'দ্যা প্রিন্স অব ফিজিশিয়ানস' নামে পশ্চিমা বিশ্বে যিনি সুপরিচিত, যার অমর গ্রন্থ 'আল কানুন ফিততিব' চিকিৎসা শাস্ত্রের মূল অপ্রতিদ্বন্দ্বী পাঠ্য পুস্তক হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছিল প্রায় পাঁচ শতকেরও বেশি সময় ধরে, যিনি হলিস্টিক মেডিসিনের প্রনেতা যেখানে একই সংগে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক যোগসূত্রকে বিবেচনায় রেখে রোগীর চিকিৎসা করা হয়, য়ুগ-যুগান্তের অদ্বিতীয় সেই ব্যক্তিত্বের স্মরণে আমাদের আজকের কিছু কথা।
মানবেতিহাসের এই অত্যাশ্চর্যই সর্বপ্রথম ছোঁয়াচে রোগের ধারনা দেন এবং যক্ষ্মাকে ছোঁয়াচে রোগ বলে অভিমত দেন যা তার পরের পশ্চিমা চিকিৎসকবৃন্দ প্রত্যাখ্যান করেন এবং যা আরো পরে সঠিক বলে প্রমানিত হয়। তিনিই প্রথম মানব চক্ষুর সঠিক এনাটমি করেন। মেনিনজাইটিসকে তিনিই প্রথম ব্যাখা করেন। প্রকৃত পক্ষে তিনিই আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক। তার মাইলস্টোন পুস্তক 'আল কানুন' আঠারশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত পৃথিবীতে চিকিৎসা শাস্ত্রের টেক্সট বুক হিসেবে গন্য হত। তিনি যে শুধু চিকিৎসা শাস্ত্রেই অবদান রেখেছেন তা নয়, বরং এস্ট্রোনমি সহ আরো অনেক অনেক শাখায় তার গুরুত্বপুর্ন অবদান রয়েছে। তিনি মোমেন্টামকে ওজন ও বেগের গুনফলের সমানুপাতিক বলে অভিমত দেন এবং এজন্য তাকে 'দ্যা ফাদার অব ফান্ডামেন্টাল কনসেপ্ট অব মোমেন্টাম' হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি শুক্র গ্রহকে পৃথিবীর চেয়ে সূর্যের অধিকতর নিকটে অবস্থিত বলে নির্নয় করেন। তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ চাদের একটি ফাটলের নাম তার নামে করা হয়েছে।
৯৮০ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান উজবেকিস্তানের আফশানা নামক একটি সমৃদ্ধ গ্রামে আবু আলী আল হুসাইন এর পুত্র তৎকালীন খোরাসানের গভর্ণর আব্দুল্লাহ এর ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই চিকিৎসাবিজ্ঞানী
'ইবনে সিনা'
তার প্রকৃত নাম 'আবু আলী আশ্শাইখ আররাইস ইবনে সিনা'। শৈশব থেকেই ইবনে সিনা ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি পবিত্র কোরআনে হাফিজ হন। পাশাপাশি তিনজন গৃহ শিক্ষকের কাছে ধর্মতত্ত্ব, ফিকাহ্, তাফসীর, গণিত শাস্ত্র, দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, জ্যামিতি প্রভৃতি বিষয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। সতেরো বছর বয়সে তিনি তখনকার দিনে প্রচলিত প্রায় সকল জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন এবং ‘হাকিম' বা প্রজ্ঞাবান উপাধিতে ভূষিত হন।
অতপর আঠারো বছর বয়সে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে মনোভিনিবেশ করেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই একজন বিখ্যাত চিকিৎসক হিসেবে সুপরিচিত হয়ে পড়েন। তৎকালিন বোখারার বাদশাহ নূব বিন মানসুর একটি কঠিন রোগে আক্রান্ত হলে বিভিন্ন নামি চিকিৎসকরাও তার চিকিৎসা প্রদানে ক্রমাগত ব্যর্থ হতে থাকে এবং অবশেষে বাদশাহ ইবনে সিনার স্মরনাপন্ন হন। ইবনে সিনার দক্ষ চিকিৎসায় মাত্র কয়েকদিনেই বাদশাহ আরোগ্য লাভ করেন। এতে সন্তুষ্ট হয়ে তিনি সিনাকে জিজ্ঞেস করলেন- আপনি কি পেলে খুশী হবেন? সিনা প্রত্যুত্তর করলেন- আমি আপনার লাইব্রেরীর বইগুলো পড়ার সুযোগ পেলেই খুশী হবো। বাদশাহ তা-ই করলেন ৷ইবনে সিনা লাইব্রেরীতে পড়ার সুযোগ পেয়ে রীতিমত অধ্যয়ন শুরু করলেন এবং লাইব্রেরীর সকল বই মুখস্থ করে ফেললেন। মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে তিনি বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিত, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, খোদাতত্ত্ব, চিকিৎসা বিজ্ঞান, কাব্য ও সাহিত্য বিষয়ে অসামান্য পান্ডিত্য অর্জন করেন। একুশ বছর বয়সে তিনি 'আল মুজমুয়া' নামে একটি বিশ্বকোষ রচনা করেন। এতে শুধু গণিত ছাড়া জগৎ ও জীবনের প্রায় সকল বিষয়কেই অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
পিতা আব্দুল্লাহর মৃত্যুর পর ইবনে সিনা সকলের অনুরোধে খোরাসানের শাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু গজনীর সুলতান মাহমুদ খোরাসান দখল করলে সিনা খোরাসান ত্যাগ করে খাওয়ারিজমে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরে তুস, নিশাপুর, গুরগাঁও, কাজভীন ও শেষে হামাদান শহরে যান এবং বাদশাহ শামস-উদ-দৌলার মন্ত্রীপদ গ্রহন করেন। হামাদানেই ইবনে সিনা তার বিখ্যাত গ্রন্থ আশ-শিফা ও আল কানুন রচনা শুরু করেন। বাদশাহ শামস-উদ-দৌলার মৃত্যুর পর ইবনে সিনা ইস্ফাহানে গমন করেন এবং আশ-শিফা ও আল কানুনের অসমাপ্ত লেখা সম্পন্ন করেন। ইস্ফাহানে অবস্থানরত অবস্থায় সিনা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পরলে হামাদানে প্রত্যাবর্তন করেন এবং তার কিছুদিন পরই ১০৩৭ সালে পৃথিবী ত্যাগ করেন।
ইবনে সিনার আল কানুন গ্রন্থটি তৎকালীন বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। পাঁচটি বিশাল খন্ডে বিভক্ত গ্রন্থটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ৪ লাখেরও বেশী। সে যুগে এতবড় গ্রন্থ আর কেউই রচনা করতে পারেনি। বইটিতে ৭৬০টি জটিল রোগের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়। সম্ভবত এসব কারণেই পশ্চিমা পন্ডিত ড. উইলিয়াম ওসলের ‘আল কানুন' কে 'মেডিকেলের বাইবেল' বলে উদ্ধৃত করেন।
ইবনে সিনা ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তিনি নিয়মিত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তেন এবং কোন বিষয় বুঝতে না পারলে দু'রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেন। কান্নাকাটি করে বলতেন- 'হে আল্লাহ! তুমি আমার জ্ঞানের দরজা খুলে দাও'। কান্নাকাটির পর তিনি যখন ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তেন তখন স্বপ্নের মধ্যে অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো তার মনের পর্দায় ভেসে উঠতো। তার জ্ঞানের দরজা খুলে যেত। ঘুম থেকে ওঠে তিনি সমস্যার সমাধান করে ফেলতেন।
১০৩৭ সালে হামাদানে মৃত্যুবরণ করেন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





