মহাবিশ্ব অসীম এবং এর কোন কেন্দ্র নেই!
শুধু এক কথা বলার অপরাধে ইতালীয় বিজ্ঞানী-দার্শনিক জিওর্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। অভাবনীয় মনে হলেও এটাই সত্য। তখনকার ইউরোপ ছিল আজকের ভারতবর্ষের মতো প্রতিক্রিয়াশীলতায় ঠাসা। সারা জীবনই তাকে প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী থেকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। ইউরোপের দেশে দেশে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। তবে ব্রুনো বিজ্ঞান, দর্শন এবং যুক্তিবাদ নিয়ে এমন সব চিন্তা করেছিলেন যা বিংশ শতাব্দীতে এসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাকে চিন্তার মুক্তির জন্য নিবেদিত একজন শহীদ হিসেবে গণ্য করা হয়।
১৬০০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম নিষ্ঠুর একটি দিন। রোমের রাজপথ কানায় কানায় পূর্ণ। প্রতিটা বাড়ির ছাদে, প্রাচীরে, গাছে—যে যেখান থেকে পারছে উঁকি দিচ্ছে ফাঁসির মঞ্চের দিকে। আসামি জিওর্দানো ব্রুনো। তাঁর অপরাধ তিনি বলেছেন, ‘মহাবিশ্ব অসীম এবং এর কোন কেন্দ্র নেই। পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। পৃথিবী সৌরজগতের তুচ্ছ গ্রহ ছাড়া এর আলাদা কোনো গুরুত্ব নেই।পৃথিবী ও বিশ্বজগত্ চিরস্থায়ী নয়, একদিন এসব ধ্বংস হয়ে যাবে।’ এগুলো খৃস্টান ধর্ম ও বাইবেলের বিরুদ্ধে যায়। এ জন্য তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নয়, গর্দান কেটে নয়, আগুনে পুড়িয়ে! বিচারকের তেমনই হুকুম—তাঁর রক্তের এক ফোঁটাও যেন পৃথিবীর সঙ্গে না মেশে। পুড়িয়ে মারলে তো আর রক্ত পৃথিবীতে মিশতে পারবে না।
ব্রুনোকে নিয়ে যাওয়া হলো মঞ্চে। ভারী লোহার শিকলে তাঁর হাত-পা বাঁধা। জিবও বেঁধে রাখা হয়েছে। বিচারকদের বড্ড ভয়, কী জানি মৃত্যুর আগে ব্রুনো কোন সত্যি কথা বলে যান! দণ্ড কার্যকরের ঠিক আগ মুহূর্তে ব্রুনোকে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল বেঁচে থাকার। এ জন্য তাঁকে দোষ স্বীকার করতে হবে। বলতে হবে, তিনি যা বলেছেন ভুল। ব্রুনো মাথা নত করে বাঁচতে চাননি। এরপর তাঁর শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। হাত-পা, নাক-মুখে আগুন লেগে যায়, চুল-দাড়িও জ্বলে ওঠে। তবু মরার আগে একবারও আর্তচিত্কার বেরোয়নি ব্রুনোর মুখ দিয়ে।
কেউ কেউ বলবেন, ‘মানুষ এতো নির্বোধ ছিল! কেউ বুঝতো না!’ ধর্মগ্রন্থগুলো মোতাবেক পৃথিবী সমতল। আকাশই অর্ধডিম্বাকৃতি, তাও সাতটি। একটির উপরে আরেকটি। এসব আকাশে সূর্য ও চন্দ্রকে ফেরেস্তা/দেবতারা টেনে নিয়ে যায় পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে। কারো কারো মতে সূর্য নিজেই দেবতা! গোলাকার পৃথিবীর ধারণা আসলো আরো পরে। তখন মানুষ মনে করত পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র, পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সব গ্রহ-নক্ষত্র। তখনকার ইউরোপের ধর্ম-বিশ্বাস ছিল এমনই। তাই ব্রুনো যা বলছেন সবই ধর্মবিরোধী। তাদের আশঙ্কা, ব্রুনোর মতবাদ ছড়িয়ে পড়লে পৃথিবী ধর্মহীন হয়ে পড়বে, সব মানুষ পরিণত হবে শয়তানে। তাই ব্রুনোকে হত্যার এই বিশাল আয়োজন। অথচ ব্রুনোর সেই সত্যির ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে দক্ষিণ এশিয়া-আরব-আফ্রিকা বাদে আজকের পৃথিবী। অবশ্য এ অঞ্চলের সব মানুষ নয় অধিকাংশ মানুষ এখনো এতোটাই অন্ধ যে, পৃথিবী গোলাকার’ এটা বিশ্বাস করতেও কাঁপতে থাকে। আমরা এখনো চিন্তা-দর্শন-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অন্তত ৪শত বছর পিছিয়ে রয়েছি ইউরোপ থেকে। এখনো দক্ষিণ এশিয়ার ১% মানুষও বিজ্ঞান বুঝে না, বুঝতেও চায় না।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০২০ দুপুর ১২:৫৭