somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প- সূর্য রেখা

১৯ শে জুন, ২০২৫ দুপুর ১২:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে প্রায় একশত পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে একটি জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা হলো কুড়ি নামক গ্রামটি। দোলাখা জেলার কালিনচোকে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় চার হাজার মিটার উচ্চতায় অবস্থিত কুড়ি গ্রাম। হিমালয় পর্বতমালার মনোমুগ্ধকর ল্যান্ডস্কেপ ও চমত্কার প্যানোরামিক দৃশ্য দেখতে পর্যটকরা সেখানে ভিড় করেন বছর জুড়ে। সেই পর্বতে দাঁড়িয়ে অনামিকা সূর্যের শেষে রাখাটাও আকাশে দেখতে পেলনা। সূর্যের আলো তখন বিলুপ্তি হয়ে গেছে। চারপাশ অন্ধকার হতে শুরু করেছে, সন্ধ্যা নামার তোড়জোড় চলছে, তখন নিজেকে বড় একলা মনে হলো অনামিকার।
নাহ ! এবার নিচে নামা দরকার নিচে বান্ধবীরা অপেক্ষা করছে। এখন ফিরে না গেলে কোন বিপদে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিদেশের মাটিতে তার উপর এমন পাহাড়ি এলাকায় বিপদে পড়লে সাহায্য পাওয়া মুশকিল হবে।
পাহাড়ি লতা গুলম, ঝোপঝাড় পেরিয়ে দ্রুত নিচের দিকে নামছে অনামিকা । অনেকটা পথ নেমে এসেছে তারপর একটা অজানা শব্দে ভয় পেয়ে কেপে উঠল সে। আরও দ্রুত নামতে গিয়ে পা পিছলে সে পড়ে যাচ্ছিল হঠাৎই অপরিচিত একটি হাত অনামিকার পতন রোধ করে।
নিচের দিকে তাকেয়ে মাথা ঘুরে উঠল তার পড়ে গেলে নির্ঘাত মুত্যু হতো। ভাবতেই ভয়ের একটা স্রোত শীরদাড়া দিয়ে নিচের দিকে নেমে গেল। বুকের ভিতরটা টিপডিপ করছে এখনও। চোখ বন্দ করে স্বস্তির একটা নিশ্বাস নিল অনামিকা তারপর চোখ খুলে দেখে অপরিচিত এক যুবক তার হাত ধরে রেখেছে।
‘পাহাড়ে অন্ধকারে দ্রুত চলতে নেই’ কথাটা বলেই যুবক অনামিকার হাত ছেড়ে চলে যাচ্ছে। যুবকের কন্ঠে শিস বাজছে। আস্তে আস্তে ছেলেটি অনামিকার দৃষ্টি থেকে যেন মুছে গেল সে নিজেও নিরাপদে নিচে নেমে এলো।
অনামিকার খুব ইচ্ছা ছিল নামটা জানতে এমন ফেরেশতার মত কোথা থেকে লোকটি এসে তাকে বাঁচিয়ে চলে গেল। কিন্তু কিছুতেই তখন গলা দিয়ে কথা নামলো না। তখন ভয়ে আতংকে কোন কিছুই মাথায় আসছিলনা।
ইস নামটাও জানা হলো না । বাঙালি নাকি অবাঙালি তাও বুঝা গেল না। তারপর নিজের মনে হাসতে লাগলো অনামিকা এই ভেবে যে, যার নাম জানা হলো না, কোন পরিচয় জানা হলো না সে বাঙালি নাকি অবাঙালি এটা জেনে কি হবে ?
অনামিকা নিজে ফিরতেই অন্য বন্ধুরা বেশি শঙ্কিত কন্ঠে বলল, উফ তোর জন্য বেশ চিন্তা হচ্ছিল । চল চল তাড়াতাড়ি হোটেলে চল কাল তো আবার আমরা লো মানথাং যাচ্ছি।
অনামিকার নেপাল ভ্রমণ হতো না যদি বান্ধবী য্যোথি না থাকতো। য্যোথি ফোন করে অনামিকার বাবা মাকে রাজি করিয়েছে। অনামিকা যদি এখন না আসতে পারে তবে ভবিষ্যতে সে ডাক্তার হয়ে গেলে ব্যস্ততা আরও বাড়বে তখন ইচ্ছে করলেও এই বিদেশে ভ্রমণ শখ পূরণ করতে পারবেনা।
আর য্যোথি যেহেতু নেপালে স্বামীর সাথে থাকে সেক্ষেত্রে সে অনামিকাদের সহজেই দেখ ভাল করতে পারবে। মূলত য্যোথির উপর ভরশা করেই অনামিকাকে তার বাবা মা পাঠিয়েছে। এখন অনামিকার যদি কিছু হয়ে যায় এর দায়ভার য্যোথি এড়াতে পারবেনা তাই তার উৎকন্ডা অন্য বান্ধবীদের তুলনায় অনামিকার জন্য বেশি।
বান্ধবীরা অবশ্য সবাই মিলে য্যোথির বাসায় উঠেনি বিদেশ ঘুরতে এসে বাসাবাড়িতে থাকার কোন মানে হয়না। হোটলে উঠলে একটা অন্য রকম ভাব থাকে। য্যোথি অবশ্য দাওয়াত করে বান্ধবীদের খাওয়াচ্ছে হরদম।
অনামিকাদের অবশ্য লো মানথাং যাওয়ার পরিকল্পনা ছিলনা। য্যোথি তাদের বুঝিয়েছে- লো মানথাং হলো নেপালের একটি প্রাচীর ঘেরা শহর। যা চার হাজার মিটার উচ্চতায় উত্তর মধ্য নেপালের মুস্তাংয়ে অবস্থিত। এই প্রাচীন রাজধানীতে এখনো মুস্তাংয়ের শেষ রাজার বাড়িটি আছে। পনের শতকে নির্মিত প্রাচীরঘেরা এই শহরের মধ্যে একটি মঠও আছে। এতে অমূল্য প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ও বুদ্ধের মূর্তি আছে। কাগবেনির উত্তরে অবস্থিত আপার মুস্তাং ভ্রমণের জন্য বিদেশিদের অনুমতির প্রয়োজন হয়।
লো মানথাং ভ্রমণের সব ব্যবস্থা য্যোথি করে রেখেছে। অনামিকা অবশ্য একটু আপত্তি তুলল। আর একটা দিন কি এখানে থাকা যায় না ।
অন্যরা বলল, নারে তাহলে পুরো নেপাল ভ্রমণ তো আমাদের হবে না ।আর তাছাড়া শেষের দিকে তুই মাউন্ট এভারেস্টের কাছাকাছি যাবি বলেছিলি সেটাও তো হবে না।
তুই না বলতি ইতিহাসের পাতায় তুই যখন মাউন্ট এভারেস্ট বিজয় নিয়ে লেখা পড়তি তোর চোখের সামনে এভারেস্ট যেন ভেসে উঠতো ।শেরপারা কিভাবে পাহাড়ে উঠছে সেই দৃশ্য কল্পনায় দেখতে পেতি।
এখন এখানে যদি সময় নষ্ট করিস তাহলে এভারেস্ট দেখা হবেনা।
অনামিকা বলল, আসলে আমি একটা কারণেই নেপালি এসেছি এভারেস্টকে কাছ থেকে দেখবো বলে। দেখা যাক স্বপ্ন সত্যি হয় কিনা।
এদিকে রোহানও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে মাউন্ট এভারেস্ট না দেখে যাবে না। গতকালের মেয়েটাকে এক নজর দেখে তার ভালই লেগেছে। কে জানে এই মেয়ের সাথে আর কখনো দেখা হয় কিনা ? জীবন বড় বিচিত্র কখন কোথায় কার সাথে দেখা হয়ে যায় বলা মুশকিল।
নেপালের স্থানীয় বাজার থেকে বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন সবার জন্য কিছু না কিছু গিফট কিনছে রোহান। একটা প্রদীপ তার বেশ পছন্দ হলো। প্রদীপটার দাম একটু বেশি তবুও সে এটা নিয়ে নিল কিন্তু কারো জন্য নিল সেটা সে জানে না।
পরদিন সকালে নাস্তা করে প্রদীপটা হাতের তালুতে রেখে বারান্দায় যেতেই প্রদীপের গায়ে সূর্য আলো পড়তেই এক অদ্ভুত সৌন্দর্যের সৃষ্টি হলো। মুগ্ধ হয়ে রোহান তাকিয়ে আছে প্রদীপের দিকে।
প্রদীপের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে হঠাৎই তার মনে হল একটি নারীর কথা। সম্ভবত সৌন্দর্য-র সাথে নারীর একটি যোগসূত্র রয়েছে।
একটি মায়াবী মুখের কথা, একটি বিপদগ্রস্ত মুখের কথা, আতঙ্কিত একজোড়া চোখের কথা তারপর লজ্জা মিশ্রিত রক্তিম আভার একটি মুখ ভেসে উঠল তার মানসপটে। কার মুখ এটি?
রোহান চোখ বন্ধ করে একের পর এক ভেবে চলেছে এটি কার মুখ। না কারো মুখের সাথেই মিলানো যাচ্ছে না । তারপর তার সমস্ত সত্তা জুড়ে, ইন্দ্রিয় জুড়ে যেন একটা প্রশ্নই বারবার ধ্বনিত হচ্ছে কার মুখ ? কার মুখ ? এটা কার মুখ !
তখন সে তার অন্তরের চোখে দেখতে পেল সূর্য রেখায় ভেসে উঠেছে গতকাল যে মেয়েটিকে বাঁচিয়েছে সেই মেয়েটির অবয়ব।
চোখ খুলে রোহান আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগলো কি অদ্ভুত যাকে চিনি না, জানি না যার সাথে পরিচয় হয়নি তার মুখ কেন ভেসে উঠলো?
তবে কি................না রোহান আর ভাবতে চায়না।
লো মানথাং পৌছে গেল অনামিকারা। প্রাচীন এই শহরের আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় চার হাজার মিটার উচ্চতা উত্তর মধ্য নেপালের মস্তানে অবস্থিত এখানে সবকিছু দেখে সবাই বিনীত হলো, মুগ্ধ হলো। জুই, য্যোথি,সাঞ্জানা আর অনামিকা সবাই মিলে ছবি তুলল।
এতকিছুর মধ্যেও অনামিকা কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে ? কি সেটা? রোহান নাকি অন্য কিছু ? নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু একটা, যা অনামিকা ছাড়া আর কেউ জানে না । গতকাল যে ছেলেটি তাকে প্রাণে বাঁচিয়েছে অবচেতন মন তাকেই খুঁজছে।
হঠাৎ অনামিকা স্থির হলো কি করছে সে ? ছেলেটা এখানে কোত্থেকে আসবে? আর সে তো জানেনা যে আজ অনামিকারা লো মানথাং এসেছে। আশ্চর্য মানুষের মন। আরও বেশি আশ্চর্য তার পাগলামি। তা না হলে অনামিকা কেন রোহানকে খুঁজবে!
নেপাল থেকে দেশে ফেরার আগে মাউন্ট এভারেস্টের কাছাকাছি গেলো অনামিকাদের দলটি। পর্বত এত সুন্দর হতে পারে ! এত মায়াময় হতে পারে এতদিনে জানতে পারল অনামিকা। এভারেস্টের প্রেমে পড়ে গেল অনামিকা। আহা ! কি সুন্দর, কি প্রশান্তিসময় অনুভূতি।
হঠাৎই ভিড়ের মধ্য থেকে সেই শীষ শুনতে পেল অনামিকা ।তার চোখ জোড়া তৎপর হলো জনে জনে খুঁজে ফিরছে সেই মুখ একদা যে তাকে বাঁচিয়েছে। তারপর হঠাৎ সে পেয়ে গেল তারা কাঙ্খিত মানুষটিকে।
এবার রোহানের মুখোমুখি দাঁড়ালো অনামিকা বলল, সেদিন উপকার করে হুট করেই চলে গেলেন । না জানা হলো আপনার নাম ধাম। না দিতে পারলাম একটা ধন্যবাদ।
রোহান বলল, এসবের কি দরকার বলুন তো। আর পরিচয় হয়েই বা লাভ কি ? আপনিও চলে যাবেন আমিও চলে যাব যার যার গন্তব্যে। আর হয়তো কোনদিন দেখা হবে না কিংবা দেখা হলেও বা লাভ কি?
-ওসব লাভ-লস ভেবে তো কিছু করা যাবে না । মানুষের পরিচয়টাতো থাকা ভালো। আপনি আমার উপকার করেছেন কে জানে একদিন হয়তো আমিও আপনার উপকার করতে পারি।
অনামিকার কথা শুনে রোহান বলল, আচ্ছা ঠিক আছে আমি আমার প্রকৃত নাম বলবো না আপনি আপনার প্রকৃত নাম বলবেন না । আপনি চোখ বন্ধ করুন। চোখ বন্ধ করে যে জিনিসটা আপনি ফিল করতে পারবেন সেই জিনিসটার নামই হবে আমার নাম এবং আমিও চোখ বন্ধ করে প্রথম যে জিনিসটা ফিল করব সেটাই হবে আপনার নাম। এই নতুন নামে আমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হব।
রোহানের কথা শুনে অনামিকা তার দিকে চেয়ে আছে আর মনে মনে ভাবছে এত বেশ মজার লোক । এরকম নতুনভাবে কেউ কারো সাথে পরিচয় হয় বলে অনামিকার জানা নেই।
ফিক করে সে হেসে দিল বলল, এগুলো তো বাচ্চাদের খেলা।
রোহান বলল, হোক বাচ্চাদের খেলা ।আমি আপনি কিংবা আমরা একটা সময় সেই বাচ্চা বয়সে ফিরে যেতে চাই । যেখানে অনাবিল আনন্দ ছিল। ভাবনা ছিলনা, যাতনা ছিলনা । চাওয়া পাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিলনা। সহজ জলের স্রোতের মতই জীবন ছিল নির্ভেজাল।
রোহানের কথা শেষ হতেই অনামিকা বলল, আচ্ছা ঠিক আছে আমি চোখ বন্ধ করছি । সে চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো তখনই প্রখর সূর্যের কথা তার মনে হলো। সে চোখ খুলে বলল, সূর্য। আপনার নাম আজ থেকে হবে সূর্য।
রোহান মৃদু হেসে বলল, বাহ বেশ চমৎকার একটা নাম দিলেন তো। সূর্য সুন্দর একটি নাম। সত্যি সূর্যের আলো যেমন আলোকিত করে রাখে পৃথিবী তেমনি আমার সূর্য কারো মনের ভিতর প্রবেশ করলে সেটা আবার হয়ে যাবে অন্যরকম।
অনামিকা বলল, এবার আপনি চোখ বন্ধ করে আমার নাম বলুন।
রোহান চোখ বন্ধ করলো সে তার মনের চোখে দেখতে পেল দিগন্ত জুড়ে শুধু সূর্য রেখা ।তখন সে চোখ খুলে বলল, আজ থেকে আপনি রেখা। তাহলে আমাদের নাম দাঁড়ালো সূর্যরেখা। আমি আর আপনি মিলে সূর্যরেখা।
অনামিকা বলল, ওয়াও ! দারুন একটা নাম হয়েছে তো সূর্যরেখা! এবার বলুন বাংলাদেশে গেলে কোথায় আপনার সাথে দেখা হবে।
রোহান বলল, আমাদের দেখার পর্বটাও হবে অন্যরকম। আপনি এমন একটা নাম বলেন, যে নামটা আমি চিনি না, জানি না। সে নামের সূত্র ধরে একদিন আপনার সাথে দেখা হবে।
অনামিকা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না । সে অনেক ভেবেচিন্তে নিজের গ্রামের নামটাই বললো- লাজৈর।
রোহান বলল, বাহ! বেশ সুন্দর একটা নাম তো লাজৈর। মনে হচ্ছে ফরাসি কোন শান্ত সুনিবির এলাকার কোন এক ক্যাফেটেরিয়া মধ্য আমি আপনি বসে আছি। বিদায় বেলায় রোহান সেই প্রদীপটা অনামিকাকে উপহার স্বরূপ দিল।
তারপর নেপাল ভ্রমণ শেষ হলো। বান্ধবী য্যোথি নেপালেই থাকে তার স্বামী ওখানে ব্যবসা করে। কলেজে ক্লাসে সবাই য্যোথিকে নেপালি নেপালি বলে খেপাতো। কারণ তাকে দেখতে অনেক অনেক নেপালী মেয়েদের মতই মনে হতো ।নাকটা ছিল চ্যাপ্টা, গায়ের রং শ্যামলা। এখন তাই সবাই বলে সত্যি তোর নামের সার্থক হয়েছে তুই এখন সত্যি সত্যি নেপালি হয়ে গেছিস।
য্যোথি বলে তা যা বলেছিস। নেপাল দেশটা যেভাবে তোরা আমাকে দলিল করে নামের সাথে দিয়েছিলি সেটাই আমি আপন করে নিয়েছি ।এখন নেপাল আমার ধ্যান জ্ঞ্যান। নেপাল আমার বসবাস।
অনামিকা বাড়িতে ফিরে এসেছে ঢাকায় তার পড়াশোনা শেষ হয়েছে আগেই। তার জীবনের স্বপ্ন ছিল ডাক্তারি শেষ করে সে নিজের গ্রামে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা।
লাজৈর গ্রামে সত্যি সত্যি একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে তাক লাগিয়ে দিলো অনামিকার ও তার পরিবার।
গ্রামের মানুষ এখন অনামিকাদের বাড়িটিকে বলে ডাক্তার বাড়ি। দিনে দিনে হাসপাতালটিতে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে ।মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে যায় এর সুখ্যাতি। শহর থেকে ডাক্তার এসে এখানে বসেন, চিকিৎসা দেন। সাধারণ মানুষকে এখন আর চিকিৎসার জন্য শহরে ছুটতে হয় না।
এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। সারাদিন পরিশ্রম করে হাসপাতাল নিয়ে পরে থাকে অনামিকা। যখনই নিজের চেম্বারে টেবিলের সামনে রাখা রোহানের দেওয়া সেই প্রদীপ টার দিকে তাকায় তখনই তার মনে হয় রোহান নামের ছেলেটা যদি তার জীবনে আসত তবে মনে হয় সুখ আর শান্তির দুকুলের দেখা পেতো।
নেপাল থেকে দেশে আসার পর দুটি বছর গড়িয়ে গেল কই রোহনের কোন দেখা নেই ? আবার অনামিকার কাছে ঢাকার এমন কোন ঠিকানা নেই যে ঢাকাতে গেলে তাকে খুঁজছে বের করা যাবে। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে রোহান কি তাকে মনে রেখেছে। নাকি ভুলে গেছে ? এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই তাই অনামিকার অপেক্ষার প্রহর গোনা ছাড়া আর কোন গতি নেই।
রোহান ঢাকায় ফেরার পর নিজের চাকরি-বাকরি নিয়ে বেশ ব্যস্ত এর মধ্যে একদিন তার বন্ধু ও কলিগ রাকিব বলল, চলো আমার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লাতে বেড়াতে যাবে। রোহান যাব যাব করে আর সময় করে উঠতে পারে না । অবশেষে শীতকালের এক বন্ধের দিন রোহান আর তার বন্ধু রাকিব মুরাদনগর উপজেলার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
যাওয়ার আগে রোহানের মা বলল, আমার মনটা কেমন যেন করছে ? তোর কি না গেলেই না। তুই দেশ বিদেশ কত জায়গায় ঘুরে বেড়াস, কখন কোন দুর্ঘটনা ঘটে বলা যায় না একটু সাবধানে থাকিস বাবা।
-মা তুমি যে কি বলনা সাধারণ বিষয় নিয়ে সারাক্ষণ টেনশন করো ।আমি কি এখনো ছোট্ট বাবু আছি। বড় হয়েছি, আমি আমার নিজের খেয়াল রাখতে জানি। তোমাকে কোন টেনশন করতে হবে না।
রোহানের মা সাজিয়া বেগম বলেন- আরে বোকা, মায়ের মন তো আর এটা মানে না যে, ছেলে ইয়া বড় হয়ে গেছে। মায়ের কাছে ছেলে চিরকালই ছোট, আদরের, ভালোবাসার জিনিস।
শোনো মা আমি কিন্তু ফিরে এসে তোমার হাতের চালতার আচার খাব তুমি আমার জন্য চালতার আচার বানিয়ে রাখবে ।
-সে আমি করে রাখবো। তুই সাবধানে থাকিস।
মুরাদনগর উপজেলা পৌঁছার আগেই রাকিবের বাইক এক্সিডেন্ট হয়। একটা প্রাইভেট কারের সাথে লেগে বাইক থেকে ছিটকে পরে দুই বন্ধু বেশ আহত হয়। স্থানীয় জনগণ দুজনকেই লাজৈর গ্রামের সূর্যরেখা হাসপাতালে ভর্তি করে।
রোহান মাথায় আঘাত পাওয়ায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞান ফেরার পর রোহান দেখে নেপালে দেখা সেই মেয়েটি যাকে সে নাম দিয়েছিল রেখা, সে তার সামনে বসে আছে। ডাক্তার হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করছে।
রেখা বলল, তো সূর্য এতদিন পরে সেই তো এলে তবে অ্যাক্সিডেন্ট করে। যাক একদিন তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলে আজ আমিও তার প্রতিদান দিতে পারলাম।
রাকিব রোহানকে বলে ডাক্তার অনামিকাকে তুমি কিভাবে চিন ? রোহান সবকিছু খুলে বলে বন্ধুকে। সব শুনে রাকিব বলে বাহ ! কি সুন্দর ঘটনা সাজিয়েছে তোমরা দুজনে যেন কোন গল্প উপন্যাসের কাহিনী।
সুস্থ হওয়ার পর রাকিবের সাথে রোহান লাজৈর গ্রামটি ঘুরে দেখে এবং হাসপাতালের সবকিছু দেখেশুনে বলে এর নাম কেন সূর্যরেখা হাসপাতাল রাখলে ?
রেখা বলে, সূর্যের আলো যদি কারো মনে ঢুকে যায় তখন হয়ে যায় অন্যরকম। সেই অন্য রকমের বহিঃপ্রকাশী এটা। মনে আছে তুমি একদিন একথাটা আমাকে বলেছিলে।
রোমান মাথা নেড়ে জানায় তার মনে আছে।
সবশেষে অনামিকা রাকিব আর রোহানকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায় এবং একদিনের জন্য অতিথি হতে বলে।
অনামিকার বাবা শাহিন সাহেব দুর্ঘটনার সবকিছু জানতে পেরেন। অনামিকার জন্য রাকিবকে পছন্দ করেন। রাকিব দেখতে শুনতে বেশ স্মার্ট এবং তাদের পাশের এলাকার ছেলে। তাই পাত্র হিসেবে রাকিবকে বেশ পছন্দ হয়েছে।
অনামিকা বাবার তার পছন্দের কথা অনামিকাকে জানাতেই সে বলল, বাবা আমারও কিন্তু নিজস্ব একটা পছন্দ আছে। মতামত আছে।
অনামিকার বাবা বলল হ্যাঁ তা তো অবশ্যই। তোমার পছন্দ অপছন্দ থাকতেই পারে কিন্তু তুমি তো কখনো কোনদিন বলনি যে তোমার পছন্দের কেউ আছে।
বলিনি কারণ আমি আমার মনের মানুষটিকে খুঁজে পাইনি কিন্তু যখন খুঁজে পেয়েছি তখন তার ঠিকানা আমার কাছে ছিল না কিন্তু এখন যখন ঠিকানা আমার কাছে আছে তখন অন্য কাউকে আমার জন্য পছন্দ করা হয়েছে যেটা আমি মেনে নিতে পারব না বাবা।
শাহিন সাহেব বললেন, তাহলে কি রোহানকে তোমার পছন্দ। রোহান-ই কি তোমার সেই মনের মানুষ ? তারপর অনামিকা তার বাবাকে নেপালের সেই কাহিনীটা শোনালো ।সবকিছু শুনে অনামিকার বাবা বললেন, বেশ ভালো। আমি রোহান সম্পর্কে খোঁজ খবর নেব এবং ঢাকা গিয়ে তোমার জন্য ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে বলব।
রোহান বাড়িতে ফেরার পর তার মা বলল, দেখেছিস মায়ের মন বলে কথা। সাবধানে না থাকলে যে কোন সময় যে কোন কিছু ঘটে যেতে পারে।
রোহান বলল ঠিক আছে মা । কিন্তু তোমার কথা শুনে আমি যদি মুরাদনগর না যেতাম তাহলে সূর্যরেখা হাসপাতাল সম্পর্কে আমি জানতাম না ।জানতাম না রেখা সেখানে থাকে যাকে সূর্য প্রতিদিন খুঁজে ফিরে।
ছেলের কথা শুনে রোহানের মা রেখাকে দেখতে চায়। তারপর এভাবেই রেখার সাথে সূর্যর শুরু হয় প্রেম নামক অধ্যায় । শুরু হয় ভালোবাসার লেনাদেনা ।তারপর একদিন প্রেম থেকে প্রণয়ে গড়ায় সম্পর্ক। রোহান আর অনামিকা এক হয়ে যায় বিয়ে নামন বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
এভাবেই সূর্যরেখা আপন ভূবনে পাশাপাশি থাকে চিরকাল।


ছবি-নিজের তোলা।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০২৫ দুপুর ১২:১৩
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেসবুক বিপ্লবে সেভেন সিস্টার্স দখল—গুগল ম্যাপ আপডেট বাকি

লিখেছেন মহিউদ্দিন হায়দার, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৩০




কিছু তথাকথিত “বাংলাদেশি বিপ্লবী” নাকি ঘোষণা দিয়েছে—ভারতের সেভেন সিস্টার্স বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে! সহযোগী হিসেবে থাকবে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী আর পাকিস্তানি স্বপ্ন।শুনে মনে হয়—ট্যাংক আসবে ইনবক্সে। ড্রোন নামবে লাইভ কমেন্টে। আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গু এনালিস্ট কাম ইন্টারন্যাশনাল সাংবাদিক জুলকার নায়েরের মাস্টারক্লাস অবজারবেশন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২৬

বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থীদের দম আছে বলতে হয়! নির্বাচন ঠেকানোর প্রকল্পের গতি কিছুটা পিছিয়ে পড়তেই নতুন টার্গেট শনাক্ত করতে দেরি করেনি তারা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ঘিরে নতুন কর্মসূচি সাজাতে শুরু করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×