ঢাকা ইউনিভার্সিটির তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২২ আগস্ট রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে কেন এতো ভাংচুরের ঘটনা ঘটলো? সেদিন কেন নীরব ছিল প্রশাসন? ঘটনার দিন ক্যাম্পাসে প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের অনেকেই অনুপস্থিত ছিলেন কেন? প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন শিক্ষকদের ক্যাম্পাসে কেন দেখা যায়নি? ভিসি অফিসই-বা কেন নিষ্ক্রিয় ছিল? এসব প্রশ্ন এখন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সচেতন রাজশাহীবাসীর মুখে মুখে ফিরছে। এখন এসব প্রশ্নের লেজ ধরেই বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও সামনে হাটছে বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীরা জানায়, ঘটনার সময় ক্যাম্পাসে প্রশাসনের দায়িত্বশীল কোনো শিক্ষক-কর্মকর্তাকে দেখা যায়নি। প্রক্টরসহ তার টিমের সদস্যদের উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের নিবৃত্ত করার কোনো চেষ্টা চোখে পড়েনি। অতীতের মতো ভিসি-প্রোভিসিসহ প্রভাবশালী কোনো শিক্ষককেই ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি। জানা যায়, অতীতে ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন সঙ্কটকালে ভিসি সিনিয়র শিক্ষকদের তাৎক্ষণিক ডেকে পরামর্শ নিতেন, যা এবার ঘটেনি। অথচ এবারই সবচেয়ে বেশি প্রায় ৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে রাজশাহী ইউনিভার্সিটির।
প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানায়, ওইদিন ভিসিকে দায়িত্বশীল শিক্ষক-কর্মকর্তারা কোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করেননি, বরং তাকে মিসগাইড করা হয়েছে বিভিন্ন ভাবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শিক্ষক জানান, ঢাকা ইউনিভার্সিটির শামসুন্নাহার হলের ঘটনায় তৎকালীন ভিসি প্রফেসর আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী যেভাবে মিসগাইডেড হয়েছিলেন, ঠিক একই
ভাবে রাবিতে বিদ্যমান
বিভিন্ন পন্থী বিশেষ করে আওয়ামীপন্থী কিছু শিক্ষক-কর্মকর্তা বর্তমান প্রশাসনকে বেকায়দায় ফেলে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে চেয়েছিলেন। সূত্রটি আরো জানায়, ঢাবির তুচ্ছ ঘটনাটি পরে সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। কিন্তু রাবির আন্দোলনটি শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় ভিসি ও ইউনিভার্সিটি প্রশাসন বিরোধিতায়।
রাবি প্রশাসনের একটি নির্ভরযোগ্য ও একাধিক সিনিয়র শিক্ষকের সূত্রে জানা যায়, ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ট কমিশনে (ইউজিসি) চেয়ারম্যান হিসেবে ঢাবির আওয়ামীপন্থী শিক্ষক নেতা প্রফেসর নজরুল ইসলাম নিয়োগ পাওয়ার পরই দেশের সব ইউনিভার্সিটিতে শীর্ষ পদগুলোয় পরিবর্তন আসছে এমন ঢেউ তোলা হয়। রদবদল আনা হয় ইউজিসির মেম্বারদের মধ্যে। নতুন নিয়োগ পাওয়া এবং আগে থেকে থাকা মেম্বারদের অধিকাংশ নব নিযুক্ত চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক মতাদর্শের হওয়ায় কিছুদিন ধরেই প্রফেসর আবদুস সোবহানসহ আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী প্রভাবশালী (যারা প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের ব্যানারে থাকেন) সামনের সারির বেশ কয়জন শিক্ষক ঘন ঘন যাতায়াত শুরু করেন ইউজিসিতে। আর এ সময় থেকে রাবি ক্যাম্পাসে পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হয়, ভিসি পরিবর্তন হচ্ছে শিগগির।
সূত্র জানায়, ওইসব শিক্ষক মাঝে মধ্যেই প্রশাসন ভবন, জুবেরী ভবন ও ক্যাম্পাসের বাইরে পদ্মার ধারে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি ক্লাব বড়কুঠিতে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে মিটিংয়ে বসতেন। ঢাকা ইউনিভার্সিটির ঘটনার পরদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দীর্ঘ একটি মিটিং চলে প্রশাসন ভবনে ডেপুটি রেজিস্ট্রার (প্রশাসন) আমানুল হকের চেম্বারে। এ সময় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দফতরের দুজন কর্মকর্তা, অর্থ ও হিসাব দফতরের একজন উপ-হিসাব পরিচালক, একজন সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, একজন সহকারী হিসাব পরিচালক, সংস্থাপন শাখার একজন মহিলা সেকশন অফিসার, একজন উপ-রেজিস্ট্রার এবং প্রভাবশালী শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে ২২ আগস্ট রাবির ঘটনাটি এতোদূর গড়ানোর পেছনে ভিসিকে মিসগাইড করার বিষয়টিকে অন্যতম হিসেবে দেখা হচ্ছে। ভিসি অফিসে চাকরি করেন এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ অফিসার (যিনি ওই সময় ভিসির বাসভবনে উপস্থিত ছিলেন) নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ওই সময় ভিসিকে ইউনিভার্সিটি সিনেটের শাহাবুদ্দিন সরকার বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, এ মুহূর্তে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সহযোগিতা ছাড়া ক্যাম্পাসের উত্তপ্ত অবস্থা প্রশমিত করা সম্ভব নয়। তিনি নিজেই আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ভিসিকে বারবার মোবাইল ধরিয়ে সহযোগিতা চাইতে বাধ্য করেন। জানা যায়, ভিসির ফোন পেয়ে আওয়ামীপন্থী প্রভাবশালী শিক্ষক-কর্মকর্তারা ভিসির আবেদনে সাড়া না দিয়ে জুবেরী ভবনে মিটিং শুরু করেন। সূত্রটি জানায়, এর পর থেকে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকে। পুলিশের গুলিতে একজন রিকশাচালক নিহত হলেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয় ইউনিভার্সিটির একজন শিক্ষার্থী ও তাকে বহনকারী রিকশার চালক নিহত হয়েছে। রাবির মেডিকাল সেন্টার থেকে রিকশা চালকের লাশটি নিয়ে যখন বিক্ষোভ মিছিল ভিসির বাসভবনের দিকে আসছিল তখন জুবেরী ভবনে মিটিংরত শিক্ষকরা ভিসির সঙ্গে আলোচনার প্রহসন চালায়। তারা ভিসি ও প্রক্টরের পদত্যাগ এবং ক্যাম্পাস থেকে সব পুলিশ প্রত্যাহারের শর্তে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রশমিত করার প্রতিশ্রুতি দিলেও ইউনিভার্সিটি প্রশাসন ক্যাম্পাস থেকে পুলিশ প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়ার পরই প্রফেসর সোবহানের নেতৃত্বে ওইসব শিক্ষক ভিসির বাসভবন ত্যাগ করেন এবং এরপরই শুরু হয় দ্বিতীয় দফায় ভিসির বাংলো ভাংচুরের তা-ব, বাংলোর সামনে দাড়িয়ে থাকা ডিজিএফআইর গাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং তাদের শারীরিক নাজেহালের ঘটনা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ সময় রাবির কয়েকজন অফিসারকে ঘটনাস্থল প্যারিস রোডের আশপাশে ছোটাছুটি ও মোবাইলে যোগাযোগে করতে দেখা গেছে।
যায় যায় দিন - ৮ সেপ্টেম্বর ২০০৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




