সন্ধ্যা ছয়টা পনর
-হ্যালো!
-তুমি কোথায়?
-এইতো বাসে উঠলাম মাত্র। কেন?
-কেন মানে! তুমি আমার বউ। আমি জানতে চাইতেই পারি তুমি কোথায় আছো, কি করতেছো!
-হুম, পারো। তুমি কোথায় এখন?
-বোকার মত প্রশ্ন করো না। তুমি খুব ভাল করেই জানো আমি কোথায়।
-কেন?
-কেন! এটা কোন প্রশ্ন হল না। আমি কোন বাচ্চা ছেলে নই যে এমন প্রশ্নের উত্তর দিবো।
মেয়েটা জানে ছেলেটা এখন কোথায়। সে জানে প্রতি মাসে একবার হলেও ছেলেটার সেখানে যেতে হয়, এ এমনই এক ভয়ংকর নেশা। ব্যাপারটা পছন্দ না করলেও কেন যেন সে মেনেই নিয়েছে সব। তবু তার আজ ভীষণ রাগ হয়ে যায়। মনে মনে ফুসতে থাকে সে।
আধাঘন্টা পর
-হ্যালো!
-স্টিল দেয়ার?
-ইয়াপ।
-আমি নামতেছি।
-নামতেছো মানে! কোত্থেকে? কোথায়?
-বাস থেকে। তুমি বের হও। এক্ষুণি।
এটা তার স্টপেজ না। কিন্তু যখনই তার মনে পড়ছে ছেলেটা আজ মাতাল হয়েছে, স্থির থাকতে পারছে না। যখনই বারের হই-হল্লা, বোতল আর গ্লাসের টংকার কানে ভাসছে, সে রাগে ফুলে উঠছে। তাই বরাবর হিসাবি, নিয়ম মানা, শান্ত-স্থির মেয়েটা আজকে হুট করে মাঝরাস্তায় নেমে পড়তে দ্বিধা করে না।
পনর মিনিট পর
ওভার ব্রিজের গোড়ায় আধো অন্ধকারে গা ঘেষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে দুইজন। সামনে দিয়ে সাঁই সাঁই করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। দীর্ঘ একটা মূহুর্ত চলে যায় পরস্পরের হৃদপিন্ডের ঝড় মাপতে মাপতে।
-আমার হার্টবিট দ্যাখো।
-একটু ফাস্ট, বাট ইটস নরমাল ফর ইউ।
-ইউ নো নাথিং। আয়্যাম ডায়িং।
-ডোন্ট ইভেন ডেয়ার টু থিংক লাইক দ্যাট হোয়েন আইয়্যাম বিসাইড ইউ, ইউ স্টুপিড!
-হা হা হা।
ওরা ফুটপাথ ধরে হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হেঁটে যেতে থাকে। মেয়েটার মনে ক্ষীণ একটু অনুতাপ হয় এমন হুট করে নেমে পড়ার জন্য। আজ রাস্তা ফাঁকাই ছিল। বাড়ি পৌঁছতে খুব বেশিক্ষণ লাগতো না। ফিরে গিয়ে সে একটু বিশ্রাম নিতে পারতো, অপেক্ষা করতো ছেলেটার জন্য। সে ফিরলে যা হয় একটা কিছু ফয়সালা হতো, অন্য সব দিনের মত।
দশ মিনিট পর
-বাসায় যাবা কি করে এখন? তোমাকে নিয়ে তো লাফ-ঝাপ দিয়ে বাসেও উঠতে পারবো না।
-আমি কি জানি তার!
-তোমাকে কে বলছিল মাতব্বরি করে বাস থেকে নামতে! আমি একা যেতে পারতাম না?
-আমি তোমাকে নিতে আসি নাই।
-তাহলে কি করতে আসছো?
-আমার ইচ্ছা হইসে আজকে রুটিনের বাইরে কিছু করি।
-ওহহো হো হো! তোমার মত এমন শান্ত-শিষ্ট গুডি গুডি মেয়েরও তাহলে মাঝে মাঝে রুটিন ব্রেক করতে ইচ্ছা করে!
-করতেই পারে! চল আজকে বাইরে খাবো।
-ওক্কে ডার্লিং। এ্যাজ ইউ উইশ!
কিছু অপ্রয়োজনীয় টাকা খরচ হবে। তা হোক, কিন্তু এত রাত করে বাড়ি ফিরে আবার রাতের খাবার তৈরির হাঙ্গামা করতে হবে না, এটা ভেবেই স্বস্তি পায় মেয়েটা।
রিকশায়
-এইরকম মেইন রাস্তা দিয়ে রিকশায় যেতে আমার ভয় করে অনেক। কেমন সাঁ সাঁ করে যেতে থাকে বাসগুলো পাশ দিয়ে।
-তোমার কোন ভয় নাই। আমি যতক্ষণ তোমার পাশে আছি তোমাকে প্রটেক্ট করবো, নিজের জীবন দিয়ে হলেও।
মেয়েটাকে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে বলে ছেলেটা।
-ইজন্ট দ্যাট রোমান্টিক?
-ইয়া।
ভরা রাস্তায় হুডখোলা রিকশায় লোকজনের তোয়াক্কা না করে তারা চুমু খায় পরস্পরকে, সেই আগেকার দিনগুলোর মত। ঠিক তখনই একটা দ্রুতগতির বাস ওদের রিকশা ঘেষে চলে যায়, আরেকটু হলেই ঘটে যেতে পারতো ভয়ংকর কোন দুর্ঘটনা। ঠা ঠা করে হেসে ওঠে ছেলেটা!
-ওহ, উই অলমোস্ট ডাইড! ইজন্ট দ্যাট ফানি। সি? আইয়্যাম নট এফ্রেইড অফ ডায়িং। বাট আই হ্যাভ টু প্রটেক্ট ইউ। সো আই ক্যান্ট ডাই নাউ।
কিন্তু তাতে মেয়েটা খুব একটা নিশ্চিন্ত হতে পারে না। সে জানে এমন পরিস্থিতিতে দুজনই অসহায়। মরলে তাদের একসাথেই মরতে হবে। কিন্তু........মৃত্যুতে তার ভীষণ ভয়!
আধা ঘন্টা পর
চাইনিজ রেস্টুরেস্টের আলো-ছায়ায়, ছেলেটা অস্থির হাতে মোবাইলে নাম্বার টিপে যাচ্ছে। মেয়েটা তেমনি শান্ত, স্থির। খাবারের অর্ডার দিচ্ছে।
-স্যুপ?
-চিকেন কর্ণ স্যুপ।
-চিকেন?
-চিকেন ফ্রাই।
-রাইস?
-নোপ।
-ড্রিংকস?
-টেল দেম টু গিভ মি সামথিং রিয়েলি হার্ড।
-স্টপ ইট!
-হা হা হা!
দশ মিনিট পর
-আমার ভাল লাগছে না।
-অস্থির লাগছে?
-হ্যাঁ। আমার হার্টবিট মাপোতো।
-ঠিক আছেতো! নরমাল।
-আমার এমন লাগে কেন! আমি কি মারা যাচ্ছি?
-না সোনা, কিচ্ছু হয় নি তোমার।
-আমার ভাল লাগছে না, বাসায় যাবো।
-আচ্ছা অর্ডারটা ক্যান্সেল করি।
কিন্তু ততক্ষণে পার হয়ে গেছে বিশ মিনিট। এখন আর রেস্টুরেন্টের লোকজন অর্ডার ক্যান্সেল করতে রাজি নয়। তাদের নাকি খাবার রেডি করা শেষ প্রায়। ছেলেটা আর এক মূহুর্তও বসতে রাজি নয়। 'শরীর খারাপ লাগছে', এই বলে সে হন হন করে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মেয়েটা বসে আছে বিপন্ন মুখে। না খেলেও যে বিল দিয়ে যেতে হবে। এতগুলো টাকার খাবার অর্ডার দেয়া হল! কত কষ্টের টাকা! নষ্ট করতেও বুক কাঁপে। হাত ধরে ডেকে, অনুনয় করে মেয়েটা ওকে বসায় আবার। রেস্টুরেন্টের অন্য সব কাস্টমার, ওয়েটার সবার দৃষ্টি উপেক্ষা করে পাশে দাঁড়িয়ে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে রাখে ছেলেটাকে, মাথায় হাত বুলায়, বাতাসের মত ফিসফিসে স্বরে একটা-দুটো কথা বলে সাহস জোগানোর চেষ্টা করে।
-কতবার তোমাকে বলি খেয়ো না ওসব।
-এগুলো আমাকে রিলিফ দেয়। আমি ভাল থাকি।
-তাহলে এখন এমন হচ্ছে কেন?
-আমি কি জানি তার! এত প্রশ্ন করো না।
মেয়েটা চুপ হয়ে যায়। জানে এমন সময়ে ছেলেটাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হয় না। তাতে সে আরো ক্ষেপে ওঠে, আরো অস্থির হয়ে যায়। মেয়েটা তার মাথার ওপর দিয়ে আরো একবার করুণ চোখে ওয়েটারদের দিকে তাকায়। কাস্টমারের এমন অবস্থায় ততক্ষণে পুরো রেস্টুরেন্টে সবাই বেশ তটস্থ। কেউই চায় না অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটুক আর তারা বিপদে পড়ুক। সুতরাং তারা চোখের ইশারাতেই মেয়েটাকে আশ্বাস দেয় যে, 'প্রায় শেষ, তারা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে যেতে পারবে।'
-কত দেরি আর! আমার ভাল লাগছে না, বাসায় যাবো।
-এইতো সোনা, আর একটুখানি।
-কত টাকা বিল হইসে? দিয়ে দাও না। আমার বসে থাকতে ইচ্ছা করছে না আর।
-ওরা পারসেল করে দিচ্ছে যে! খাবারটা নিয়েই যাই, বাসায় যেয়ে খেয়ো না হয়।
এতগুলো টাকার মায়া ছাড়াটা সত্যি খুব কষ্টকর। মেয়েটা তাই আরো একটুখানি অপেক্ষা করতে চায়। বাচ্চা ছেলেকে ভুলানোর মত মাথায় হাত বুলিয়ে ভুলাতে চেষ্টা করে ছেলেটাকে।
সতের মিনিট পর
-তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও বস। আমি ঠিক আছি এখন।
-অসুবিধা নাই। তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেই ভাল লাগছে আমার।
-লাগবে না। বসো যাও।
-এখন একটু ভাল লাগছে?
-হুম।
-খাবার কি পারসেলই করে দিবে নাকি খেয়ে যেতে পারবে?
-নাহ, খেয়েই যাই। এখন অনেকটা ভাল লাগছে।
ওয়েটারকে ডেকে খাবার সার্ভ করতে বলে মেয়েটা। ওদের বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে তারা বিরক্ত হয়। কিন্তু ব্যবসার খাতিরে বলতে পারে না কিছু। প্যাকেট করা খাবারগুলো আবার খুলে সাজিয়ে দেয় টেবিলে। সারাদিনের অফিস শেষের ক্লান্তির পরে ছেলেটার এমন আচরণে বিরক্ত মেয়েটাও। তার এখন বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নেয়ার কথা। শরীর তাই চাইছে। কিন্তু সম্পর্ক আর ভালবাসার খাতিরে বলতে পারে না কিছু। নিজের শারীরিক কষ্ট, বিরক্তি, ওয়েটারদের বিস্মিত দৃষ্টি সযত্নে উপেক্ষা করে তার অতি বিখ্যাত ধৈর্য দিয়ে। স্বস্তি পায় টাকাটা নষ্ট হল না ভেবে।
সময় বয়ে চলে...
নাম করা চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সুস্বাদু খাবার খেয়ে চলে তারা। অবশ্যই নিরবে নয়। কম কথা বলা ছেলেটা মদের নেশায় অনেক অনেক কথা বলে চলে। হাস্যকর, অযৌক্তিক সব কথা; খুব সযতনে গোপন রাখা কোন কথা; নিজের ভেতরের জমানো রাগ আর ক্ষোভের কথা। শান্তমুখে, অপরিসীম ধৈর্য নিয়ে শুনে চলে মেয়েটা। তার এই ধীর-স্থির ভাব দেখেও ছেলেটা রেগে ওঠে, সে নিজে কেন এমন হতে পারে না!
-কেন, কেন তুমি এত শান্ত-শিষ্ট! আর আমি এমন...এমন...
ছেলেটার হাত ধরে মেয়েটা মৃদু হাসে, আশ্বাসের হাসি। মনে মনে কিছুটা গর্ববোধও করে। নিজেকে উচ্চতর ভেবে পুলকিত হয়।
পঁচিশ মিনিট পর
খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। হঠাৎ করেই ছেলেটার চোখ-মুখ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। সেই পুরনো ভয়টা জেঁকে ধরছে তাকে আবার। হাতের কাঁটা চামচটা নিয়ে সজোরে সে বসিয়ে দেয় অন্য হাতে। ঠেকানোর সুযোগ পায় না মেয়েটা।
-মানা করো না আমাকে। নিজেকে আঘাত করলে আমি নিশ্চিত হতে পারি যে বেঁচে আছি।
-তুমি বেঁচে আছো। আমার পাশে আছো। কোন ভয় নাই।
-অসহ্য লাগছে। বাসায় যাবো।
টেবিলের দিকে তাকায় মেয়েটা। খুব সামান্য খাবারই অবশিষ্ট আছে। ওয়েটারকে ডেকে বাকি খাবার পার্সেল করে দিতে বলে সে। খুব দ্রুতই হয়ে যায় কাজটা। বিল দিয়ে দিতেও বাধা থাকে না তখন। একটা পয়সাও নষ্ট হয় নি, খাওয়াও হল, নিয়ে যাওয়াও হল।
দৃঢ় হাতে ছেলেটার হাত মুঠোয় চেপে বের হয়ে আসে সে, অন্য হাতে খাবারের প্যাকেট। খাবারের মূল্য পরিশোধ আর তা উসূলের পর প্রস্থানে আর দ্বিধা থাকে না তার
বাড়ি ফেরা যায় এখন নিশ্চিন্তে। রেস্টুরেন্টের মধ্যে ডাক্তার ডাকতে গেলে কী ঝক্কিটাই না হত!
তাদের বাসার পাশেই একটা ছোট্ট কিন্তু ভাল ক্লিনিক আছে। বাসায় গিয়ে যা হবার হবে!
খাবারের মূল্য পরিশোধের পর এখন কিছুটা নির্ভার লাগে তার।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১০:৪২