
ছোট বেলা থেকেই, অভাবের তাড়নায় অনেক কিছু না পেয়ে বড় হওয়া মানুষ আমি। তবে সব পরিস্থিতিতেই দুইটা অবস্থা বিরাজ করে। সুখ এবং দুঃখ। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এই মনে করেন, ভালো খাবার, পোশাক, খুব কমই জুটতো। বাবার আর্থিক অবস্থা যেমন ছিলো, আমাদের চলাফেরাও ও তেমন ছিলো। নিম্নবিত্ত পরিবারে যা হয় আরকি।
এবার আসি মূল ঘটনায়। তখন ক্লাস ফাইভ এ পড়ি। আমাদের এক বিত্তবান আত্মীয়ের বাড়িতে ঘন ঘন যেতাম যেন তারা ভালো কিছু খাওয়ার সময় আমাকেও কিছু দেয়। মার অবশ্য এসব ভীষণ অপছন্দ ছিল। আমি সেটা আমলে নিতাম না। আমার খাওয়া হলেই হতো।
তা সেদিন ছিলো পহেলা বৈশাখ। সকাল থেকেই আমি তাদের বাড়িতে ঘুরঘুর করছি। হটাৎ তাদের বড় কর্তার নজরে এলাম। ডাক দিলো আমায়। ভাবলাম, আজ তবে খেতে পারবো ভালোমতো। একটা কাগজ ধরিয়ে দিলো হাতে। বললো, এটা নিয়ে সুমনের দোকানে যা। বলবি, খালু পাঠিয়েছে। আমি সেটা নিয়ে ভোঁ দৌড় দিলাম আমার দুইপায়ের হুন্ডা নিয়ে। দোকানে গিয়ে লিস্ট টা দিলাম আর বললাম মামা ,খালু পাঠিয়েছে। সে লিস্ট টা নিয়ে আমায় দুইটা চকোলেট দিয়ে বললো একটা ছোট মামুনিকে দিবি আর একটা বড় মামুনিকে। আর যদি তুই খেয়ে ফেলিস, তবে তোর খবর আছে। এখন বাড়ি থেকে বড় চটের ব্যাগ নিয়ে আয়। আবার দৌড়ে এসে খালাকে বললাম ব্যাগ দাও আর চকোলেট গুলো দুই রাজরানীর হাতে দিলাম। তারা চকোলেট গুলো নিয়ে আমায় বললো , তুই তো চকোলেট খাস না তাইনা ? বলেই সজোরে হেসে উঠলো। ব্যাগ নিয়ে আবার দোকানে গেলাম। দোকানদার এতক্ষনে সব সদাইপাতি গুছিয়ে ফেলেছে। ব্যাগ হাতে নিয়েই সব ভোরে ফেলল ভেতরে । প্রায় সাত থেকে আট কেজি হবে সব মিলিয়ে। ব্যাগ টা মাথায় নেওয়ার আগে বললাম, ''মামা আমাক একটা চকোলেট দিবা? ট্যাকা পরে দিয়ে দিমু আব্বুর থেকে লিয়ে।'' সে বললো, তোর বাপ্ কোনোদিন চকোলেট কিনসে ? শালা ফকির, যা ভাগ। বলে তার পানি খাওয়ার গ্লাস থেকে কিছু পানি আমার গায়ে ছিটিয়ে দিয়ে ব্যাগ টা মাথায় তুলে দিয়ে বললো দূর হ। ওরে কিছু অস্বাভাবিক গালি দিয়ে দৌড়ে চলে এলাম। ব্যাগ টা বাড়ির উঠোনে রাখতেই খালা দৌড়ে এসে বললো এতো সময় লাগে কেরে ? তোরে পাঠানোই ভুল হইছে। বললাম , সুমন মামা দেরি করছে। আর কেউ আমার দিকে ফিরে তাকালো না। আমি উঠোনেই কিছু মাটির খোলা নিয়ে খেলতে থাকলাম।
শুরু হলো রান্না বান্নার আয়োজন। মা এসে কয়েকবার ডেকে গেলো নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য। গেলাম না। ঘাড়কাত করে সেখানেই খেলতে লাগলাম।
ইলিশ মাছ ভাজা হচ্ছে । ওই বয়সে জীবনে সর্বোচ্চ্য পাঁচ কি ছয়বার খেয়েছিলাম মনে হয়। সাথে পোলাও, মুরগির রোস্ট , কাবাব, আর পান্তা তো আছেই।
দুপুর প্রায় হয়েই এলো। মা এসে জোরাজুরি করে বাড়িতে নিয়ে গেলো। গোছল করে দিলো , গায়ে গলায় পাউডার লাগিয়ে দিল। ভাত খেতে দিলো ছোট মাছের চচ্চড়ি আর ড্যাল দিয়ে। হটাৎ বলে বসলাম , মা আজ খালা ওদের ওখানে খেতে বলছে। মা বললো , সত্যিতো ? আমিও বললাম ,হ সত্যি কচ্ছি। আজ সকালে আমাক দিয়ে দোকান থেকে সদাই নিয়ে আসিছে, আর তখন কৈছে এখানে আজ দুপুরে খাস। মা ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে ঈদের নতুন পাঞ্জাবিটা বের করে পরে দিলো। নিজে হাতে ধরে মাথার চুল আঁচড়ে দিলে বললো, যা আর কারো সাথে কোনো শয়তানি যেন করিস না। আমি দিলাম জোরসে দৌড় যেন ওদের খাওয়া শেষ না হয়ে যায়।
যেয়ে দেখি ওরা খেতে বসে গেছে। আমি কুত্তার মত দরজার সামনে দাঁড়ালাম। খালা বললো, এই জগ টা নিয়ে কলেরপাড় থেকে পানি নিয়ে আয় তো। বিন্দু মাত্র দেরি না করে দৌড় দিয়ে এক জগ পানি নিয়ে এসে দিলাম। সবাই খাওয়াই ব্যস্ত।
কর্তা মানে আমার শ্রদ্ধেয় খালু বললো , কিরে আজ কি দিয়ে খাইছিস দুপুরে। বললাম খাইনি এখনো , খামু একটু পরে, আব্বু আসলে। খালা বললো , তোর মা কি দিয়ে রান্দিছে ? বললাম ছোট মাছের চচ্চড়ি আর ডাল। খালা বললো, সারাজীবন তোর মা এইডাই খাওয়ালো , আর কিছু চোখেত পরে না। তোর পায়ে ময়লা অনেক। যা বাড়িতে যেয়ে ধুয়ে নে। আমিও অভিমান নিয়ে বললাম , হ , খালি এগলায় খিলাই আমার মাও ''। আর কিছু চোখেত পরে না। ''
ফিরে আসছিলাম ,তখন খালা ডাক দিলো আবার ,ঝড়ের গতিতে ফিরে তাকালাম। বললো বিকেলে একবার আসিস , তোরে দিয়ে ডাব পারামু।
আচ্ছা , বলে চলে গেলাম খেলার মাঠে। সেদিন মাঠটা ও অনেক পর পর মনে হচ্ছিলো। মা আজো জানে সেদিন আমি খেয়েছিলাম তাদের ঘরে ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৪:৪৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



