জাকির তালুকদারের ‘পিতৃগণ’
১
ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাসে থাকার কথা, রাজা-বাদশাদের কথা। আর শওকত আলীর এ উপন্যাসে আছে ক্ষমতাবানদের তাণ্ডবে সেসময়েও সাধারণ মানুষের ত্রাহি অবস্থার বিবরণ। ১২০০ সালের দিকের ঘটনা। তুর্কিরা আসছে সেই ভীতি আছে সামন্ত ও তাদের পাণ্ডাদের, তাদের দৌরাত্মও আছে। এরমধ্যেই আছে সেন-আমলে চরম নিপীড়নের মধ্যে থাকা বৌদ্ধ ও উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের হাতে সীমাহীন নিপীড়িত অবস্থায় থাকা প্রাকৃতজন। রাজনীতিতে এই ত্রিমুখী দ্বন্দ্বর ভিতরে বর্ণপ্রথার অভিশাপ উঠে এসেছে। ওই সময়ের নিম্নশ্রেণির মানুষের জীবনই মূল উপজীব্য। ডোম, কৃষক, কামার, জেলে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী- তারাই প্রাকৃতজন। ওই সময়ে অধিকাংশ এলাকাজুড়েই সাধারণ দরিদ্র মানুষ। মধ্যবৃত্ত শ্রেণি তৈরি হয়নি। এই নিম্নশ্রেণির মানুষের ধর্মত্যাগের কিছুটা কারণও উপলব্ধি হয়। উপন্যাসে প্রচুর সংখ্যক সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ওই সময়ের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা কি ছিল? সংস্কৃত? এই উপন্যাসের চরিত্ররা কথা বলেছে প্রচুর সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করে। আমাদের মতো সংস্কৃত না জানা মানুষেরও তা বুঝতে সমস্যা হয়নি। ক্ষেত্রকর মানে মনে হয়েছে কৃষক, মৃৎশিল্পী মানে কুমার...। শওকত আলীর ‘উত্তরের খেপ’ পড়ে তখন তাঁর উপর মুগ্ধ। রোকেয়া হলের গেটে প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করছি, আমার মতোই করছেন আরেক ভদ্রলোক। বাংলা সাহিত্য নিয়ে ওনি খুবই তাচ্ছিল্য করছিলেন। উত্তরের খেপের কথা বলাতে, তিনি বললেন, এরচেয়েও ভাল উপন্যাস শওকত আলী লিখেছেন, ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’। পড়ে তাঁর প্রতি অতি মুগ্ধ হই। জগন্নাথ কলেজে তিনি শিক্ষকতা করতেন। খোঁজ করে তার হিসাবও দেখলাম। অল্প টাকা আছে। পুরাতন স্টাফদের কাছে জানলাম ওনি আসেন? বললেন গত পরশুও এসেছিলেন! এরপর তাঁর মৃত্যু সংবাদই পাই, দেখা আর হয়নি।
২
ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে গেলে গবেষণা করতেই হয়। উপন্যাসের একটি বৃহৎ ভূমিকায় জাকির তালুকদার সে কথাও বলেছেন। পরাক্রমশালী পালরাজাদের হটিয়ে দিয়ে কৈবর্তদের ক্ষমতা দখলের এবং ৩৭ বছর পর ক্ষমতা হারানোর ইতিহাস হল পিতৃগণ। ওটাই আমাদের প্রথম স্বাধীনতা অর্জন।বরেন্দ্রভূমি বলতে আমরা উত্তরবঙ্গকে বুঝি। উত্তরবঙ্গের কৈবর্তদের সংগঠিত করেছিলেন কৈবর্তদেরই সন্তান দিব্যোক। শুধু একজন বীর সেনানীর গল্পই এটি নয়, গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি চরিত্র হল কৈবর্তদের কবি পপীপ। ঐতিহাসিক উপন্যাসের আরেকটি মজা হল, লেখক পাঠককে নিয়ে যান ঐ সময়ে। জাকির তালুকদার সেক্ষেত্রে সফল হয়েছেন অনেকটাই। বৌদ্ধ বিহারগুলোর ভিতরের খবর আমরা পেয়ে যাই। সোমপুর/পাহাড়পুর বিহার আর জগদ্দল বিহারে কি হতো? সামন্তদের মনোরঞ্জনের জন্য থাকতো সেবাদাসী আর পুরোহিতদের বহুমাত্রিক দৌরাত্ম আমরা দেখি। পালরাজারা বিহার চালানোর জন্য তাদের জমি দিতো। প্রজাদের উপর তারা অতিরিক্ত নিপীড়ন করতো। আর সেইসব বিহারে নির্বাণ লাভের নামে ঘটতো অবাধ যৌনাচার। আমাদের সেই বিজয়ী আদিপুরুষদেরই লেখক পিতৃগণ বলেছেন। তবে এই নামকরণ আমাকে আকৃষ্ট করেনি। কৈবর্তদের বিজয়ের ৩৭ বছরের ইতিহাসে নামটি প্রাসঙ্গিক মনে হয়নি।দিব্যোক-পপীপদের সংগ্রাম- মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। সাময়িকভাবে হলেও স্বাধীনতার স্বাদ তারা এনেদিয়েছিল। ১০৭৫ সালে মহিপালকে পরাজিত করে বরেন্দ্রর ক্ষমতা দখলে নেন দিব্যোক। তাঁর মৃত্যুর পর শাসন করেন ভাই রুদ্রক এরপর শাসক হন রুদ্রকের পুত্র ভীম। ভীমই রামপালের হাতে পরাস্ত হন।
জাকির তালুকদারের অনেকগুলো ছোটগল্প পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, আমাকেও মুগ্ধ করেছে। তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস ‘মুসলমানমঙ্গল’ ভাল লেগেছিল। শুধু সমাপ্তিতে মনে হয়েছিল, তিনি হঠাৎই মুসলমান হয়ে উঠেছিলেন।
তবুও দুই লেখকের কাছেই কৃতজ্ঞ দুটি ভাল উপন্যাস উপহার দেয়ার জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:৩৮