somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাবলুর ঈদ

৩১ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছবি: নেট
''মা ঈদের কাপড় লিয়ে দিবানা ?
হামার কিন্তু এই ইদোত জিঞ্চের স্কিম প্যান (স্কিন প্যান্ট, একসময়ের জনপ্রিয় চাপা জিন্স প্যান্ট)
লাগবি। কিছু দাও আর না দাও প্যান হ্যামি নিমুই। হামার বন্দুরা সবাই লিছে।'' দুপুরে এভাবেই নিজের মায়ের কাছে বায়না ধরে আবদার করছে বাবলু ঈদের কাপড়ের জন্য। মা কিছু বলে না ,শুধু বলে ''তোর আব্বু আসুক তারপর কইস "।
আজ রোজার ২৫ দিন চলে। বাবলুর বাবা একজন বাসের হেলপার,কয়েকদিন আগে একসিডেন্ট করে পায়ে মারাত্মক ব্যথা পেয়েছে। তাই আর বাসে ডিউটি করতে পারছেননা। বয়স বড়োজোর ৪২ হবে,নিজের বাড়িঘর বলতে কিছুই নেই। শহরের এককোনে একটা বাড়িতে একরুম ভাড়া নিয়ে থাকে। বাবলুরা তিন ভাইবোন। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে আর বাবলু সবার ছোট,ওর মেজো বোনের নাম রুপাই। বাবলু পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে,আর রুপাই অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে।
বাবলুর বাবা যখন সুস্থ্য ছিলেন তখন রোজার শুরুতে প্রত্যেকদিন বিশ টাকা করে দিতেন বাবলু আর রুপাইকে,কচকচে দুইটা নোট। বাবলুর মা দুইজনকে দুইটা মাটির ব্যাংক কিনে দিয়েছিলেন টাকা গুলো জমানোর জন্য। প্রতিবার রোজার শুরুতেই মাটির ব্যাংক নিয়ে এসে তারা বাবার দেওয়া টাকা সেখানে জমা করে। রোজার ২৬ থেকে ২৭ দিনে তারা ব্যাংক ভেঙে টাকা গুলো বের করে মাকে দেয়। সেখানে আরো কিছু টাকা যোগ করে দুই ভাইবোনের ঈদের মার্কেট করে দেয় বাবলুর বাবা।
বাবলুরা হতদরিদ্র হলেও কখনও কারো থেকে চাওয়ার অভ্যাস নেই। বাবলুর মা একজন সৎ চরিত্রা এবং ভদ্র মহিলা। বাবলুর বাবা এক্সিডেন্টের পর থেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেটে প্রতিদিন সকালে বাস টার্মিনালে যেয়ে ঘুরাঘুরি করেন যদি কোনোভাবে কিছু টাকা পয়সা পাওয়া যায়। এই গাড়ি সেই গাড়ির কিছু পরিচিত স্টাফরা হয়তো দুই চার টাকা করে হাতে ধরায়ে দিয়ে বলে ''চা বিড়ি খাইয়ো মিয়া ''। বাবলুর বাবা নেয় সেই টাকা। সংসার চালানোর মতো না হইলেও যা পায় তাই মঙ্গল। মচকানো পা নিয়ে ইফতারের আগেই বাড়ি ফিরে আসে, দিন শেষে হয়তো ৮০ -৯০ টাকা পায় , কখনো ১০০ টাকা। যেই বাড়িতে ভাড়া থাকে সেখানে আরো কিছু পরিবার ভাড়া থাকে। ইফতারের সময় বাবলুদের ঘরে ইফতার পাঠায় , সেখানে সবচেয়ে বেশি থাকে মুড়ি। অন্যান্য খাবার যেমন খেজুর, জিলাপি, এগুলো কেউ দেয়না বললেই চলে।
বাবলুর মা ভাত রান্না করেন,সাথে হয়তো কিছু শাক আর ডাল থাকে। পেট পুরে খায় তারা সেগুলো দিয়েই।
এবারের চিত্র ভিন্ন। বাবলুর স্কুল ছুটি হয়ে গেছে ঈদের জন্য। ওর স্কুলের সহপাঠীরা সবাই যার যার ঈদের কেনাকাটার কথা বাবলুর কাছে বলেছে। বেশিরভাগই শহরের নিউ মার্কেট থেকে জিন্স প্যান্ট নিয়েছে সাথে শার্ট আর বুট জুতো। তারা বাবলুকে জিজ্ঞেস করেছে বাবলু কি নিয়েছে ? বাবলু বলেছে, পরে ওর আব্বু ওকে কিনে দেবে। এগারো রোজার দিন বাবলুর বাবা একসিডেন্ট করেন এরপর থেকে আর তাদের দুই ভাইবোনকে আর ২০ টাকা করে দেয় না ব্যাংকে ফালানোর জন্য। বাবলুর মা কি থেকে কি রান্না করে খাওয়াবেন তা নিয়েই চিন্তা করে শেষ হয়ে যায় , কাপড়ের চিন্তা তো মাথায়ই আসে না। নিজের কাছে জমানো যে কয়েকটি টাকা ছিল তা সযত্নে রেখে দিয়েছে স্বামীর হাতে দেবে ছেলেমেয়েদের ঈদের কাপড় কেনার জন্য। তবে বিষয় হচ্ছে তার জমানো টাকার পরিমান মাত্র ৩৮০ টাকা। এই টাকাই তিনি দুই মাসে জমিয়েছে। আর কিছু ছিল সেটা বাবলুর বাবার চিকিৎসার সময় খরচ করে ফেলেছেন।
আজ ২৮ রোজা। বাবলু আর কিছুই মানছে আজকে তার ঈদের কাপড় লাগবেই আজকে।
ইফতারের পর বাবলুর মা তার জমানো ৩৮০ টাকা বাবার হাতে দিয়ে বললো '' তুমি যদি পারো তাইলে এর মদদে আরো কিছু ট্যাকা ভরে ছোলপোলের কাপড় আর জুতা কিনে দেও। ওরকেরেক হ্যামি আর বুঝাবার পরিচ্ছিনা। ''
বাবলুর বাবা নিরুপায় , কি করবে ভেবে পায়না। ছেলেমেয়ে দুটোর দিকে তাকালে সহ্য করতে পারে না কিছুই। একবার ভাবে চুরি করবে আবার ভাবে তা ঠিক নয়। বিপদের দিনে কেউ ধারও দিবে না টাকা পয়সা। নিজের ওষুধ খাওয়াও ছেড়ে দিয়েছেন অভাবের তাড়নায়। বাড়ির ভাড়া বাকি। অনেক বুঝে বলেছেন ঈদের পরে ভাড়া দিবেন। বাড়ির মালিক রাজি হয়েছে তাতে।
যাই হোক তার বাসের মালিক যিনি ছিলেন তাকে কল করলেন এবং নিজের অভাবের কথা বললেন। মালিক বললেন , সন্ধ্যার পর তার কাছে যেতে , যা পারে দিবে আর কি। মালিকের কোথায় আসস্ত হয়ে বাবলুর মাকে বললেন " মালিকে যাবার কছে , হয়তো ট্যাকা পয়সা কিছু দিবি। বাবলুর মা শুনে খুব এ খুশি হলো , আর বাবলুকে বললো " আজক্যা তোকেরক মার্কেটত লিয়ে যাবি আব্বু। " এই কথা শুনে বাবলু আর রুপাই লাফ দিয়ে হইইইই করে চিৎকার করে উঠলো। তাদের খুশির অন্ত নেয় মনে হয় আর।
সন্ধ্যার পর বাবলুর বাবা বাড়ি থেকে বের হলেন মালিকের বাড়ির দিকে যাওয়ার জন্য। এক সময় খুঁড়ে খুঁড়ে হেটে গেলেন মালিকের বাড়ির সামনে। যেয়ে দরজায় টোকা দিলেন দুইবার। ভেতর থেকে বাসার কাজের লোক এসে বললেন কাকে খোঁজেন ? বাবলুর বাবা বললেন ,
-''হামার নাম বাদল, মালিকের গাড়ীত ডিউটি করিচ্চিনু। মালিক আসপের কৈছিলো। ''
- ওহ , আচ্ছা। সাহেব তো নাই , মার্কেট গেছে। তুমি না হয় পরে একসময় আসো। মোবাইল বাড়িতে থুয়ে গেছে কল দিয়ে পাব না।
- ওহ , হ্যামি তালে ওই সামনে চায়ের দুকানোত বসে আছি। মালিক আসলে হামাক কল দিবার কইয়েন।
- আচ্ছা , তুমি এই দিকেই থাকো , হ্যামি তুমাক কল দিবার কমুনি।
-আচ্ছা।
বাদল সামনের চায়ের দোকানে যেয়ে বসে। তার পায়ের ব্যথাটা বাড়ে আস্তেক্স আস্তে। ডাক্তার বলেছিলো এক্স রে করে দেখতে , বাদল করে নি।
দুই ঘন্টা পরেও কোনো কল না আসায় বাদল আবার মালিকের বাড়ির সামনে যায় , রাত তখন এগারোটা। দরজায় টোকা দিতেই কাজের লোক বের হয়ে এসে বললো ;
-তোমার কথা সাহেবকে বলার সাহস এ পাইনি। মার্কেট থেকে এসে সাহেবের মেজাজ খারাপ অনেক। ছেলে মেয়েকে কাপড় কিনে দিছে ,বাড়িতে এসে কয় কারো নাকি কিছু পছন্দ হয়নি। এল্লা লিয়ে ঝগড়া লাগিছে খালাম্মার সাথে। এর মধ্যে তোমার কথা কেমনে কই সাদা বুজাচ্ছিনা। তুমি আজকে চলে যাও , দেখি কালকে কোবার পারি কিনা।
কাল মাথা ঠান্ডা হলে হয়তো কওয়া যাবি।
-হ্যামি কি একবার কল দিমু মালিকেক ? হামার ছোলপোল গুল্যান অপেক্কা করে আছে ঈদের কাপড়ের জন্যে। আজক্যা মালিক কিছু ট্যাকা পয়সা দিলে ওরকেরেক কাপড় কিনা দিনুনি ''
- দিয়া দেখো , কম হয় কিনা।
এরপর বাদল কল দিলো মালিকের নাম্বারে। মালিক কল রিসিভ করলো।
- ভাই , হ্যামি বাদল।
-হ , বাদল কহ, কি হছে ?
- ভাই , আপ্নে আসপের কৈছিলেন।
- ওহ , হ্যামি ভুলেই গেছিলাম।
বাদল বলতে নিয়েছে যে সে তার বাড়ির সামনেই আছে এখনো তার আগেই মালিক বললো ,
- জাকাতের ট্যাকা তো হামার ই এক আত্মীয়ক দিয়ে দিছি , তোর কথা মনেই নাই। এই বছর আর ট্যাকা পয়সা নাই। তুই অন্য কোথাও দ্যাখ।
তারপর বাদল কিছু বলার আগেই ফোনের লাইন কেটে গেলো। বাদলের মাথা বনবন করে ঘুরছিলো , বুক ফেটে আসা চাপা কান্না আর আটকে রাখতে পারলোনা বাদল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো বাদল। কেউ দেখলোনা সে কান্না। রাস্তা ধরে এগুতে লাগলো সামনে , তবে গন্তব্য অজানা। হঠাৎ একটা প্রকান্ড কাভার্ড ভ্যান এসে পেছন থেকে ধাক্কা দিলো বাদলকে। দোষটা বাদলের কারণ সে মাঝরাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলো। মাঝ রাস্তায় বাদলের লাশ টা পরে ছিল অনেক অভিমানে। বাবলু তখনও জানে তার বাবা আজ মার্কেট নিয়ে যাবে তাদেরকে। বাবলুর ঘুম আসছে না কিছুতেই।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:১২
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শোকের উচ্চারণ।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১৬

নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যা হচ্ছে বা হলো তা কি উপকারে লাগলো?

লিখেছেন রানার ব্লগ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:২৮

৫ হাজার মৃত্যু গুজব ছড়াচ্ছে কারা?

মানুষ মারা গিয়েছে বলা ভুল হবে হত্যা করা হয়েছে। করলো কারা? দেশে এখন দুই পক্ষ! একে অপর কে দোষ দিচ্ছে! কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।

লিখেছেন নয়া পাঠক, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৬

এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:০৭



আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×