শরিয়ত সরকার চারমাস আগেই জামিনে মুক্ত হয়েছেন। খবরটি জাতীয় কোন দৈনিকেই দেখিনি। করোনা সংকটে সারাদেশেই গানবাজনার অনুষ্ঠান প্রায় বন্ধ। মাত্র কয়েকটি অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। ভাববাদী দর্শনের মানুষেরাও স্রষ্টারই আরাধনা করেন একভাবে। তারা গানের মাধ্যমেই ধর্মের কথা বলেন, স্রষ্টার আরাধনা করেন। এরপরও গানবাজনা না করার জন্য তিনি অহরহই হুমকি পান অন্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীর কাছ থেকে। ভাল লাগলো দেখে যে, তিনি গানবাজনা ছাড়েন নি। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে গত বছরের জানুয়ারিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। জঙ্গি গোষ্ঠীর হুমকি ধামকি ও হয়রাণিমূলক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছেন। পৃথিবীতে ৪৩০০টি ধর্ম। প্রত্যেক ধর্মের মানুষই নিজ ধর্মকে একমাত্র সত্য বলে ধরে নেয়। আবার অনেক ধর্মের ভিতরেও বহু মতপথ রয়েছে। সবাই সবার বিরুদ্ধে থাকে। নিজের অন্ধ বিশ্বাসটাকে সঠিক ধরে, অন্যের বিশ্বাসকে সকলেই ভ্রান্ত বলে। এর বাইরেও বহু মত-পথ রয়েছে। সকল বিশ্বাসীরাই অলৌকিক সত্ত্বার আরাধনা করেন নিজ দর্শন অনুযায়ী। শরিয়ত বয়াতিদেরও একটি দর্শন রয়েছে। তারা গান বাজনা করেই স্রষ্টাকে খুশি করতে চান। তারা ভুল না শুদ্ধ সেটা স্রষ্টাই বিচার করবেন। কিন্তু অনেকেই নিজেকে স্রষ্টার স্থানে স্থাপন করে নিজেই আখেরাতের বিচার এখনই করতে চায়। শরিয়ত বয়াতি তাদের আক্রোশের শিকার।
গানের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে আরেক বাউল শিল্পী রীতা দেওয়ানের নামেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। আজ তিনিও জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। পালাগানের একটি ধরন রয়েছে। মঞ্চে তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে তোপ দাগেন এবং আসর মাতিয়ে রাখেন।শ্রোতারা ভিন্ন মত শ্রবণ করেন এবং সত্যটা বুঝার চেষ্টা করেন। এই বিতর্কের মধ্য দিয়েই সমাজ আগায়, মানুষের বিকাশ ঘটে। তাদের বক্তব্যের খণ্ডন মঞ্চেই হয়। তাদের খণ্ডিত বক্তব্য উপস্থাপন করে তাদের জেল খাটানো কোন ভাবেই মানবতার মধ্যে পড়ে না। যদি শেষ পর্যন্ত প্রমাণ হয় তারা নির্দোষ তবে তাদের জেল খাটার দায় কে নিবে? এমন বর্বরতা সভ্য দেশগুলো মধ্যযুগেই পেছনে ফেলে এসেছে। তারা এখন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
ধর্মান্ধরা প্রখ্যাত লেখকদেরও অসম্মান করার চেষ্টা করেছে বারবার। এ কারণে পাদ্রী-পুরুতদের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করলে লিও তলস্তয়কে খ্রিস্ট ধর্ম থেকে বহিস্কার করা হয়। তিনি যখন মারা যান তখন পাদ্রী-পুরুতরা দল বেধে এসেছিলেন কিন্তু তাঁর অনুসারীরা তাদের কাছে ঘেঁষতে দেননি। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার শোকার্ত অনুরাগী কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াই তাঁর শবযাত্রায় শামিল হয়ে তাকে সমাহিত করেন। পাদ্রী-পুরোহিতরা কি তলস্তয়ের কোন ক্ষতি করতে পেরেছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়া সমাহীত হওয়ায় তার কোন ক্ষতি হয়নি। তিনি আজও মহান লেখক হিসেবেই বিশ্বজুড়ে পঠিত, নন্দিত এবং রয়েছেন শ্রদ্ধার আসনে। জঁ পল সাত্রের ক্ষেত্রেও দেখেছি- শেষ জীবনে তিনি অন্ধ ছিলেন। তাঁর সঙ্গিনী বোভ্যুয়ারও মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে শবযাত্রায় হেঁটেছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ। ইউরোপ বদলে গেছে। তারা ধর্মান্ধতা থেকে বের হয়ে ভাসছে বিজ্ঞানের আলোয়।
আর আমরা আজও অর্জন করতে পারিনি মানবাধিকারের সূচকগুলো। এখনো শিশু বলাৎকারের বিরুদ্ধে কথা বলা যায় না। ভোটাধিকার নিয়ে কথা বলা কঠিন। বাক স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতে পারি না। মত প্রকাশ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তারই শিকার হয়েছেন শরিয়ত বয়াতি আর রীতা দেওয়ান। এসব অতিক্রম করতে না পারলে সভ্য জাতি দাবি করার কোন সুযোগ থাকে না।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:২০