somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বই এর পাতার স্বপ্নপুরুষেরা

২৮ শে আগস্ট, ২০১১ রাত ৩:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্কুলের পড়া আর সারা বিকেল হই হই খেলার মাঝে যদি আরো কিছু বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতে হয়, তাহলে সেই সময় সেটা ছিল বিটিভি'র বিভিন্ন অনুষ্ঠান। তবে টিভি দেখার, এবং টিভিতে নিজের পছন্দের অনুষ্ঠান দেখার সময়টা ছিল খুব সীমিত। তাই এরও বাইরে যে অভ্যাসটা গড়ে উঠেছিল, তা হল বই পড়া। বই আর বই...যখন যা পেতাম হাতের কাছে, তাই গপাগপ গিলতাম। এই বইগুলো বড়দের, এগুলো পড়া যাবে না...এমন কোন বিধি-নিষেধ ছিল না। তাই পড়তে পারতাম সব বই-ই। আর পড়তে পড়তেই কোন কোন চরিত্রকে এত ভাল, অনেক ভাল, অনেক বেশি ভাল লেগে যেতো... সে ভাল লাগার আর কোন সীমা-পরিসীমা নেই! দেখা যেতো কয়টা দিন আমি এক্কেবারে ঘোরের মধ্যে, বইয়ের সেই যাদুময় মানুষটার প্রেমে একেবারে হাবুডুবু। :P বইয়ের সাদা পাতায় ছোট ছোট কাল অক্ষরে যেসব মানুষ যাদুকরী হয়ে উঠে আমার কল্পনার জগৎকে রাঙিয়ে তুলেছিল, তাদের কথাই আজ লিখবো। :)

ধ্রুব

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের 'দূরবীন' বইয়ের অন্যতম প্রধান চরিত্র ধ্রুব। আমার পরিচিত বেশিরভাগ মেয়েকেই দেখেছি ধ্রুব'র প্রেমে পড়েছে। ভীষণ দাম্ভিক, গোল্লায় যাওয়া, পাগলাটে, ক্ষ্যাপাটে ধ্রুব; যে কিনা রেমি বা ধারার মত সুন্দরী, আকর্ষণীয় নারীর ভয়ংকর ভালবাসা, প্রবল আকর্ষণকে কে বিনা দ্বিধায় ছুঁড়ে ফেলে দিতে, অবহেলা করতে পারে। ওই উন্নাসিক, দাম্ভিক, দিশেহারা ধ্রুব'র প্রেমে যে কি ভয়ংকরভাবে পড়েছিলাম! বহু বহুদিন সেই জায়গাটা আর কেউ দখল করতে পারেনি। ভীষণ ঈর্ষা হতো আমার রেমিকে; মনে মনে খুব চাইতাম ঠিক ওইরকম কেউ আসুক আমার জীবনে; আর কিচ্ছু চাই না।

অর্ক

কালপুরুষ এর অর্ক, সমরেশের অসাধারণ তিন সৃষ্টি উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ...বাবা অনিমেষের তুলনায় ছেলে অর্ক খুব একটা উজ্জ্বল না হলেও আমি অর্ক'র প্রেমেই পড়েছিলাম। অর্ক অনেকটা ধ্রুব'র মতনই, সারাক্ষণ প্রচন্ড আক্রোশে ফুসছে কিছু একটা করবার জন্য; কিন্তু কিছুতেই ঠিক করে উঠতে পারছে না, খুঁজে পাচ্ছে না সঠিক পথটা। দাম্ভিক, ক্ষ্যাপাটে, উচ্ছন্নে যাওয়া অর্ক।
বইটা আমি পড়েছিলাম যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। ক্যাডেট কলেজে ভর্তির জন্য কোচিং করতাম তখন, খুব পড়ার চাপ ছিল। তাই টিভি দেখা, গল্পের বই পড়া কিছুদিনের জন্য একেবারে হারাম হয়ে গেছিল। কত কাহিনী করে যে অর্ক'র সাথে আমার প্রেমটা চালিয়ে গিয়েছিলাম! (মানে বইটা পড়ে শেষ করেছিলাম আর কি :P)

হেমাঙ্গ

পার্থিব বইটা পড়ে আমি প্রায় এক সপ্তাহ একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কি সুন্দর! কি যে অদ্ভুত সুন্দর লেগেছিল আমার। শীর্ষেন্দু কিভাবে যে এত গভীর অনুভূতিগুলো তাঁর লেখায় ফুটিয়ে তোলেন, পড়লে গা শিরশির করে ওঠে, মাথা ঝি ঝি করতে থাকে, সারা পৃথিবী কেমন যেন ওলোট পালোট! (আমার কাছে তাই লাগে আর কি :))
পার্থিবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্র ছিল হেমাঙ্গ। ওই আলাভোলা, উদাসীন, লাজুক, সুন্দর মানুষটা যেন যাদু করেছিল। কি যে মায়া লাগতো আমার ওর জন্য! আহা বেচারা, সবাই শুধু বকে আর বিপাকে ফেলে। সে কিনা চায় একলা, নিরিবিলি, নির্বিঘ্ন একটা জীবন কাটাতে। কিন্তু সেটা হবে কেন! তার ওপরেই যত ঝঞ্ঝাট আর সে বেচারার জলে পড়া, অসহায়, দিশেহারা মুখ। বড্ড ভালবেসে ফেলেছিলাম এলেবেলে এই লোকটাকে।

সূর্য

'একা এবং কয়েকজন' বইটার সবচেয়ে তেজী চরিত্রটা, ঠিক যেন নিজের নামের মতই। প্রবল আক্রোশে ফুসছে সারাক্ষণ, কিছু একটা করতে হবে; কিন্তু বেচারার জানাই ছিল না সেই কিছু একটা যে কি! কোন পথটা ঠিক। তাই সে ছুটল কেবল দিগ্বিদিক, আর শেষ পর্যন্ত মারা গেল খুব করুণভাবে।
এইরকম প্রবল পুরুষদের প্রতি আমার সীমাহীন আকর্ষণ! ভালবাসবো, ঝড়ের মত...উদ্দাম কালবোশেখী এল আর উড়িয়ে নিয়ে গেল। অবহেলা করবো, তাও সেটা রাজকীয়।
এই ক্ষণজন্মা পাগলা ঝড়টাকে পাগলের মত ভালবাসতে ইচ্ছা হতো আমার।

কবি নিতাইচরণ

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী বই 'কবি'। ডোম বংশের ছেলে নিতাইচরণ, যার বংশের ধারা হল ডোমের কাজ করার পাশাপাশি ডাকাতি করা; সেই ছেলেই কিনা একদিন হয়ে উঠল কবি।
অত্যন্ত নিরীহ, ভীষণরকম ভালমানুষ, রোমান্টিক, কল্পনাবিলাসী, অসাধারণ একজন গায়ক, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একজন প্রেমিক, নম্র স্বভাবের অথচ দৃঢ় এই মানুষটিকে ভালবেসে ফেলেছিলাম খুব। তার খুব বড় একটা বৈশিষ্ট্য ছিল সে একজন জন্ম নি:সঙ্গ মানুষ, আকর্ষণ করবে সে সবাইকেই, এমনকি নিজেও চাইবে বাঁধনে জড়াতে কিন্তু তারপরও কিসের বাধায় তার আর বাঁধনে জড়ানো হয় না। কেবল ঘুরে বেড়ায় এ দ্বার থেকে সে দ্বারে।

কুমুদ

পুতুর নাচের ইতিকথা'র একখানা পুতুল হল কুমুদ। কলেজ জীবন থেকেই ছন্নছাড়া কুমুদ পথ ছেড়ে চলতে চলতে শেষ পর্যন্ত যাত্রাদলেই নাম লেখায়, শুধু পথে পথে চলবে বলে। সেই কুমুদই কেমন করে যে গ্রামের মেয়ে মতির প্রেমে পড়ে যায়, নিয়ে যায় তাকে বিয়ে করে। সবচেয়ে সুন্দর লেগেছিল যে জিনিসটা তা হল বিয়ে করে সে সংসারী বা থিতু না হয়ে উল্টে মতিকেও শেখায় কিভাবে উড়তে হয় বাধাহীন হয়ে।
এই সমাজটার উটকো সব নিয়ম ভেঙে নতুন পথের যারা পথিক হয়, তাদের কি যে ভাল লাগে! আর উদাসীন, ছন্নছাড়া মানুষদের জন্য আমার টানটা বরাবরই একটু বেশি। তাই অবধারিতভাবেই প্রেমে পড়েছিলাম কুমুদের। :)

কর্ণমল্লিক

আবারও শীর্ষেন্দু, বই 'ফুলচোর'। হেমাঙ্গ'র মতনই কর্ণমল্লিক নিরীহ, গোবেচারা, আলাভোলা, উদাস একজন মানুষ। জগৎ সংসার সম্পর্কে যার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, নিজের মনেই বাস। বেচারা, আহা বেচারা! কি অদ্ভুত মায়া যে তৈরি হয়েছিল তার জন্য! ! কেমন ঘোর ঘোর ভাল লাগা, ভালবাসাও বটে :P

হেরম্ব

জগৎ সংসার সম্পর্কে উদাসীন আরেকজন মানুষ, ভীষণ যার আকর্ষণ; কাছে টানবে কিন্তু নিদারুন অবহেলায় আবার দূরে ঠেলে দিবে। কখনো জড়াবে না বাঁধনে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'দিবারাত্রির কাব্য' বইতে যার কথা বলা হয়েছে, সেই হেরম্ব। কেন যে চিরকাল সব তেজস্বিনী নারী হেরম্বের মত কুলাঙ্গারকে উজাড় করে দিয়েছে নিজের সমস্ত অনুভূতি, আমি সেই রহস্যের কোন কূল-কিনারা পাই না। হেরম্ব তার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য দিয়ে আকৃষ্ট করেছিল আমাকেও, বলাই বাহুল্য!

বাপী তরফদার

আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বই 'সোনার হরিণ নেই'; বাপী সেই বইয়েরই মূল চরিত্র। ভীষণরকম জেদী, আত্মবিশ্বাসী এই ছেলেটিকে ভালবেসেছিলাম এইজন্য যে তার মত নিবেদিত একজন প্রেমিক কমই দেখা যায়। এক মিষ্টি অর্জনই ছিল বার বছর বয়স থেকে তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। আর সেই মিষ্টি অর্জন করতে কত যে চড়াই সে পার হয়েছে! আহা, এমন ভাল যদি কেউ বাসতো! :P

পাভেল ভ্লাসভ

আমার জেদী, গোঁয়ার, বিদ্রোহী প্রেমিকদের মধ্যে ইনিই একমাত্র যে কিনা শেষ পর্যন্ত ঠিক পথটি খুঁজে পেয়েছিল। কিছু একটা করতে হবে, ভেঙে ফেলতে হবে নিয়মের শৃঙ্খল, করতে হবে নতুন দিনের সূচনা...টগবগ করে রক্তে ফুটতে থাকা এই আগুনকে সে ঠিকই কাজে পরিণত করেছিল।
ম্যাক্সিম গোর্কির 'মা' বইতে জার এবং পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ দানা বেঁধেছিল মজুর শ্রেণীর মধ্যে, পাভেল ভ্লাসভ তা সংগঠনের অন্যতম একজন। তার হাতেই পয়লা মে'তে বিপ্লবীদের মুক্তির ঝান্ডা ওড়ে।
একরোখা, গম্ভীর, সংকল্পে অটল, প্রবল ব্যক্তিত্ববান একজন মানুষ; চোখ বুজে, নির্দ্বিধায় যার ওপর ভরসা করা যায়।

মাসুদ রানা

টানে সবাইকে কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না......বইয়ের শুরুতে এই একটা কথাতেই তো একেবারে কুপোকাত! :P মাসুদ রানাকে ভালবেসেছিলাম বটে, তার এই বৈশিষ্ট্যের জন্যও হতে পারে...হতে পারে তাকে অতটা বীরোচিত, নায়কোচিত করে উপস্থাপনের কারণে। সব দোষ কাজীদা'র, আমি কি জানি! :P



আপাতত: এই ক'জনকেই মনে করতে পারছি। ঝড়ের মত, কোই পরোয়া নেই মানুষগুলো যেমন আকর্ষণ করতো ভীষণ; তেমনি আলাভোলা উদাসী বেচারা মানুষগুলোকেও ভালবেসেছি খুব। হয় নিয়ে নাও সবটুকুর দখল, আর নয়তো সমর্পণ করো নিজেকে- আদি ও অন্ত। মাঝামাঝি কিছু নেই।

আমার সেলিব্রেটি প্রেমিকদের মতনই বইয়ের পাতার এই স্বপ্নপুরুষেরা দখল করে রেখেছে আমার স্বপ্ন আর কল্পনার জগতের অনেক বিরাট একটা অংশ। :)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ১০:১৯
৭৮টি মন্তব্য ৭৮টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×