দোকানে গেছে।’
‘তাহলে তো ঘন্টা খানেকের আগে ফিরবে না। ওটাই তো ঝন্টুর সবচাইতে ভাল রোজগারের জায়গা। প্লাস্টিকের বালতিতে করে ময়লা ফেলার নামে যা সরায় তার চাইতে ঢের বেশী রোজগার ওখানে। ’
‘ফের বাজে কথা।’
‘বাজে কি সত্যি ড্রাইভারকে বললেই জানতে পারবেন। ড্রাইভার আর ঝন্টুর মধ্যে খুব আকচাআকচি। দুইজনে দুইজনের হাটে হাড়ি ভাঙ্গাবার জন্য মুখিয়ে আছে। ’
অস্থির হয়ে পড়ছিল তৃণা। ‘আহ্-। শারমিন তুমি কি কাউকেই বাদ দেবে না? সবাই খারাপ। আর তুমি একাই---’
শারমিন বুঝি একটু রুখে দাঁড়াবার ভঙ্গি করল ‘আমি তো এই দুইজনের একজনকেও খারাপ বলিনি। বলবই বা কেন? ওরা ওদের প্রাপ্যটুকু নেয়, কি তার জন্য আপনাদের কখনো কিছূ আটকে যায়নি। ’হালিমচাচা ভাইয়ার গাড়ি থেকে প্রায়ই তেল সরায়, কি তার জন্য ভাইয়ার গাড়ি কখনো বেয়াড়া জায়গায় আটকে গেছে? না যায়নি। তাছাড়া হালিমচাচা ধর্ম মেনে কাজ করে। ভাইয়ার অফিসের গাড়ি থেকে বেশী করে তেল সরায়, আপনাদের নিজের গাড়ি থেকে কম। ভাইয়াকে প্রায়ই এয়ারপোর্টে ছাড়তে যায়। ওখান থেকে ফেরার সময় সব গাড়িই শেয়ার খাটে। হালিমচাচাও খাটে। কিন্তু কখনো আর পাঁচজন ড্রাইভারের মতো চেপে-চেপে একগাদা লোক গাড়িতে তোলে না। গাড়ির ভালমন্দর দিকে নজর রাখে সবসময়। বরং আমি বলব, ঝন্টুর তুলনায় হালিমচাচা--।’
তৃণার পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠছিল বোধ হয়। আর্ত গলায় ধমক দিয়ে বলল, ‘তুমি চুপ করো তো শারমিন, তখন থেকে কেবল আজে বাজে কথা বলে যাচ্ছ-।’
‘একটাও বাজে কথা নয়। আমি ভজিয়ে দিতে পারি। ’
‘ভজাভজির দরকার নেই, তুমি আমার ওটা নিয়ে এসেছ?’
বাঁকানো ভূরু কপালে তুলল শারমিন। ‘কোনটা?’
‘আমার যে আংটিটা তুমি পরশুদিন বেসিনের উপর থেকে নিয়েছ, সেটা-।’
কথাটা বলার পরই তৃণার বুকের মধ্যে ধুকপুকুনি শুরু হয়ে গিয়েছিল। কোনমতে গলার স্বর আগেরই জায়গায় ধরে রাখার চেষ্টা করে বলল, ‘আমি তো আগেই বলেছি তোমাকে- ওটা আমি এমনি- এমনি ফেরত চাইছি না, ওটার বদলে আমি তোমাকে একটা দামী জিনিস দেব-।’
শারমিনের দিক থেকে কোন শব্দ ভেসে এলো না। দশ সেকেন্ড, বিশ সেকেন্ড, ত্রিশ সেকেন্ড রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা করার পর তৃণা শারমিনের দিকে তাকিয়ে বলল ‘কী হল। কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন?’
দার্শনিকের ভঙ্গিতে জবাব এল এবার। ‘আমি অন্য কথা ভাবছিলাম ভাবী। ’
‘কী কথা?’
ফিক করে হেসে শারমিন বলল, ‘আমার মেকানিকের এদিক নেই ওদিক আছে। বলে , শুধু ছেলে নেয়; একটা মেয়েও চাই। মেয়েরাই নাকি বাপ মায়ের দিকটা বেশী দেখে। আমি বললাম- মেয়ে থাকলেই শুধু হয় না, মেয়েকে মানুষ করতে হবে। একটা ছেলের পেছনে যত খরচ, আপনাকে তো বলেইছি ভাবী। মেয়েকে মানুষ করতেও কার্পণ্য করব না ভাবী। বিয়েও তো দিতে হবে, তাতেও একটা মোটা খরচ। আমি ওকে বলেছি- একটু প্লানিং করতে হবে। ছেলের বয়স এখন তিন, ওর পাঁচ হওয়ার আগে- কিছুতেই নয়। এদিকটা তো একটু গুছিয়ে নেওয়া দরকার। ’
বিরক্তি ছড়িয়ে পড়েছিল তৃণার সারা শরীরে। ‘অদ্ভূত ব্যাপারতো! তোমার মেয়েই হলো না, আর তুমি এখন থেকে মেয়ের বিয়ের চিন্তা জুড়ে দিয়েছ? ’
ভাবীর কথায় একটু রাগ হলো শারমিনের। ‘কেন করব না বলুনতো? যা দিনকাল পড়েছে- প্লানিং না থাকলে কি চলে- বিশষ করে আমাদের মতো অভাবী মানুষদের। কালকেই কাগজে পড়ছিলাম-দশ গ্রাম সোনার দাম এখন দশ হাজার টাকা। সুতরাং এখন থেকে এক আধটু সোনা জোগাড় করা চেষ্টা চালাতে হবে- তাই না?’
তৃণা হাঠাৎই আসল কথার হালকা একটা আভাস পেল শারমিনের কথায়।একটু জোর দিয়ে বলে উঠল ‘আংটিটা তুমি কি এনেছ? ’
‘আমি কোত্থেকে আনব! তবে আমি বলছিলাম কি - যে নিয়েছে সে নির্ঘাত ওই আংটির একটা দাম কষে নিয়েছে। আংটিটা তো দেখেছি আমি আপনার আঙ্গুলে। ভেশ ভারীভূরি। দশ, দশ - বিশ গ্রামের নিচে হবে না কিছুতেই। তার মানে ওখানেই তো বিশ হাজার টাকা। তার উপর আংটির মাথায় দামী একটা পাথর আছে। গড়নটাই বা কি সুন্দর! অমন কারিগর আজকের দিনে চট করে পাওয়া মুশকিল। তার মানে আংটির দাম হাজার তিরিশেক হবে- তাই না?’
তৃণার মুখ সামান্য হাঁ হয়ে গিয়েছিল। বিস্ফোরিত চোখে ও শারমিনের দিকে তাকিয়েই ছিল , মুখে কোন কথা জোগাল না। শারমিন কি বুঝল কে জানে , হঠাৎ ব্যস্তসমেত গলায় বলল,‘গপ্পে- গপ্পে অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেল। আমার তো পাঁচটি বাড়ির কাজ, টাইমের কাজ। যাই, হাতের বাকী কাজগুলো সেরে ফেলি। ’
হাতের বাকি সব কাজ চটপট সেরে ফেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল শারমিন।
চার
বিকেল বেলাতেই বন্ধুর বাড়ি ছুটেছিল তৃণা। সব শুনে মিলি চোখ বড় বড় করে বলল,‘বাব্বা! কী খাই ঐ বউটার। একটা চোরাই আংটি ফেরত দেবার জন্য একেবারে তিরিশ হাজার টাকা হেঁকে বসল?’
মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল তৃণার। একটু বাদে মিন মিন করে বলল,‘শারমিন কিন্তু একবারও বলেনি যে, আংটিটা ও-ই সরিয়েছে। বলেছে- যে সরিয়েছে, সে তা ফেরত দিলে -এই রকম একটা দর চাইতে পারে। ’
বন্ধুর দিকে একটা ধমকানির চোখে তাকিয়ে মিলি বলল, ‘তোর এই ভালমানুষি কবে ঘুচবে কে জানে! তোর সঙ্গে দর ঠিক হওয়ার আগে ও কেন বলতে যাবে- আংটিটা ওই হাতিয়েছে! পালাবার একটা পথ খোলা রাখবে না? আমার মনে হয় চোরাই মাল ও বাড়িতেও রাখেনি। তুই যদি ওকে চেপে ধরিস, থানা পুলিশ করিস, কোন ফল হবে না। একটা তৃতীয় পক্ষ খাঁড়া করেছে। তার এই চাহিদা। তুই রাজি হলে তৃতীয় পক্ষের আড়াল থেকে ওই বেরিয়ে আসবে। ’
আঁচল দিয়ে কপালে ঘাম মুছে নিয়ে একটু থেমে থেমে তৃণা বলল,‘তিরিশ হাজার টাকা মানে তো অনেক টাকা। ’
‘ঠিকভাবে দরদাম করতে পারলে দাম একটু কমবে। তবে মনে হয় না পচিঁশের নীচে ও-ই নামবে।’
‘পঁ-চি-শ! আমারই আংটি, অথচ সেই আংটি ছাড়ানোর জন্য আমাকে চোরের হাতে পঁচিশ হাজার টাকা তুলে দিতে হবে ?’
সহানুভূতির সুর ফুটে উঠেছিল বন্ধুর গলায়। ‘কী করবি বল। এটা যদি তোর বিয়ের আংটি না হতো, এর সঙ্গে তোর সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে না থাকতো, আমি বলতাম একটা স্টেপ নে। পুলিশকে খবর দে, অন্যভাবে চাপ সৃষ্টি কর। তাতে অবশ্য কোন কাজ হতো না শেষ পর্যন্ত। তবে হ্যাঁ নিজের কাছে একটা শান্তনা থাকত- তুই হাত গুটিয়ে বসে থাকিসনি, যা করা উচিৎ তাই করেছিস। কিন্তু ওই আংটিটা তো এখন ফেরত পেতে হবে। দিনকাল একদম পাল্টে গেছেরে ! এখন আর চোরের মা নয়, চোরেরই বড় গলা। তুই আর একটুও দেরী করিস না। টাকাটা কালকেই দিয়ে দিয়ে আংটিটা ফেরত নিয়ে নে। দেরী করলে ঘাবড়ে গিয়ে ও ওটা অন্য কোথাও বেচে দিতে পারে।’
বেশ একটা কাল ছাপ পড়ে গিয়েছিল তৃণার চোখে মুখে। ‘একদিনের মধ্যে এত টাকা আমি কোথায় পাব? ব্যাঙ্কের পাশবই , চেকবই সব তো ওর কাছে থাকে। আমার সম্বল বলতে একটা এটিএম, তাতে কুড়িয়ে বাড়িয়ে জোর চার পাঁচ হাজার টাকা হবে-।’
‘শিমুলকে বল তা হলে। কী জন্যে টাকাটা চাইছিস সেটা এক্ষুনি ভেঙ্গে বলার দরকার নেই। বলবি- সব পরে বলব, এখন টাকাটা দাও। ’
‘এখন তো ওর সঙ্গে কথা বলা যাবে না। ’
‘কেন?’
‘এই তো সন্ধের মুখে বেরুবে। কাস্টমস্রে তিনটে সিক্রেট রেড আছে। ওগুলো সেরে ফিরতে ফিরতে মাঝ রাত্তির হয়ে যাবে। ’
‘তিন তিনটে রেড! তাহলে এখন কিছু না বলাই ভাল। রেড মানে তো চোরাকারবারিদের ডেরায় হানা। ফেরে যখন তখনো কি সে টেনস্ড হয়ে থাকে?’
‘না, কাজ তো শেষ তখন। তবে একটু ক্লান্ত থাকে। মাঝরাত্তিরে রেড থেকে ফিরলে প্রথমেই একটু স্নান করে। তারপর হালকা কিছু খাবার দাবার খেয়ে এক কাপ ব্লাক কফি খায়।’
‘তখন তুই কী করিস?’
‘কী করব, কফি দিয়ে সামনের চেয়ারটায় বসি-। আর, ওর কাজ হলো আমাকে জোর করে শুতে পাঠানো। বলে, আমার একটু দেরী হবে ; কিছু নোটস্ লিখতে হবে।’
‘লেখে?’
‘ লেখে। কখনো বেশী, কখনো কম।’
‘তোকে কিছূ দেয়?’
‘কী আবার দেবে?’
‘কাগজপত্তর। খাম-টাম-।’
‘পাগল। ওর অফিসের ব্যাপার-ট্যাপার আমি কিছূ বুঝি না। তাছাড়া, ও-ও আমার ধাত বুঝে গেছে পুরোমাত্রায়। অফিস নিয়ে একটাও কথা বলে না আমার সঙ্গে। নোট টোট লেখা হলে আলমারি খুলে ওগুলো সব ঢুকিয়ে রাখার পর শুতে আসে। ’
‘ শোন, তুই এক কাজ কর--।’
কি কাজ জানার জন্য বুদ্ধিমতী বন্ধুর দিকে উদ্গ্রীব হয়ে তাকিয়েছিল তৃণা। কিন্তু মিলি তক্ষুনি কিছূ বলল না। সোফা ছেড়ে উঠল। ঘরের মধ্যে দু-চারবার পায়চারি করার পর জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। জানালার গ্রীলে মানি প্লান্টের ঝাড়। দু-তিনটে পঁচা পাতা ছিড়ে জানালা গলিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে এসে বলল ‘ চোখ কান খূলে চারিদিকে তাকালেই বোঝা যায়- দিনকাল কত পাল্টে গেছে। এখন যদি কেউ ষোল আনা সৎ হয়ে থাকতে চায়, পারবে না। কমপক্ষে তাকে এক আনা ক¤েপ্রামাইজ করতে হবে। যদি না করে তার টিকে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়বে। তবে এটাও ঠিক, পনেরো আনা সৎ থাকাটা কি কম। ক’জন পারে। আমার মনে হয় শিমুল পারে। ওর মনের সেই জোর আছে। তুই এক কাজ করবি। আজ রাত্তিরে রেড সেরে বাড়ি ফিরে খাওয়া দাওয়ার শেষে যখন কফি খাবে-তুই বলবি-।’
কেশে গলা পরিস্কার করে মিলি আগের কথারই খেই ধরল।
‘ বলবি- তুমি তো আজ তিনটা চোরাকারবারিদের ডেরায় হানা দিয়েছো- তিনটের মধ্যে সবচেয়ে ছোট খামটা আমাকে দাও। কাল সকালে খুব দরকারী একটা ব্যাপার মেটাতে হবে। পরে সব বলব।’
ভাল মানুষ তৃণা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল ‘মানে!’
‘ এখন অত মানে বোঝাতে পারব না। পরে বলা যাবে।’
মিলি খুব দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টাতে পারে। চট করে অন্য প্রসঙ্গে গল্প ফেঁদে বসেছিল।
পাঁচ
পরদিন দুপুর হতে না হতেই বন্ধুর বাড়িতে প্রায় হাসিখুশি মুখেই এসে হাজির হয়েছিল তৃণা। বাঁ হাতের অনামিকায় ঝকঝক করছিল বিয়ের সেই দুর্দান্ত আংটি। রান্নাঘর থেক হন্তদন্ত করে বেরিয়ে এসে মিলি বন্ধুর হাতে হাত ধরে তারিফ করার গলায় বলল,‘সত্যি তোর এই আংটিটা দারুন।’ কথা বলতেই আচমকা তার বুকটা ধড়াস করে উঠল। সোফর পাশে দাড়িয়ে থাকা মিলির চোখটা হঠাতই স্থির হলো সোফার সাইডে রাখা ছোট টেবিলটার উপর। বন্ধুর এ আকস্মিক পরিবর্তনে কিছূ বুঝে উঠতে না পেরে তৃণাও বন্ধুর দৃষ্টি অনুসরণ করতে গিয়েই নির্বাক হলো।
আংটির বদলে শারমিনকে দেয়া টাকার তিনটা বান্ডিলের দুইটা ঐ টেবিলটায় পেপার ওয়েট দিয়ে ঢাকা রয়েছে। ঠিক যেমনটি এবং যে নোটগুলি দিয়েছিল শারমিনকে তৃণা।
অতি আস্তে তৃণা তার বিস্ময়াবনত মুখখানা তুলে অসহায় ভঙ্গিতে বন্ধুর মুখের উপর রাখল। চরম হতাশা ও অসহায় ভাবে দু’ফোটা লবনাক্ত জল গড়িয়ে পড়ল কি চোখের কোল বেয়ে!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




