somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলার ভূত-পেত্নী

১০ ই এপ্রিল, ২০০৯ রাত ৮:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[লোকগাঁথা, লোকজ বিশ্বাস অনুযায়ী]
ভূত-পেত্নী পরিচিতি
ভূত হলো অশরীরি পুরুষ আত্মা, আর পেত্নী অশরীরি মেয়ে আত্মা। অপঘাত, আত্মহত্যা প্রভৃতি কারণে মৃত্যুর পর মানুষের অতৃপ্ত আত্মা ভূত-পেত্নী হয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করতে পারে।

শাকচুন্নি: এটি একটি পেত্নী। অল্পবয়সী, বিবাহিত মেয়ে অপঘাতে মারা গেলে শাকচুন্নিতে পরিণত হতে পারে। শুভ্র কাপড় পরিহিত শাকচুন্নি মূলত জলাভূমির ধারে গাছে বাস করে এবং সুন্দর তরুণ দেখলে তাকে আকৃষ্ট করে ফাঁদে ফেলে। কখনো কখনো সে তরুণকে জলাভূমি থেকে মাছ ধরে দিতে বলে। কিন্তু সাবধান, শাকচুন্নিকে মাছ দেয়া মানে নিজের আত্মা তার হাতে সমর্পণ করা!

চোরাচুন্নি: দুষ্ট ভূত, কোনো চোর মারা গেলে চোরাচুন্নি হতে পারে। পূর্ণিমা রাতে এরা বের হয় এবং মানুষের বাড়িতে ঢুকে পড়ে অনিষ্ট সাধন করে। বাড়িতে এদের অনুপ্রবেশ ঠেকানোর জন্য গঙ্গাজলের ব্যবস্থা আছে।

মেছোভূত: মাছলোভী ভূত। বাজার থেকে কেউ মাছ কিনে গাঁয়ের রাস্তা দিয়ে ফিরলে এটি তার পিছু নেয় এবং নির্জন বাঁশঝাঁড়ে বা বিলের ধারে ভয় দেখিয়ে আক্রমণ করে মাছ ছিনিয়ে নেয়।

পেঁচাপেঁচি: দেখতে পেঁচার মত এবং জোড়া ভূত—একটি ছেলে, অন্যটি মেয়ে। গভীর জঙ্গলে মানুষ প্রবেশ করলে এরা পিছু নেয় এবং সুযোগ বুঝে তাকে মেরে ফেলে।

মামদো ভূত: হিন্দু বিশ্বাস মতে, এটি মুসলমান আত্মা।

ব্রহ্মদৈত্য: ব্রাহ্মণের আত্মা, সাদা ধুতি পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। এরা সাধারণত পবিত্র ভূত হিসেবে বিবেচিত। বলা হয়ে থাকে, কোনো ব্রাহ্মণ অপঘাতে মারা গেলে সে ব্রহ্মদৈত্য হয়। এছাড়া পৈতাবিহীন অবস্থায় কোনো ব্রাহ্মণ মারা গেলেও ব্রহ্মদৈত্য হতে পারে। এরা কারো প্রতি খুশি হয়ে আশির্বাদ করলে তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জিত হয়, কিন্তু কারো প্রতি নাখোশ হলে তার সমূহ বিপদ। দেবদারু গাছ কিংবা বাড়ির খোলা চত্বরে বাস করে।

স্কন্ধকাটা বা কন্ধকাটা: মাথাবিহীন ভূত। অত্যন্ত ভয়ংকর এই ভূত মানুষের উপস্থিতি টের পেলে তাকে মেরে ফেলে। কোনো দুর্ঘটনায়, যেমন রেলে কারো মাথা কাটা গেলে, সে স্কন্ধকাটা হতে পারে। ভয়ংকর হলেও, মাথা না থাকার কারণে স্কন্ধকাটাকে সহজেই বিভ্রান্ত করা যায়।

আলেয়া: জলাভূমির গ্যাসীয় ভূত। এরা জেলেদেরকে বিভ্রান্ত করে, জাল চুরি করে তাদের ডুবিয়ে মারে। কখনো কখনো অবশ্য এরা জেলেদেরকে সমূহ বিপদের ব্যাপারে সতর্ক করে থাকে।

নিশি: খুব ভয়ংকর ভূত। অন্যান্য ভূত সাধারণত নির্জন এলাকায় মানুষকে একা পেলে আক্রমণ করে, কিন্তু নিশি গভীর রাতে মানুষের নাম ধরে ডাকে। নিশির ডাকে সারা দিয়ে মানুষ সম্মোহিত হয়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে, আর কখনো ফিরে না। কিছু কিছু তান্ত্রিক অন্যের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নিশি পুষে থাকে।

কানাখোলা: গভীর নির্জন চরাচরে মানুষকে পেলে তার গন্তব্য ভুলিয়ে দিয়ে ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয় এই ভূত। মানুষটি তখন পথ হারিয়ে বার বার একই জায়গায় ফিরে আসে, এবং এক সময় ক্লান্ত হয়ে মারা যেতে পারে।

কাঁদরা-মা: অনেকটা নিশির মত এই ভূত গ্রামের পাশে জঙ্গলে বসে করুণ সুরে বিলাপ করতে থাকে। কান্নার সুর শুনে কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে গেলে তাকে ইনিয়ে বিনিয়ে গল্প বানিয়ে জঙ্গলের আরো গভীরে নিয়ে মেরে ফেলে। ছোট বাচ্চারা এর কান্নায় বেশি আকৃষ্ট হয়।

ভূত কোথায় থাকে: শেওড়া, তাল, দেবদারু, বেল, অশ্বত্থ প্রভৃতি গাছে একটি দুটি ভূতের দেখা পেতে পারেন। কিন্তু বেশি সংখ্যায় ভূত দর্শনের অভিলাষ থাকলে, আপনাকে যেতে হবে বিজন বনে, তেপান্তরে, কিংবা ভূষণ্ডির মাঠে।

ভূতের গল্প বলার উপযুক্ত সময়: কেউ অনুরোধ করলেই সাথে সাথে ভূতের গল্প বলতে বসে যাবেন না যেন। সব কিছুরই একটা তরিকা আছে। ভূতের গল্প বলতে হয় মজলিসে, আর গল্পের উপযুক্ত সময় হচ্ছে রাতের বেলা, বিশেষ করে বাদল ধারার রাতে। ঝমঝম বৃষ্টির ফোঁটা পড়বে টিনের চালে বা ছাদে, জানালা থাকবে হাট করে খোলা, হালকা বৃষ্টির ছাঁট আসবে ঘরে। তীব্র কোনো আলো রাখা চলবে না, কেবল একটু দূরে হারিকেন, কুপি বা মোমের মৃদু আলো মিটমিট করে জ্বলতে পারে।

ভূতের গল্পের বর্ণনা মাধ্যম: ভূতের গল্প উত্তম পুরুষে, অর্থাৎ নিজের জবানিতে বলাই ভালো, তাতে গল্পে অনুভূতির ব্যঞ্জনা তীব্র হয় এবং গা ছমছম ভাবটা প্রকট করা যায়। ভূতের গল্পে স্বভাবতই কাউকে না কাউকে ভূতের পাল্লায় পড়তে হবে, সেটি বর্ণনাকারী নিজেই হতে পারেন।

ভূতের গল্প একটানে বলতে নেই, কিছুটা ভয়ের জায়গায় এসে গল্প থামিয়ে দিয়ে সময় ক্ষেপণ করতে হবে, যাতে অন্যরা অনুরোধ করে গল্প চালিয়ে যেতে। যেমন বলা যায়, "বিজন জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ এক জায়গায় দেখলাম কী..! আচ্ছা, আজ থাক, ঘুম পাচ্ছে, বাকিটা আরেক দিন বলব।"

কিন্তু গল্পের যে অংশগুলি বেশি ভয়ের, বিশেষ করে চূড়ান্ত অংশ, সেখানে না থেমে খুব দ্রুত, জোরে জোরে হঠাৎ বলে ফেলতে হবে। যেমন: "...একথা শুনে লোকটা বলল, আচ্ছা, দেখেন তো এরকম কিনা [নরম স্বরে বলতে হবে] ঘুরতেই দেখি, লোকটার পায়ের কাপড় একটু উপরে, পায়ের পাতা উল্টানো [একটু জোরে], পায়ের আঙ্গুলে কোনো ফাঁক নেই [আরো জোরে], একদম হাঁসের পায়ের মত দেখতে [আরো জোরে বলতে হবে এবং এই দেখো, বলে হঠাৎ গল্পকার নিজের পা দেখিয়ে দেবেন]।

ভূত-পেত্নী ও রাজাকার: ভূত-পেত্নীর সাথে রাজাকারের কোনো তুলনা হয় না। এদের জন্মভূমির প্রতি প্রবল টান থাকে। এক দেশের সাথে অন্য দেশের ঝগড়া বেঁধে গেলে ভূতরাও নিজ নিজ দেশের অধিকারের জন্য অন্যদেশের ভূতের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ভূতরা মাতৃভূমির প্রতি বিশ্বাসঘাতক হয় না।

প্রেম-ভালবাসায় ভূত-পেত্নী: ভূত-পেত্নীর শারীরিক সৌন্দর্যের ব্যাপারে নানা মত চালু থাকলেও, প্রেম-ভালবাসায় তাদের নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততা বেশ সুবিদিত। তাই যুগ যুগ ধরে মানব প্রেমিক প্রেমিকা গভীর ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে পরস্পরকে পেত্নী, ভূত নামে আখ্যায়িত করে থাকে।

ভূত-পেত্নী দশার অবসান:
[ভূত-পেত্নী অতৃপ্ত আত্মা, পৃথিবীর মায়ায় ইত:স্তত ছুটে বেড়ায়। তাদের জীবন ক্লান্তিকর ভারবহ উদ্দেশ্যহীন, তাই কেউ ভূত-পেত্নীর আত্মা মুক্ত করলে তারা খুশি হয়। আত্মা মুক্ত করার একটি কার্যকর উপায় হলো গয়ায় গিয়ে ভূতের নামে পিণ্ডি দেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০০৯ রাত ৯:১৩
৫৯টি মন্তব্য ৫৩টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×