১.
:তিলি,তোমার একটা নাম রেখেছি।
:আবার???
:হুম।
:কি নাম?
:সুরবালা।
:সুরবালা!!! এ আবার কেমন নাম?
:রবীন্দ্রনাথের একরাত্রির নায়িকা।
:কিন্তু আমি যে সুরবালা হতে চাই না।আমি তো হতে চেয়েছিলাম " সমাপ্তি " গল্পের অপুর মৃন্ময়ী।
:হুম।এই অপুই তোমার মাথাটা খেয়েছে।
:আমি তাকে ভালোবাসি শুভ্র।
:এজন্যই তো যারে চাও তারে পাবা না,বলে গেসে নায়িকা শাবানা।
:হয়তো।
:এই আবার মন খারাপ।তুমি মিয়া,জীবনে ভালো হবা না।একটা নাম দিসি সেটা নিয়া খুশি হবা না উল্টা দুঃখ পাচ্ছো অপুর কথা ভেবে।
:হুম।আচ্ছা, সুরবালা নামের অর্থ কি?
:যার মন মাটি দিয়ে গড়া।
:তারমানে আমার মন মাটি দিয়ে গড়া? হয়তো।এজন্যই বোধহয় একটুতেই ভেঙে যায়।
:ধুর।যাও তো।তোমার সাথে কথা বললেই এখন মেজাজ খারাপ হবে।একারণেই মেয়েমানুষ আমার সহ্য হয় না.....
ভালো লাগছিল না।তাই শুভ্রর সাথে চ্যাটিংগুলো দেখছিলাম।অনেকদিন শুভ্রর সাথে দেখা হয় না,কথাও হয় না।ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত।তারপর নিজের বিয়ে।শেষ যেদিন ফোনে কথা হয় সেদিন বলেছিল,"একটা তো মজার ঘটনা ঘটসে।"
:"কি?"
:"আব্বু তো ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে আমার একজন মাত্র বন্ধুকে দাওয়াত দিতে পারব বলসেন।আমি বলসি রাশেদের কথা।আব্বু বললেন রাশেদকে না দিয়ে তোমাকে দাওয়াত দিতে।আম্মুও দেখি সেই সাথে তাল দিচ্ছিলেন।"
:"তাই?"
:"শোনো,এতো খুশি হইয়ো না।আমি বলসি তুমি তোমার বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত।আর ভাইয়ার পর আমার সিরিয়াল।তোমারে বাসায় এনে বিপদে পড়ব নাকি?এমনেই দাদিদের যে রেসট্রিকশন।"
:"তুমি খুব খারাপ।"
:"হে হে এইটা তুমি আজকে বুঝলা?তা তোমার কি অবস্থা?"
:"আছি।"
:"বিয়ে করো ভাই।ভারো কথা বলি।এমন ঘোরাঘুরি করো না।"
:"হুম।"
:"তিলি,আমি জানি তুমি খুবই ভালো একটা মেয়ে।এজন্যই সবাই তোমায় কষ্ট দেয়।আর সবচেয়ে বড় কথা তুমি কষ্টগুলো নাও।আমি না হয় তোমার বন্ধু।তোমাকে অনেকদিন থেকে চিনি,জানি।কিন্তু সবাই কি জানে সেটা?পড়াশুনা শেষ,ভালো রেজাল্ট, ভালো জায়গায় অবশ্যই যাবে।কিন্তু এভাবে নিজেকে ছোট ভাবাটা ঠিক না।আমি কতদিন বা তোমার পাশে থাকতে পারব?জব,বিয়ের পর আর এখনের মতো যোগাযোগ করতেও পারব না।তখন মন খারাপ হলে তোমায় হাসাবে কে?বুইড়া জামাই?জীবনেও না।নিজের খুশিটা নিজেকেই বের করে নিতে হবে।জীবনটাকে চলতে দাও।বাঁচো।তারপর একদিন দেখবে ঠুশ করে মরে গেসো।"
:"হুম।আমার মরে যেতে ভয় করে না।বাঁচতে ভয় করে।"
:"এ মেয়েমানুষরে ঠিক করা আমার সম্ভব না।প্লিজ,মেয়েমানুষ না মানুষ হও।মেয়েমানুষ হলে তোমাকে কেউ সম্মান করবে না।মানুষ হও।সবাই সম্মান করবে।"
:"হুম।"
:"ভালো থেকো।ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত তো তাই আগের মতো কথা হচ্ছে না।"
:"হুম বুঝতে পারছি।তুমিও ভালো থেকো।"
তারপর আর কোনো যোগাযোগ নেই।ইচ্ছে করেই করছি না।কাউকে ডিস্টার্ব করতে ভালো লাগে না।শুভ্রকে ডিস্টার্ব করছি এটা কখনো মনে হয়নি।আজকাল কেনো মনে হচ্ছে?
২.
বিরাট একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙে গেলো।স্বপ্নে দেখলাম,"অপু কাঁদছে।আমি ওর চোখের জল মুছে দিয়ে হাতটা ধরলাম।মনে হলো ওর হাতটা অনেক বড়।দুহাত দিয়ে ওর হাতটা ধরতে হবে।আমি ওর থেকে বিদায় নিলাম শেষ বারের মতো।পিছন ফিরে ওকে দেখে রাস্তা পার হতে যেয়ে কোনো একবিশাল অন্ধকারে পড়ে গেলাম..." ধুর ,আজকাল মানুষের ম্যানহলে পড়ে যাওয়া নিয়ে কিসব খবর পড়তে পড়তেই এই অবস্থা। কিন্তু মনের মধ্যে ভয়টা কাজ করছে।কি করব?অপুকে কল দিব?কিন্তু আমি নিজেই তো কন্টাক্ট অফ করে দিয়েছি ওর সাথে।ওকে থাকতে দিচ্ছি ওর মতো করে।কি করব এখন?হঠাৎ মনে পড়ল মোবাইলে তো ব্যালেন্স নেই।অনেকদিন রিচার্জ করি না অপুকে যদি কল দিতে ইচ্ছে করে তাই।এখন শুধু ইনকামিং হয়।আউটগোয়িং হয় না।কতবার অপুর নাম্বারটা ডিলিট করে সেভ করেছি তার হিসাব নেই।ফোনবুকে কারো নাম্বার খুঁজতে গেলেই অপুর নাম্বারটা চলে আসে।চ্যাটিং গুলো পড়ি।চোখটা বন্ধ করলেই অপুকে দেখি।জানি না এ অপেক্ষার শেষ হবে কবে?
অপু এক বড় ভাইয়ের বন্ধু।যদিও পরিচয়টা হয় ভার্চুয়ালি। প্রথম প্রথম বন্ধু হিসেবে কথা বললেও বন্ধুর থেকে একটু বেশিই ভাবতে শুরু করি।যদিও সেটা অন্যায়।কারণ সে এনগেজড।তবুও ভালোবাসি।খুব বেশি।আজকাল রাতেরবেলা হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়।তখন মোবাইটা চেক করে দেখি এইবুঝি অপুর কল বা মেসেজ।আসে না।কিছুই আসে না।আজকাল ববাসায় ফিরতে যখন রাত হয় তখন মনে হয় এই বুঝি অপু কল দিয়ে বলছে,"এখনো বাইরে?"সবাই বলে আমার অপেক্ষা বৃথা।কিন্তু আমি মনে প্রাণে চাই সবাই ভুল প্রমাণ হোক।চাওয়াটা অন্যায়। তবুও।এসব ভাবতে ভাবতে যখন কান্না আসে।তখন মুখটা দুহাত দিয়ে ঢাকি।কাউকে দেখাতে চাই না এ কান্না। তখন মনে হয়ে কানের সামনে কেউ ফিসফিস করে বলছে,"here i me.this is me..." আমি মুখ তুলে তাকাই।নাহ্,কেউ নেই।বেলাশেষে আমি একা।
৩.
সকাল থেকে দেখছি রান্নাঘর ভর্তি বাজার।মনি কাকিও চলে এসেছে। কি ব্যাপার!!কাকি এতো সকালে?কেউ কি আসবে?কে আসবে?মা-কাকি মহাব্যস্ত তাদের কথা বলার সময় নেই।আমাকে দেখে বলল,"এতো সকালে উঠরি কেনো?আরেকটু ঘুমা।যে ঠান্ডা পড়েছে।" আমি কিছু বললাম না।ফ্রেশ হয়ে পেপারটা নিয়ে বসলাম বাবা-মায়ের ঘরে।মিতু এসে বলল,"তোর মোবাইলটা দেতো।" "আমার কাছে নেই।খুঁজে দেখ কোথায় আছে।"পেপার পড়তে পড়তে বললাম। আমার কথায় মিতু খুব অবাক হলো। অবাক হওয়ারই কথা।যে মেয়ে এক মিনিটের জন্য মোবাইল হাতছাড়া করে না সে মেয়ে কিনা বলে মোবািল কোথায় জানে না।মিতু কিছু না বলে চলে গেলো।আজকাল মোবাইল কই থাকে খবর থাকে না।কারণ দরকার পড়ে না।এসময় বাবা মিষ্টির কতগুলো প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল,"দর তো এগুলো।তোর মাকে ডাক দে।" আমি মিষ্টির প্যাকেট গুলো রেখে মাকে ডাকলাম।মা ঘরে ঢুকতেই আমি বের হয়ে যেতে যেতে শুনলাম বাবা বলছেন,"রান্না তাড়াতাড়ি শেষ করো।উনারা চলে আসবেন।" বুঝতে বাকি রইল না কারা আসবেন আর কাদের জন্য এতোকিছু।নিজের ঘরে ঢুতেি মিতু জানতে চাইল,"কোন শাড়িটা পড়বি রে বুবু?" "আমি শাড়ি পড়ব না।"বলে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কম্বলটা টেনে নিতে নিতে মিতু বলল,"এই তুই আবার শুয়ে পড়লি কেন?যা বাথরুমে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।" কোনো বাড়াবাড়ি করলাম না।কারণ আমি যে লক্ষ্মী মেয়ে।সবার কথা বাধ্য মেয়ের মতো শুনি।বাথরুমে ঢুকেই কান্না করে দিলাম।অপেক্ষার পালা কি অসমাপ্ত রয়ে গেলো?বৃথা অপেক্ষা করলাম?তার মানে সবাই ঠিক আর আমিই ভুল? কেমন করে আটকাবো এই বিয়ে?বাসায় জানাতে পারব না এই অপেক্ষার কথা।মিতু বুছে কিন্তু কিছু বলে না।কি করব আমি এখন?
৪.
"আপনার কি কি পছন্দ?" মাথা নিচু করেছিলাম তাই চেহারাটা দেখতে পাইনি। "আমার কোনো পছন্দ নেই।" অনেকটা নির্লিপ্ত গলায় বললাম। "কেনো?" "পরিবার যা পছন্দ করবে তাই।" "তার মানে তো আমার ভাইকেও আমার পছন্দ না।" "আমার পরিবার যেহেতু পছন্দ করেছে তাহলে অবশ্যই পছন্দ।"মনে এক আরে মুখে আরেক কথা বলছি।কিছুই করার নেই। "আপনার কিছু জানার আছে আমার ভাইয়ের ব্যাপারে? " "নাহ্।" বলেই মাথাটা তুললাম।চেহারাটা খুব পরিচিত লাগছে।কোথায় যেনো দেখেছি।মনে নেই।
বিকেলবেলা ছাদে চলে এলাম।আগে ছাদে উঠলে অনেকদূর চোখ যেতো এখন কয়েক মিটার পর চোখ আটকে যায় উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ের জন্য।হঠাৎ মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠল।অনেকদিন পর এই রিংটোন।খুব অবাক হলাম।রিসিভ করতেই,"কি খবর তিলি?কেমন আছো?"
:"ভালো।তুমি?"
:"তোমারে মিয়া হাড়ে হাড়ে চিনি।কন্ঠটা শুনেই বুঝতে পারছি যে তুমি ভালো নেই।তারপরও মিথ্যে বলছো।মন খারাপ কেনো?"
:"বিয়ে করব।দেখতে এসেছিল।"
:"তাই?তা পাত্র কি করে?নাম কি?দেখতে কেমন?"
:"জানি না।পাত্র আসেনি।পরিবার যা বলবে তাই।"
:"হুম তাইলে কেমনে হবে?"
:"আসলে আমার জানার ইচ্ছে নেই।"
:" করো করো।আমি বিয়ে করছি আর তুমি করবে এইটা কিসু হইলো? "
:"তাই?কাকে?
:"কাকে আবার?পুষ্পিতাকে।ওকে ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে থাকা সম্ভব না।"
:"পুষ্পিতা রাজি হলো কেমন করে?"
:"সে অনেক কাহিনী। দেখা হলে বলব।এখন রাখছি।আর মেয়েমানুষিটা বন্ধ করো।বুঝছো?"
:"আচ্ছা। ভালো থেকো।"
কথা শেষ করে "when i get older,I'll be stronger ...then call me freedom" লাইনদুটো গুনগুন করতে করতে ছাদ থেকে ঘরে এলাম।সবাই খুশি।আমি রাজি হওয়াতে।কিন্তু আমি খুশি কিনা সেটা কারো জানার প্রয়োজনবোধ হয়নি।বিশাল দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো।শুভ্রর কথা মনে পড়ল।ওর কাছ থেকে এতো কিছু শিখেছি জীবন সম্পর্কে কিন্তু কাজে লাগাতে পারিনি।বন্ধুর চেষ্টাই বৃথা।
৫.
একঘন্টা ধরে বসুন্ধরা সিটির বাইরে সঙ সেজে দাঁড়িয়ে আছি।যেহেতু সাজতে ভালো লাগে না সেহেতু একটু সাজলেই মনে হয় সঙের মতো দেখাচ্ছে।দাঁড়িয়ে আছি পাত্রর জন্য।কার দাঁড়িয়ে থাকার কথা আর কে দাঁড়িয়ে আছে।মোবাইটা বের করে সময় দেখতেই দেখি একটা অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ। "একটু কষ্ট করে সাইন্স লাইব্রেরিতে আসতে পারবেন?" মেজাজ চরম খারাপ হলো।রিকশা নিলাম।কিন্তু যতই রিকশা সাইন্স লাইব্রেরীর দিকে আগাচ্ছে ততই যেনো আমার হাত-পা জমে যাচ্ছে।অনেকদিন পর এখানে আসলাম।এখানেই অপুর সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল।অপু নামটা মনে আসতেই পুরো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেলো।ভাড়া মিটিয়ে রিকশা থেকে নামলাম।কিন্তু সামনের দিকে আগাতে পারলাম না।কারণ দূর থেকে আসা একটা মানুষকে দেখে মনে হলো আমি আর আগাতে পারছি না।কেউ যেনো মাটির সাথে আমার পা দুটো আটকে রেখেছে।যতই কাছে আসছে ততোই আমি বোবা হয়ে যাচ্ছি। মানুষটা যে অপু। "হায় হায় অপু এখানে!!! ও যদি জানতে পারে আমি পাত্র দেখতে এসেছি তাহলে কি উত্তর দিব?" অপু সামনে এসে বলল,"কি অপেক্ষা পালা শেষ?পছন্দের কিছু নেই বললে কেনো?" আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না আর ও এ কথাগুলো জানলো কেমন করে??কতক্ষণ বোবার মতো ছিলাম জানি না।হঠাৎ সংবিৎ ফিরে এলো মেসেজের টোনে।মেসেজটা অন করতেই দেখি শুভ্রর পাঠিয়েছে,"আমার চাওয়াটা পূর্ণ হবে আর তোমারটা অপূর্ণ থাকবে কেনো?" মেসেজটা পড়ে হাসতে থাকলাম।অনেকদিন পর।পাগলের মতো।
(সমাপ্ত)