গল্পটা ঠিক এক বছর আগের লেখা। বিজয় দিবস উপলক্ষে লিখেছিলাম।তবে গল্পটা শুরু করাটা সহজ ছিল। কিন্তু শেষ করাটা কঠিন ছিল।তাই কোনোমতে শেষ করে দিয়েছিলাম।কারণ এই লেখা গুলো লিখতে হলে অনেক জানতে হয় যা আমার জানা নেই।
১.
কাচা-পাকা একটা রাস্তার ধারে ছোট্ট খাল তার উপর নড়বড়ে বাঁশের সাকোটা পার হলেই একটা সরু কাচা রাস্তা। তার দুপাশে সারি সারি তাল গাছের ধানি জমি। এসব পেরুলেই ছোট্ট সুন্দরপুর গ্রাম। নামের মত গ্রামটাও সুন্দর। জোছনা রাত, চারদিকে সুনসান নীরবতা। আজকাল বোধ হয় খুব তাড়াতাড়ি রাত নামে এ গ্রামে। অবশ্য হবারই কথা। দেশের যা পরিস্থিতি তাতে শীত কালের রাতের মত এ গ্রামের নিরীহ মানুষ গুলোর মত সারা দেশের মানুষের জীবনে খুব তাড়াতাড়ি রাত নেমে এসেছে। প্রতিটি রাত আসার পর তারা অপেক্ষায় থাকে ভোরের আলোর জন্য। ভোরের আলো ঠিকই ফুটে কিন্তু তাদের জীবনের আলো এখনো ফুটেনি। তাদের প্রতিটি মুহূর্তে কাটাতে হয় এই আলো-অন্ধকারের সাথে যুদ্ধ করে।
২.
উঠোন পেরিয়ে ছোট্ট কুড়ে ঘরে স্ত্রী আর মেয়ে নিয়ে থাকেন গরিব কৃষক করিম মিয়া। সন্ধ্যা নামলেই ঘরের দরজা-জানালা আটকে বসে থাকেন। তেমনি এক সন্ধ্যায় হঠাৎ তাদের দরজায় মৃদু টোকা শুনতে পায়। শব্দ শুনে সবাই ভয়ে জড়সড় হয়ে নিশ্চুপ হয়ে যায় আর একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। এভাবে কয়েকবার অবিরাম ঠোকার শব্দ হওয়ায় করিম মিয়া দরজা খুলতে গেলে তার স্ত্রী শাহানা বেগম বাধা দেন পেছন থেকে। স্ত্রীর বাধা উপেক্ষা করে করিম মিয়া দরজার সামনে গিয়ে জানতে চান,”কেডা?”
ও পাশ থকে একটা পুরুষ কণ্ঠ কাতর স্বরে জবাব দেয়,”আমি মুক্তিযোদ্ধা বাবলু। একটু আশ্রয় চাই। দয়া করে আমাকে এই রাতটা এখানে থাকতে দিন।”
নিজেদের বিপদের আশংকায় করিম মিয়া সাথে সাথে বলে উঠলেন,” না না। এইখানে কাউরে জায়গা দেওন যাইব না। আপনে যান গা।”
তারপরও ওপাশ থকে কাতর স্বরে পুরুষ কণ্ঠটি অনুরোধ করে যেতে লাগল। এবার শাহানা বেগম করিম মিয়াকে বলল,”দেন না। মুক্তিযোদ্ধাই তো। হেরা তো আমাগো লাইগাই যুদ্ধ করতাসে। একটা রাইতই তো।”
স্ত্রীর অনুরোধে খানিকটা দ্বিধায় পড়ে দরজাটা খুলে মুক্তিযোদ্ধাটাকে ভিতরে ঢুকতে দিলেন। একটা হাফ হাতা শার্টে আর একটা ফুল প্যান্ট পরা, বয়স ২২ কি ২৩ হবে। ঘরে ধুকেই বাবলু পানি খেতে চাইল। শাহানা বেগম আস্তে আস্তে ডাকতে লাগলেন,” কাজল,ও কাজল। এক গেলাস পানি আনত মা।”
পাশের ঘর থকে সালোয়ার-কামিজ পরা ১৬-১৭ বছরের একটা মেয়ে মাথায় কাপড় দিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসে। পানির গ্লাসটা হাতে নিতেই কুপির আলোতে কাজলের মুখটা দেখতে পেল বাবলু। একটা অদ্ভুত মায়ায় ভরা চোখ দুটোতে। চোখে চোখ পরতেই কাজল মুখ তা নিচু করে সরে গেল। পানিটা এক চুমুকেই শেষ করে ফেলল বাবলু। হঠাৎ কাজল চেঁচিয়ে উঠল,”আম্মা, রক্ত। উনার হাতে রক্ত।”
সবাই বাবলুর হাতের দিকে তাকাল। ঠিকই তো বাম হাতের কনুই এর উপর থকে ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে। দৌড়ে গিয়ে কাজল একটা কাপড় নিয়ে এসে রক্ত ঝরার জায়গায় বেধে দিল পরম যত্নে। তীব্র যন্ত্রণা করলেও কাজলের চোখের দিকে তাকাতেই সব ব্যথা যেন দূর হয়ে গেল। একটা অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে গেল বাবলুর মনটা।
৩.
মাঝ রাতে দরজায় আবারো অবিরাম জোড়ে জোড়ে কারা যেন কড়া নাড়তে শুরু করল। ভয় পেয়ে সবাই চুপ মেরে গেল। তারপর করিম মিয়া জিজ্ঞেস করলেন,”কেডা?” ওপাশ থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে একটা পুরুষ কণ্ঠ বলে উঠল,”করিম ভাই,আমি মতি। দরজা খোল।”
করিম মিয়া আবার জানতে চাইলেন,”এত রাইতে কি দরকার?” হঠাৎ একটা দজ্জাল পুরুষ কণ্ঠ চেঁচিয়ে উঠল,”আবে,শালা খোল। নেহি তো আগ লাগা দেঙ্গে।”
এই কথা শুনে সবাই আরো ভয় পেয়ে গেল। এইবার বাবলু দরজা খুলতে গেলে শাহানা বেগম তাকে বাধা দিলেন। চুপি চুপি বললেন,”বাজান,তুমি যাইও না। ওরা তোমারে মাইরা ফালাইব।” এই প্রথম নিজের মায়ের কথা বাবলুর মনে পড়ল। কতদিন সে তার মাকে দেখে না। কোথায় আছেন? কেমন আছেন তাও সে জানে না। ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মায়ের জন্য। শাহানা বেগম তাড়াতাড়ি করে বাবলুকে একটা মাটির বড় মটকায় লুকিয়ে ফেললেন। তারপর করিম মিয়া দরজা খুলতেই দেখলেন তাদের এ গ্রামের সদ্য রাজাকার মতি মিয়া আর ৪জন জাঁদরেল চ্যাহারার পাকসেনা। অতি কষ্টে তাদের জিজ্ঞেস করল,”কি হইসে?”
মতি মিয়া তখন জিজ্ঞেস করল,”এই বাড়িতে মুক্তি ঢুকছে?”করিম মিয়া সাথে সাথে জবাব দিলেন,”না না কোনো মুক্তি ডুকে নাই।”“শালা, ঝুট বলতা হে। মার দো শালে কো।” বলেই একটা পাকসেনা করিম মিয়াকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে এলো। কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কয়েটা গুলি ছুঁড়ল করিম মিয়ার বুকে। সাথে সাথে করিম মিয়া দেহটা নিস্তেজ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। ঘর থেকে শাহানা বেগম “আল্লাহ গো”, বলে ছুটে এলেন করিম মিয়ার নিস্তেজ শরীরটার কাছে। তাকেও গুলি করে মারল পাক সেনারা।
মতি মিয়া একটা ক্রুর হাসি হেসে দুজন পাকসেনা কে চোখ দিয়ে ইশারা করল ঘরের ভিতর যাওয়ার জন্য। চোখের সামনে বাবা-মার মৃত্যু দেখে কাজল কি করবে না করবে ভেবে পেল না। ঘর থকে বের হতে উদ্যত হতে গিয়ে দেখল দুজন পাক সেনা ঘরে ঢুকছে। কাজল তাদের কাছে কাঁদতে কাঁদতে অনুরোধ করল,”আমারে ছাইরা দেন। আল্লাহ’র দোহাই লাগে,আমারে যাইতে দেন।” কাজলের এ কথা শুনে খুব মজা পেয়েছে এমনভাবে পাকসেনা গুলো হাসতে শুরু করল। এবার কাজল মতি মিয়াকে ডাকতে শুরু করল,”চাচা,ও মতি চাচা। উনাগরে কন না আমারে ছাইরা দিতে।”
মতি মিয়া তখনো একটা হাসি দিয়ে বলল, “দিব মা,দিব। উনাগো কাম শেষ হইলেই ছাইরা দিব। তুমি চিন্তা কইরো না।” খুব মজার একটা কথা বলেছে এমন একটা ভাব করে বাকি পাকসেনাদের সাথে দাঁত বের করে হাসতে লাগল। কিছুক্ষণ পর একটা বীভৎস চিৎকার শুনতে পেল ওরা। তারপর নীরবতা, আবার সেই চিৎকার। তারপরে আবার নীরবতা। শুধু মাঝে মধ্যে চাপা কান্না যা দ্রুতই থেমে যায়। কয়েক মিনিট পরে সেনা দুজনে বেরিয়ে আসে।
তাদের পরনের ইউনিফর্ম এলোমেলো। সঙ্গীদের প্রতি দাঁত বের করে হাসল আর বলল, “বারে মাজা আয়া. তুম ভি লেলো।” তারপর বাকি দুজন কেউ ইশারা করল ভেতরে জাওয়ার জন্য। এভাবেই কাজলের উপর নির্মম অত্যাচার শেষে চলে গেল ওরা। সাথে সাথে মটকা থকে বের হয়ে এলো বাবলু। এতক্ষণ যা ঘটসে তার কান দুটো একমাত্র সাক্ষী। এসে দেখল মাটির উপর অচেতন আর রক্তাক্ত অবস্থায় পরে আছে কাজল। মুক্তিযোদ্ধা হয়েও কিছু করতে পারল না সে। তার জন্য সে মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল। পানি এনে কাজলের চোখে-মুখে চিটাতে লাগল আর “কাজল,কাজল”, বলে ডাকতে লাগল।
৪.
অনেকক্ষণ পর কাজলের জ্ঞান ফিরতেই দেখল ভোর হয়ে গেছে আর নিজেকে আবিষ্কার করল বাবলুর কোলে। সাথে সাথে সে উঠে পড়ল। বাবলু কিছু বলতে যাবে অমনি কাজল আর্তনাদ করে উঠল,” ওরা আমার আব্বা-আম্মারে মাইরা ফেলছে। আমারে কেন মারল না? আমি মইরা যামু।” বলেই হাত দুটো দিয়ে নিজের মুখ ডাকল। বাবলু কাজলের কাছে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,”কেঁদো না। আমি কথা দিচ্ছি আমি এদের ছাড়ব না। অদের এই অত্যাচারের প্রতিশোধ নেবই নেব।”
যেন খুব আপন কাউকে পেল কাজল। কি যেন ভেবে বাবলু কে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। এ অবস্থায় বাবলুর মনের মধ্যে সাহস আর প্রতিশোধের আগুন অনেকখানি বেড়ে গেল। দুদিনের মাঝে আহত বাবলুর সেবা করে সারিয়ে তুলল কাজল। নিজেকেও অনেকটা সামলে নিলো।আবারো যুদ্ধে ফিরে যাওয়ার আগে কাজল আবার প্রতিশোধ এর কথা মনে করিয়ে দিল। বিদায় নেওয়ার সময় বাবলু কাজলকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা,আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি কি আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবে?”কাজল তার মায়ায় ভরা চোখ দুটি বাবলুর চোখে রেখে বলল, “পারুম। আমারে পারতেই হইব।” এই মুহূর্তে নিজেকে দুনিয়ার সব থেকে সুখী মানুষ বলে মনে হল বাবলুর। “কাজল,আমি ফিরে আসব। অপেক্ষায় থেকো। ভাল থেকো।” বলেই কাজলের মায়ায় ভরা চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে বিদায় নিলো।বাবলুর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে নিঃস্ব একাকী কাজল তার অপেক্ষার প্রহর গুনতে শুরু করল বাবলুর জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৪৫