somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফারিনের গল্প (৪): আমি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা Cassandra, কেউ শোনে না আমার কথা

০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ১২:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[আমার মেয়ে ফারিন, তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। মাঝে মাঝে সে এমন অদ্ভুতসব কথা বলে যে সবাই অবাক হয়ে যায়। কয়েকদিন আগে তাকে একটা রূপকথার গল্প শুনিয়েছিলাম। তার পর দিন আমাকে বলে, "জানো বাবা, আমি না তোমার বলা সেই তেপান্তরের মাঠ, বিজন বন, আর ভূষণ্ডির কাক দেখে এসেছি!"
"তাই নাকি!" অবাক হওয়ার ভান করি আমি।
"আর পারুলকে না তার ভাইরা একটা দোলনা বানিয়ে দিয়েছে। সে এখন সারাদিন দোল খায়। সেখানে এখন বসন্তকাল, উত্তর থেকে হাওয়া আসে।"
"পারুলটা কে?"
"তুমি দেখি সব ভুলে যাও," ফারিন আমাকে মৃদু বকুনি দেয়, "পারুল হলো সাত ভাই চম্পার বোন।"

মেয়ের এইরকম কথা শুনে তার বাস্তববাদী মা শঙ্কিত হন, ক্ষোভ ঝাড়েন আমার উপর। কিন্তু যেহেতু ফারিন পরীক্ষায় ভাল করে, বাস্তববাদী মহিলাটি তাই আশ্বস্ত হন।

প্রতিদিন ঘুমাতে যাবার আগে ফারিন আমার গা ঘেঁষে বসে বেশ কিছুক্ষণ তার গল্প শোনায়। আজকের গল্পটা খুবই অদ্ভুত, আজকে দুপুরে একটা শব্দ (word) নাকি তার সাথে মানুষের মত কথা বলেছে। তার নাম Cassandra। আমি ফারিন ও Cassandra-র মধ্যকার কথোপকথন যতটুকু সম্ভব অবিকৃত ভাবে তুলে ধরছি।]

ফারিন: কী সুন্দর তুমি! তুমি কে? আর তোমাকে এত বিষণ্ণ দেখাচ্ছে কেন?
Cassandra: আমার নাম Cassandra, আমি এখন একটি ইংরেজি শব্দ। কিন্তু এক সময় আমি ছিলাম ট্রয় নগরীর রাজকন্যা, রাজা প্রায়াম ও রাণী হেকুবার মেয়ে। সবাই বলতো বোনদের মধ্যে আমি নাকি ছিলাম সবচেয়ে সুন্দর। দূর-দূরান্ত থেকে, সাগর জনপদ পেরিয়ে, মানুষ আসত আমাকে দেখতে।
ফারিন: তুমি অবশ্য এখনও সুন্দর, অনেক অনেক। তবে একটু বিষণ্ণ আর মনমরা।
Cassandra: [ম্লান হেসে] হয়তো বা! কিন্তু ফারিন, এই সৌন্দর্য আমার জন্য বয়ে আনেনি কোনো শান্তি, বরং কষ্টের দহনে পুড়িয়ে গেল সারাজীবন। এই সৌন্দর্যের কারণেই সূর্যদেব এপোলো প্রেমে পড়ে আমার। তখন কতই বা বয়স আমার, কৈশোরের উচ্ছলতাও কাটেনি। ভালোবেসে এপোলো আমাকে একটি ক্ষমতা দান করে— ভবিষ্যত বলতে পারব আমি।

ফারিন: কী মজা! ভবিষ্যতে কী হবে, আগেই জেনে যাওয়া!
Cassandra: সে সময় তাই মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন জানি আগে থেকে ভবিষ্যত দেখতে পাওয়া মোটেও আনন্দের কোনো ব্যাপার নয়। জীবনকে টিকিয়ে রাখার জন্য আশাবাদিতা বিশাল একটি ব্যাপার, ভবিষ্যত জেনে গেলে আশা মরে যায়। তখন বেঁচে থাকাটা বড় কষ্টের হয়ে উঠে।

যা হোক, ভবিষ্যত বাণীর ক্ষমতা দানের পর এপোলো আমাকে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু তুমি হয়তো জেনে থাকবে গ্রিক এই দেবতাগুলো কী অদ্ভুত হয়ে থাকে! সবই এদের সাময়িক মোহ, কাজেই আমি প্রত্যাখান করি এপোলোকে। আর তাই এপোলো প্রতিশোধ নেয় আমার উপর।

ফারিন: [শিউরে উঠে] কী ভয়ঙ্কর! কত দ্রুতই না বদলে গেল এপোলো।
Cassandra: হ্যাঁ, দ্রুত এবং অপ্রত্যাশিত। অভিশাপ দেয় এপোলো, আমি ভবিষ্যত বাণী করতে পারব ঠিকই, কিন্তু কেউ আর আমার কোনো কথা বিশ্বাস করবে না। আহ্‌, কী তীব্র যন্ত্রণার ব্যাপার ছিল সেটি!

তুমি জান স্পার্টার রাণী হেলেন পালিয়ে এসেছিল আমার ভাই প্যারিসের সাথে। প্যারিস যখন স্পার্টা যাচ্ছিল হেলেনের স্বামী মেনেলাউসের দরবারে, আমি সাবধান করেছিলাম তাকে, "যাস নে,প্যারিস, যাস নে স্পার্টা। তোর পেছন পেছন ধেয়ে আসবে ভ্য়ঙ্কর দাবানল এক, সাগরের জলরাশি বেয়ে। কল্পনাও করতে পারবি না কত বিশাল হবে তার অগ্নিশিখা।" আমার কথা শুনল না প্যারিস।

শীঘ্রই ট্রয়ের সাথে যুদ্ধ বেঁধে যায় গ্রিসের। আমি তখন ভয়ঙ্কর সব দৃশ্য দেখতে শুরু করলামঃ চারপাশে বইছে রক্তের নহর, স্তুপের পর স্তুপ মৃত মানুষের দেহ, হাঁটছে পিশাচ, উড়ছে শকুন, আর ভয়ঙ্কর ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়া মৃত এক শহর—আমার প্রিয় ট্রয়। পাগলের মতো ভবিষ্যত বাণী করতে লাগলাম আমি, কেউ বিশ্বাস করল না। বাবা, আমাকে প্রাসাদে বেঁধে রাখার চেষ্টা করল। [চোখ মুছে Cassandra]

ফারিন: ইসস, কী কষ্টই না পেয়েছ তুমি!
Cassandra: কষ্টের তখনো আরো বাকি ছিল। যুদ্ধে একের পর এক মারা পড়তে থাকল আমার প্রিয় মুখ। সবচেয়ে বড় কষ্টটা পেলাম যেদিন আমার বড় ভাই হেক্টর নিহত হয়। বড় করূণ ছিল তার মৃত্যু, আমার ভাইয়ের মৃতদেহ ঘোড়ার খুরে বেঁধে ট্রয়ের দেয়ালগুলি ঘুরেছে একিলিস, আস্ফালন করেছে নৃশংস উল্লাসে। প্যারিস খারাপ ছিল ঠিক, কিন্তু হেক্টর ছিল সত্যিকারের এক বীর, মহৎ হৃদয়ের মানুষ। একিলিস হয়তো যুদ্ধে জয় করেছে, কিন্তু সারা জীবন তাকে ঘৃণা করে যাব। না, না, আমার ভাইকে হত্যা করার জন্য নয়, ট্রয়ের মেয়েরা জানে যুদ্ধ কী ভয়ানক অশুভ জিনিস। কিন্তু সত্যিকারের বীর কখনো শত্রুর মৃতদেহকে অপমান করে না।

তারপর, ধীরে ধীরে ট্রয়ের বাতিগুলি যখন নিভে আসছে, তখন ট্রয়ের দূর্গের বাইরে একদিন দেখা গেল বিশাল এক কাঠের ঘোড়া। আমি সাথে সাথে বুঝতে পারলাম এটি হচ্ছে গ্রিকদের কূটকৌশল, ঘোড়ার পেটে লুকিয়ে আছে গ্রিক সৈন্য। সবাইকে সাবধান করে দিলাম আমি, "গ্রিকদের ব্যাপারে সতর্ক হও, এমনকি তারা যদি তোমার জন্য উপহারও নিয়ে আসে।" না, কেউ বিশ্বাস করল না আমার কথা। কাঠের ঘোড়াটিকে সবাই নিয়ে আসলো ভেতরে।


রাতের নিশীথে সেখান থেকে বেরিয়ে আসলো কিছু গ্রিক, খুলে দিল মূল ফটক। পঙ্গপালের মতো ঢুকল গ্রিক সৈন্যরা। তারপর মৃতদেহের পর মৃতদেহ, আসলো পিশাচের দল, উড়লো শকুনের পাল, আর ভয়ঙ্কর ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ল মৃত এক শহর, আমার প্রিয় ট্রয়।

আমি অবশ্য আরো কিছু দিন বেঁচে ছিলাম তারপর, অপমান আর যন্ত্রণা সইবার জন্য। ট্রয়ের পতনের পর ছোট আয়াক্স নামের এক গ্রিক সৈনিক আমাকে লাঞ্ছিত করে, তারপর সম্মিলিত গ্রিক বাহিনীর অধিনায়ক, মেনেলাউসের ভাই আগামেমননের কাছে দিয়ে দেয়।

আগামেমন আমাকে নিজের রাজ্য মাইসিনিয়া নিয়ে আসে, কিন্তু আমি জানতাম আমাদের ভাগ্যে চূড়ান্ত কী পরিণতি অপেক্ষা করছে। মাইসিনিয়া পৌঁছা মাত্র আগামেমননের অসৎ স্ত্রী ক্লাইটেমনেস্ট্রা খুন করে আমাদের। আমার শেষ ভবিষ্যৎ বাণী ছিল নিজেরই করূণ পরিণতির ব্যাপারে: "...আমার জন্য অপেক্ষা করছে ধ্বংস, এমন এক তরবারিতে যার দু'পাশই ধারালো।" [চুপ করে Cassandra। তারপর মুখ খোলে আবার, ম্লান হেসে ]

আমি অবশ্য মরিনি একেবারে, দেখতে পাচ্ছ, বেঁচে আছি ইংরেজি এই Cassandra শব্দের ভেতর, যার মানে
১। one whose true words are ignored
২। one who predicts misfortune or disaster,
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ১:১৮
৩৪টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×