সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গত ১২ জুন সকালে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি ফাইটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের নির্বাহী আদেশে অস্থায়ী মুক্তি নিয়ে বিদেশে গেছেন, এটা সবার জানা আছে। কিন্তু তিনি কোন শর্তে বা সমঝোতার ভিত্তিতে গেছেন, সেটা অনেকেরই অজানা।
আওয়ামী লীগ নেত্রী ১১ জুন বিকেলে বিশেষ কারাগার থেকে বের হয়ে রাতটা পার করে পরদিন ভোরে চলে গেলেন বিমান বন্দরে। তাঁর পর লন্ডনে চার ঘন্টা ট্রানজিট শেষে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয়ের কাছে। ছেলের কাছে কিছুদিন থেকে তিনি কানাডায় মেয়ে পুতুলের কাছে যাবেন বলেও প্রচার আছে। তাঁর বিদেশ যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক অঙনে রেখে গেছেন অনেকগুলো প্রশ্ন।
যতই বলা হউক, বিচারাধীন দুর্নীতির মামলার আসামী শেখ হাসিনাকে চিকিৎসার জন্য বা মানবিক কারণে সরকার মুক্তি দিয়েছে; কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেকরা মনে করেন এটা সরকারের একটি রাজনৈতিক সীদ্ধান্ত। চলমান রাজনৈতিক সংকট ও সংলাপ, আগামী নির্বাচন ও বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘এক্সিট প্ল্যানকে’ বিবেচনায় রেখেই সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সমঝোতা হয়েছে।
কিন্তু কী সেই সমঝোতা বা কী শর্তে শেখ হাসিনা বিদেশ গেলেন এবং তা কতদিনের জন্য গেলেনÑএসব প্রশ্ন শুধু রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যেই নয়, সাধারণ মানুষের মাঝেও আলোচনার একটা বড় বিষয় ছিল গত সপ্তাহজুড়ে।
রাজনৈতিক অঙন ও সরকারী বিভিন্ন মহলে আলোচনা আছে, এবার বিদেশ যাত্রার আগে শেখ হাসিনার সঙ্গে সরকারের শুধু মৌখিক নয়, লিখিত সমঝোতা হয়েছে। কিন্তু সেটা কিÑএই ব্যাপারে শেখ হাসিনা নিজে কিছু বলেননি অদ্যাবধি। যদিও তাঁর দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেছেন, কোনো লিখিত চুক্তি বা শর্তে শেখ হাসিনা মুক্তি পাননি। কিন্তু একথা বিশ্বাসযোগ্য না পাওয়ার যৌক্তিক কারণ আছে।
বিভিন্ন মামলার হাজিরা দিতে গিয়ে শেখ হাসিনা বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অনেক কড়া সমালোচনামূলক কথা বললেও এবার মুক্তি পাওয়ার পর তিনি সরকারের বিরুদ্ধে তো কিছু বলেননি। বরং ওই রাতেই তিনি সরকারের চার উপদেষ্টার সঙ্গে সুধা সদনে বৈঠক করেছেন। তার আগে তিনি দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক করে সরকারের সঙ্গে চলমান রাজনৈতিক সংলাপে অংশ নেওয়া ও আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশ নেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছেন। তিনি জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে সংলাপের জন্য প্রতিনিধি দল গঠনেরও নির্দেশ দিয়ে গেছেন। দুইদিন পর আওয়ামী লীগ সংলাপে অংশ নিতে দলের নয় সদস্যের যে প্রতিনিধি দলের নাম ঘোষনা করেছে, তাতে একজন হচ্ছেন চট্টগ্রামের আতাউর রহমান খান কায়সার। এই নেতা এর আগে কখনও আলোচনায় ছিলেন না। হঠাৎ এই নামটি আসায়, সেটাও নতুন একটা প্রশ্নের জš§ দিয়েছে। জনাক কায়সারও অন্যান্য নেতাদের মত শেখ হাসিনা গ্রেপ্তারের পর সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
এবার শেখ হাসিনার বাকসংযমও সবার দৃষ্টি কেড়েছে। এটা তাঁর স্বভাবসুলভতার সম্পুর্ণ বিপরীতমুখি আচরন। বিশেষ কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর এখনও পর্যন্ত তিনি তেমন কোনো কথা বলেননি, যা রাজনৈতিক অঙনে আলোচনা হতে পারে বা সরকার বিব্রত হতে পারে। বিভিন্ন মহলে আলোচনা আছে, শর্তের কারণে তিনি এবার মুখ বন্ধ রেখেছেন। এও আলোচনা আছে, শেখ হাসিনার কানে অসুস্থ্য থাকলে, বাকযন্ত্রের কোনো সমস্যার কথা এ পর্যন্ত শোনা যায়নি। অবশ্য কারবন্দি অসুস্থ্য শেখ হাসিনার জন্য দলীয় অনুসারীদের যে উদ্বেগ ছিল, মুক্তির পাওয়ার পর বাসায় ফেরার পথে তারপর বিমান বন্দরে বিদায়কালে মিডিয়াতে তাঁর আনন্দময়, হাস্যচ্ছোল মুখ ও সাবলীল চলাফেরা ও মেহেদী রাঙানো হাতে বিদায় সম্ভাষণ দেখে সেই উদ্বেগ অনেকটা কেটেছে। যদিও তাঁর সমালোচকরা, তাঁর এই অসুস্থ্যতাকে ‘রাজনৈতিক অসুস্থ্যতা’ বলে প্রচার করতে চায়। তবে দেশে তাঁর চিকিৎসকরা স্পষ্টই বলেছেন, তাঁর কানের অবস্থা ভাল নয়, দ্রুত চিকিৎসা জরুরি।
কারো কারো মতে, অনেকদিন পর মুক্তি পাওয়া, দলীয় নেতা-কর্মীদের এতদিন পর কাছে পাওয়া, তারপর প্রবাসী ছেলে-মেয়ে-বোনকে দেখতে পাওয়ার খুশীতে তাঁকে অনেক সজিব-সুস্থ্য মনে হয়েছিল।
আবার শেখ হাসিনার এই নিরবতা বা বাকসংযম কতদিন থাকবে, তা নিয়েও সরকারী মহলে শঙ্কা আছে।
তাছাড়া সরকারের অস্থায়ী মুক্তির নির্দেশে বলা হয়েছে চিকিৎসার জন্য তাঁকে আট সপ্তহের জন্য মুক্তি দেওয়া হয়েছে; তাহলে কী আট সপ্তাহ পর আবার দেশে ফিরছেন। পর্যবেকরা আপাতত তেমন লণ দেখছেন না। তাহলে কী সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের মত শেখ হাসিনারও মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হবে, সেটা কতদিনের জন্য। তিনি কী আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন বা নিবেন? তাঁর মামলাগুলোর বিচারের কী হবে। আইনজীবীরা বলছেন, শেখ আদালত থেকে ব্যক্তিগত হাজির থেকে অব্যহতর অনুমতি পেয়েছেন। এখন তাঁর অনুপস্থিতিতে বিচার চলবে বা চলতে বাঁধা নেই। তাহলে কী দুর্নীতির মামলার রায় হয়ে যাবে তাঁর অনুপস্থিতে? তিনি কী রায়ের পর দেশে ফিরে এসে আইনী লড়াইয়ে নামবেন নাকি পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টোর মত লম্বা সময় বিদেশে থাকতে হতে পারে তাকে? তিনি যদি ফিরে আসেন, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ না পান, তাহলে কী নির্বাচন বর্জন করবেন, নাকি দলীয় প্রধানের পদ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবেন। দলের সংস্কারপন্থি নেতাদের ব্যাপারেও তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নিবেন কি না, এসব জল্পনা-কল্পনাও কম নাই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো ও পর্যবেক মহলের মতে, কারবন্দি অপর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠানোর প্রচেষ্টা সফল হলে, আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে পুরো দৃশ্যপট স্পষ্ট হয়ে উঠবে এবং এসব প্রশ্নের অনেক জবাবও বেরিয়ে আসবে। তবে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠাতে না পারলে, তাতে শেখ হাসিনার ভূমিকার নাটকীয় পরিবর্তনও দেখা দিতে পার।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০০৮ রাত ৯:৪৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




