somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মুঃ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল)
নিজেকে বোঝার আগেই মনের মধ্যে একটা চেতনা তাড়া করে ফিরতো। এই ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে বদলাতে হবে, একটা বিপ্লব দরকার। কিন্তু কিভাবে?বিপ্লবের হাতিয়ার কি? অনেক ভেবেছি। একদিন মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে উঠলো একটি শব্দ, বিপ্লবের হাতিয়ার 'কলম'।

বরফে ঢাকা আল্পস ভ্রমণের দিনগুলো (পর্ব-৪ শামনি গ্রাম)

২৩ শে মে, ২০২৩ ভোর ৪:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২৩ ডিসেম্বর ২০২১,আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনায় দিনটি ছিল ফ্রান্সের সীমান্তবর্তী দেশ সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহর পরিদর্শন। ছা- জারভে লে বাঁ লো ফায়ে St-Gervais-les-Bains-le-Fayet থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরের শহর। ট্রেনে করে পৌনে দুই ঘণ্টার যাত্রা পথ।২২ ডিসেম্বর, শামনি থেকে বাসায় ফিরে আমাদের সিদ্ধান্ত অটুট থাকলেও সকালে ঘুম থেকে উঠেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘুম থেকে উঠে সুমি ও মিশেলকে জাগানোর চেষ্টা করতেই ঘুম চোখে সুমি জবাব দিলো, আমি জেনেভা যাবো না, শরীর বেশ ক্লান্ত ,আমাকে আরও ঘুমোতে হবে।ওর কথায় মুহূর্তেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমি আগে থেকেই আশা করে ছিলাম যে এই ভ্রমণের ভেতর দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশটিতে একটু পদচিহ্ন রেখে আসবো।আর এখান থেকে অল্প খরচে দিনে দিনে ঘুরে আসা একটা সুযোগও বটে।সুমির কথায় বুঝলাম ও সিদ্ধান্তে অটুট।তাই ওকে বিরক্ত না করে বললাম,তাহলে আমি একাই জেনেভা যাবো, তুমি মিশেলকে নিয়ে আশেপাশের কোন শহর থেকে ঘুরে এসো।সে অনুযায়ী ওদেরকে রেখে দিনের ভ্রমণ প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পরলাম।

ছা- জারভে লে বাঁ লো ফায়ে স্টেশনে গিয়ে প্রথমেই দিনে দিনে জেনেভা শহরের যাওয়া ও ফিরে আসার ট্রেনের সময় সূচী জেনে নিলাম।কিন্তু ঐ মুহূর্তে একটু অংক করে মনে হল, জেনেভা থেকে দিনের শেষ যে ট্রেনটি ফিরবে সেই ট্রেন ধরলে আমি ঐ শহরে মাত্র দু ঘণ্টার মত অবস্থান করতে পারবো। এমতাবস্থায় জেনেভা গেলেও কোথাও ঘোরার সুযোগ নাই। কারণ, নতুন শহরে কোন কিছু খুঁজে বের করতে বা কাউকে কোন তথ্য জিজ্ঞেস করতে করতেই দু ঘণ্টা সময় চলে যাবে।তাই জেনেভা যাওয়ার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ট্রেনের টিকেট কাটলাম Auvergne-Rhône-Alpes অঞ্চলের একটি পর্যটন শহর আনেছি « Annecy » যাওয়ার। ট্রেন ছাড়তে প্রায় ত্রিশ মিনিট বাকি।টিকেট হাতে স্টেশনের অপেক্ষমাণ কক্ষে বসে আছি।আবারও এক দোদুল্যমান ভাবনা ভর করলো মনের মধ্যে।ভাবছি, এক সাথে ঘুরতে এসে ওদেরকে রেখে যাওয়া কি ভালো হচ্ছে ?

কোন নতুন জায়গায় গেলে অচেনা অঞ্চল আবিষ্কারের নেশা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।আমার উদ্দাম ও গতির সঙ্গে ওরা তাল মেলাতে পারে না।ওদের বৈশিষ্ট্য হল, একটা জায়গায় গিয়ে ধিরস্থির ভাবে ঘুরবে,রেস্তরাঁয় বসে জলখাবার খাবে, আয়েশি শরীরে আবার বাসায় ফিরে আসবে।আমাদের তিন সদস্যের ভ্রমণ দল রুচি ও চলার বৈশিষ্ট্যগত কারণে দুই ভাগে বিভক্ত। তাই আমাদের পরিকল্পিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা প্রায়ই সম্ভব হয়ে ওঠে না ।

মনে হল,যেহেতু জেনেভা যাওয়া হচ্ছেনা তাই একা একা আনেছি « Annecy » যাওয়ার চেয়ে ওদেরকে নিয়ে বরং একসাথে আশেপাশের একটা শহরে গিয়ে ঘুরেফিরে দিনটা কাটিয়ে দিলেই ভালো হবে।সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবার টিকেট কাউন্টারে গিয়ে এক ইউরো ক্ষতিপূরণে আনেছি যাওয়ার টিকেট ফেরত দিলাম।নিজের মধ্যে এতক্ষণ কোথাও যাওয়া নিয়ে যে অস্থিরতা কাজ করছিল তা থেকে স্বস্তি অনুভব হলে লাগলো।সুমিকে ফোন করে বললাম,আমি একা কোথাও যাচ্ছিনা,তোমরা তৈরি হয়ে ট্রেন স্টেশনে চলে এসো,তিনজন একসাথে কোথাও ঘুরতে যাবো।

ওরা শরীরের ক্লান্তি কাটিয়ে ছুটির দিনের মত হেলাফেলা করে দিনের মধ্যাহ্নে ট্রেন ষ্টেশনে এলো।সিদ্ধান্ত নিলাম বাসে করে পাহাড়ি অঞ্চলটা দেখতে দেখতে কোন একটা শহর বা গ্রামে নেমে যাবো,দুপুরের খাবার সেখানকার একটা রেস্তরাঁয় খাবো,এরপর সন্ধ্যায় ফিরে আসবো।

ষ্টেশনের পাশেই বাস ষ্টেশন।এখান থেকে কয়েকটি বাস Auvergne-Rhône-Alpes অঞ্চলের দূরবর্তী বিভিন্ন শহরের দিকে যায়।একজন বাস চালক যাত্রীর অপেক্ষায় নিজের আসনে বসে যাত্রা অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।বাস যাত্রীশূন্য।আমি চালকের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বাস কোথায় যাবে? ভদ্রলোক জানালো, শামনি সন্ত ভিল।ঐ মুহূর্তে স্টেশনে এই বাস ছাড়া আর কোন বাস চোখে পরল না।গতকাল আমরা শামনি থেকে ঘুরে এসেছি ,তাই একই জায়গায় দুবার যাওয়ার ইচ্ছে আমার একেবারেই নেই।সুমিকে বিষয়টি জানালাম।ও বলল, যদি অন্য শহরে যাওয়ার বাস না থাকে তবে সময় নষ্ট না করে আবার শামনি’র দিকে যাওয়া যেতে পারে। যাহোক, অনেকটা উপায়ন্ত না পেয়ে এই বাসেই উঠে বসতে হল। বিশাল বড় বাসে যাত্রী শুধু আমরা তিনজন।কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা চেনা শহরের দিকে পুনরায় যাত্রা শুরু করলাম।বাস পাহাড়ি কোল ঘেঁষা পথ ধরে কিছুটা যাওয়ার পর মনে হল,দিনটা একেবারে নষ্ট হবে না।এভাবে প্রায় দশ মিনিটের পথ অতিক্রমের পর বাস প্রবেশ করলো পাহাড়ি উপত্যকা ভূমিতে।রাস্তার দুপাশে ঘন গাছপালা ঘেরা গ্রামীর বাড়িঘর কিন্তু কোন প্রাণের আনাগোনা নেই।গতদিন ট্রেন থেকে যেভাবে এই গ্রামীণ জনপদকে দেখেছি সেই একই গ্রামের দৃশ্য ভিন্ন রূপে ধরা দিতে লাগলো।আমি বাস চালকে প্রশ্ন করলাম, আমরা যদি পরের স্টপেজে নেমে যাই তবে শামনি যেতে আবার টিকেট কিনতে হবে কি? চালক জানালো,আজের দিনের যে কোন সময় একই টিকেটে আমরা বাসে করে শামনি যেতে পারবো, এজন্য আর টিকেট কিনতে হবে না।চালকের কথায় আশ্বস্ত হয়ে সুমির সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিলাম, পরের স্টপেজে নেমে আশেপাশের অঞ্চল হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখব,এরপর পরবর্তী কোন বাসে করে আবার শামনির উদ্দেশ্যে রওনা করবো।যখন দ্রুত গতিতে বাস চলছিল, তখন চারপাশের স্বর্গীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছিলো যদি এখনি বাস থেকে নেমে এই এলাকাগুলো হেঁটে দেখতে পারতাম তবে মনের প্রশান্তি মিলত।বাস কিছুক্ষণ পর একটা স্টপেজে থেমে একজন যাত্রী তুলে নিলো কিন্তু আমাদের সেখানে নামা হল না। সুমি বলল, আরও দূরের স্টপেজে নামবে।এতে আমার আপসোস আরও বাড়তে লাগলো। বাস চলার সময় আরও মনোরম প্রকৃতি পারি দিয়ে আমরা এগুতে লাগলাম।পরের স্টপেজে বাস থামতেই আমরা নেমে পরলাম।নিস্তব্ধ বরফে ঢাকা হিমশীতল গ্রাম।আমরা একটি গ্রামীণ রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে লাগলাম। স্থানীয়দের বৈচিত্র্যময় স্থাপত্য নক্সার ছোট ছোট বাড়ীঘর।বাড়ীর সানসেটগুলোতে দীর্ঘদিনের তুষারের আবরণ লম্বা কাঠির মত হয়ে ঝুলে আছে। দূর থেকে জমাটবদ্ধ তুষারের এই কাঠি দেখে যে কারো মনে হবে যে বাড়ীর সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ক্রিস্টাল গ্লাস দিয়ে সানসেটগুলোকে এমন নক্সা করা হয়েছে। বরফের কাঠিগুলোর উপর সূর্যের আলো পড়ায় ঝিকমিক করছে।এগুলো ধরে দেখার কৌতূহল নিয়ে আমি একটি বাড়ীর সানসেটের কাছে গেলাম।ধরে মনে হল,এগুলো তুষার জমা বরফ হলেও দৃঢ়টা কাঁচের মত।অসাবধানতার সহিত ভাঙতে গেলে হাত কেটে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
আমরা গ্রামের সুশৃঙ্খল পথ ধরে কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়ালাম, ছবি তুললাম তার পর আবার ফিরে এলাম বাস স্টপেজে।স্টপেজের ডিজিটাল টাইম বোর্ডের সময়সূচি অনুযায়ী বাস আসতে আরও পনের মিনিট বাকি।বয়ে চলা সোমা নেপোলিয়(রাস্তা নেপলিয়ান)পাশে একটি দৃষ্টিনন্দন হোটেল।নাম দেগুই দু মিদি (d’Aiguille du Midi Hôtel)।চার তলা হোটেলটি দেখতে আমাদের দেশের কুঁড়েঘরের মত। হোটেলটির আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করে আমাদের অপেক্ষার সময় পার হল।

বাস আসতেই আমরা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে আবার বাসে উঠলাম। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, যদি সারাটা দিন ইচ্ছে মত এই ভূস্বর্গের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ছবি তুলে কাটিয়ে দিতে পারতাম তবে পরিপূর্ণ ভ্রমণ তৃপ্তি মিলত।চারপাশে যে দিকেই তাকাই সেদিকটাই যেন শিল্পীর আঁকা ছবির মত।চাইলেইতো আমি ওদেরকে রেখে সেটা করতে পারবোনা ,তাই অলীক ভাবনাকে মনের মধ্যে চাপা দিয়ে গল্প কথায় বাসের জানালা দিয়ে একসাথে প্রকৃতি উপভোগে মেতে উঠলাম।

শামনি শহর যেহেতু ওদের চেনা তাই সুমিকে বললাম, আমি সন্ত ভিলের (সিটি সেন্টার)আগের স্টপেজে নেমে একটু ঘোরাঘুরি করে পরে শামমিতে আসতে চাই,তোমাদের যেতে কোন অসুবিধা হবে নাতো।ও আশ্বস্ত করে জানালো ওরা একা যেতে পারবে।ওর সম্মতিতে আমি শামনি’র এক স্টপেজ আগেই ওদেরকে বাসে রেখে নেমে পরলাম।বেশ ঘনবসতি আবাসিক এলাকা।বয়ে চলা লারভ l’Arve নদীর দুপাশ দিয়ে গড়ে উঠেছে এসব বশত বাড়ী।একটু দূরে হোটেল,রেস্টুরেন্ট ও শপিং সেন্টারে মানুষের কোলাহল কিছুটা শহুরে ইমেজ সৃষ্টি করেছে।গ্রামটির নাম এগুই দু মিদি (d’Aiguille du Midi)

কিছুক্ষণ পর সুমি ফোন করে জানালো, ওরা শামনি পৌঁছে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘোরাঘুরি করছে।ওর কথায় অনেকটা স্বস্তি নিয়ে প্রায় ঘণ্টা খানেক এই গ্রামে নিজের মত ঘুরে ফিরে সময় কাটালাম। শামনি সন্ত ভিলে পৌঁছে ওদেরকে খুঁজে পেতে খুব বেশী বেগ পোহাতে হল না শহরটা চেনা থাকার কারণে।একসাথে মিলিত হয়ে আমরা প্রথমেই একটি ফরাসি রেস্তরাঁয় ঢুকে শামনির ঐতিহ্যবাহী পিজা ও কোকাকোলা দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম।
চারপাশের পাহাড়ের চূড়া ছুঁইছুঁই সাদা মেঘের বিচরণ,তার উপর সূর্যের তির্যক আলোর রশ্মি পরে অদ্ভুত সুন্দর এক আবহ তৈরি করেছে।এমন একটি আলো ঝলমল পড়ন্ত দুপুর আমরা শহরে আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করে উপভোগ করলাম।এরপর চেনা শহরে উদ্দেশ্যহীন পায়চারি।আমি ওদের সাথে হাঁটলেও আমার মন পরে আছে বাসের মধ্যে থেকে দেখা বয়ে চলা লারভ l’Arve নদীর দুপাশের পাহাড় আর বনভূমির সম্মিলনে সৃষ্টি অবারিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কাছে।আসার সময় আপসোস হচ্ছিলো, যদি এই দৃশ্যগুলো ক্যামেরা বন্দি করতে পারতাম।মনে মনে ভাবছি,শহর থেকে বেরিয়ে ওদেরকে নিয়ে গ্রামে দিকে গিয়ে দিনের শেষ সময়টুকু কাটানোর কথা। কিন্তু,আমি জানতাম ঐ মুহূর্তে ওদেরকে এমন প্রস্তাব দিলে রাজি হত না। কারণ,গন্তব্যহীন হাঁটাহাঁটি ওদের পছন্দ না।

সুমিকে বললাম,আমি যদি ছবি তোলার জন্য এগুই দু মিদি গ্রামের দিকে যাই তবে তোমরা কি নিজের মত করে ঘুরেফিরে আমাকে ছাড়া বাসায় ফিরতে পারবে? ও বলল, পারবে। ওর আশ্বস্তায় আর দেরি না করে ওদের থেকে বিদায় নিলাম।সন্ত ভিল থেকে বাসে করে রওনা করলাম গন্তব্যহীন শামনি'র গ্রামীণ এলাকার দিকে।প্রায় দুই কিলোমিটার পথ পারি দেয়ার পর একটি স্টপেজে নেমে পরলাম।খুবই নির্জন স্থান।পাহাড়ি উপত্যকার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা লারভ l’Arve নদী এক পাশে বয়ে গেছে মহাসড়ক, অন্যপাশে রেল লাইন,আর বরফের আবরণে ঢাকা গাছপালার মধ্যে নয়নাভিরাম ছোট ছোট বাড়িঘর।আমি প্রায় ত্রিশ মিনিট মহাসড়ক ধরে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যেতে লাগলাম।এমন এক রাস্তা দিয়ে আমি হাঁটছিলাম যে হঠাৎ কোন প্রকার বিপদের কবলে পরলে কারো সাহায্য পাওয়া সম্ভব নয়।এই সময়ের মধ্যে আমার সামনে দিয়ে পার হয়েছে দু তিনটি মটরগাড়ি আর স্থানীয় দুই একজন মানুষ।মানুষের নির্বাসন জীবনের অনুভূতি কেমন হতে পারে তা ওই সময়টুকুর মধ্যে কিছুটা হলেও আমি উপলব্ধি করেছি। বাসের সময় সূচি না জানা থাকায় কিছুটা শঙ্কা হচ্ছিলো,সন্ধ্যায় শামনি শহরে ফেরার বাস পাবো কিনা।রাতের অন্ধকার নেমে আসলে জনমানবহীন এমন পাহাড়ি এলাকায় একা একা হাঁটা যে কোন নতুন মানুষের জন্য ভয়ের ব্যাপার।চারপাশের অপার সৌন্দর্য আর ছবি তোলার নেশার কাছে মনের মধ্যে জেগে বসা শঙ্কার কালো মেঘ ঘনীভূত হতে পারছিলো না। আমি দুর্দম গতি হাঁটতে হাঁটতে দিনের একেবারে পড়ন্ত বেলায় এমন এক অদ্ভুত জায়গায় এসে দাঁড়ালাম, যে জায়গার দৃশ্যপট শুধু কল্পনা করা যায়, বাস্তবে প্রত্যাশা করা যায়না।কিন্তু, আমি সেই কল্পনার বাস্তব দৃশ্যের সামনেই স্বপ্নের মত দাঁড়িয়ে আছি তা ভেবেই শিহরিত হচ্ছিলাম।লারভ নদীর একটি সেতুর মাঝে অবস্থান নিলাম। দুই দিগন্তের দৃশ্যপট দু ভাবে ধরা দিলো আমার সামনে।একদিকে, সরু লারভ l’Arve নদীর বরফ শীতল জল তির-তির করে বয়ে চলছে,নদীর দুধার সাদা বরফে আবৃত, মাঝে মাঝে কিছু জংলা গাছপালা তুষার মেখে স্থির দাঁড়িয়ে আছে,সুদূরে নদীর বাঁকে ছোট্ট কুঁড়েঘর আকৃতির একটি নীড়, তার ওপারে মনে হচ্ছে দুপাশের পাহাড় যেন ধনুকের মত বেঁকে এক হয়ে গেছে।অন্যদিকে, লারভ বয়ে গেছে একটু এঁকেবেঁকে,হাঁটুজলের মাঝে কোথাও কোথাও শরীর ভাসিয়ে স্থির হয়ে আছে ছোট বড় আকৃতির পাথর খণ্ড।প্রতিটি পাথর খণ্ডের উপর সাদা বরফের আবরণ ফেলে প্রকৃতি যেন লারভ নদীর বুককে ভিন্ন রূপে অলঙ্কৃত করে তুলেছে।নদীর পারে মাঝে মাঝে গাড় খয়েরি রঙা সুশৃঙ্খল ডালপালার উপর বরফ জরিয়ে দাঁড়িয়েছে আছে পাইন গাছের দল।আল্পসে ঘেরা এমন এক নির্জন প্রকৃতির মাঝে সমস্ত চিন্তার জাল ছিন্ন করে আমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলাম কিছুক্ষণের জন্য।সুমিকে ফোনে বললাম,মনে হচ্ছে তোমরা বড় কিছু থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করলে।ওরা ট্রেনে করে ছা- জারভে লে বাঁ লো ফায়ে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে,আমি জানালাম, আরও কিছু সময় এখানে অবস্থান করে তার পর আমিও ফিরবো।

দূর পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যের সোনালি আলোর আভা ছড়িয়ে পড়েছে।বুঝলাম সূর্য অস্তাচলের পথে।তাই জনমানবহীন এলাকা ছেড়ে আবার মহাসড়ক ধরে বাস স্টেশন খুঁজতে হাঁটতে লাগলাম।কিন্তু, হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে গেলাম ট্রেন স্টেশন লে পেলোরা les pélerins।ফলে, আমাকে আর শামনি শহরে ফেরার প্রয়োজন হল না। এখান থেকেই বাসায় ফেরায় উপায় হল।স্টেশনে ছা- জারভে লে বাঁ লো ফায়ে যাওয়ার ট্রেন আসতে ত্রিশ মিনিট বাকি।ধীরে ধীরে আল্পসের বুকে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে লাগলো।বন পাহাড়ের গ্রামে জ্বলে উঠল বৈদ্যুতিক বাতি, আর দিনের আলো ফুরানোর সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি থেকে মিলিয়ে যেতে লাগলো লে পেলোরা’র চতুর্দিকের আল্পসের প্রাচীর। অচেনা রাতের গ্রাম,একলা আমি লে পেলোরা’র les pélerins প্লাটফর্মে ট্রেনের জন্য অপেক্ষমাণ।এই স্টেশন পারি দিয়েই কিছুক্ষণ আগে নীড়ে ফিরেছে মিশেল আর সুমি।ওরা যদি জানতো আমি এই এলাকায় অবস্থায় করছি, তবে হয়তো আমাকে তুলে নেয়ার জন্য নেমে পরত লে পেলোরাতে, আমার জন্য অপেক্ষা করতো লে পেলোরা'র প্লাটফর্মে।


বরফে ঢাকা আল্পস ভ্রমণের দিনগুলো (পর্ব-১)

বরফে ঢাকা আল্পস ভ্রমণের দিনগুলো (পর্ব-২ , মোঁ ব্লঁ)

বরফে ঢাকা আল্পস ভ্রমণের দিনগুলো (পর্ব-৩ শামনি)

সাম্য সম্মান সুন্দর ধরিত্রী

মুহাম্মদ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল)
পারিস ,ফ্রান্স ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০২৩ বিকাল ৩:১৮
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বনাম তরুণশক্তিঃ লিমিট, ব্যালেন্স, সিস্টেম বোঝাটা খুব জরুরী

লিখেছেন শেহজাদ আমান, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:০৬



লিমিট, ব্যালেন্স ও সিস্টেমটা বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনের শক্তিধর সংগঠনগুলোকে বুঝতে হবে। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম যখন বলে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বতী সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে চাচ্ছে, তখন সেটা যৌক্তিক শোনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রিয় কবি হেলাল হাফিজ আর নেই

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩২





'যে জলে আগুন জ্বলে'র কবি হেলাল হাফিজ মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।

আজ শুক্রবার দুপুর ২টা ৪০ মিনিটের দিকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসকরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

লাগবা বাজি?

লিখেছেন জটিল ভাই, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৫০

♦أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشِّيْطَانِ الرَّجِيْمِ (বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহ্'র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি)
♦بِسْمِ ٱللَّٰهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ (পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্'র নামে)
♦ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)


(ছবি নেট হতে)

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছলনার বালুচরে

লিখেছেন আজব লিংকন, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৩



কিছু প্রশ্নের উত্তর তুমি নিরবতায় খুঁজে নিও
ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে ভুলগুলো বুঝে নিও।।
ছলনার বালুচরে মোহ মায়া ছুঁড়ে দিয়ে
বিষাদের প্রবল স্রোতে তুমি নিজেকে খুঁজে নিও।।

বুঝে নিও।।
ছটফটানিতে গিলে খায়
জীবনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হায়রে সিইও, কী করলি জীবনে....

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫

ছবি রয়টার্স

দেশের বিখ্যাত কোম্পানীর সিইও হোটেল থেকে বের হয়েছেন, এমন সময় তাকে একজন ঠান্ডা মাথায় গুলি করে খুন করল। সিসিটিভিতে সেই গুলি করার দৃশ্য স্পষ্ট ধরা পড়ল। এখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×