আমাদের আল্পস ভ্রমণ সূচীর প্রধান আকর্ষণের স্থান ছিল শামনি শহর ।যাদের ভ্রমণের নেশা রয়েছে এবং ভ্রমণ সম্পর্কে জানাশোনার চেষ্টা করেন তাদের কাছে ফ্রান্সের শামনি শহর একটি স্বপ্নের নাম।
আমার ইচ্ছের সঙ্গে সুমি ও মিশেল সহমত পোষণ করলো। ওদের বেরুবার প্রস্তুতি নিতে বেশ সময় লাগবে। তাই ভাবলাম, ওদের প্রস্তুতির সময়টুকুর মধ্যে বাসার পাশের পার্ক থার্মাল (Parc Thermal)এ গিয়ে সকালের প্রকৃতির উপর কিছু আলোকচিত্র ধারণের চেষ্টা করা যেতে পারে।সকালের নাস্তা সেরে আমার আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্র নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পরলাম, আর সুমিকে বললাম, বাসা থেকে বেরুবার সময় আমাকে একটা কল করতে। ছা- জারভে লে বাঁ লো ফায়ে (St-Gervais-les-Bains-le-Fayet) আসার প্রথম দিন পার্ক থার্মালের প্রবেশ দরজা দেখে ভেবেছিলাম, এখানে অবস্থান কালের কোন এক সময় পার্কের ভেতরটা পরিদর্শন করতে হবে।
পার্কের ঢুকে কিছুটা পথ এগিয়ে মনে হল, তুষারে আবৃত গাছপালায় ঢাকা পাহাড়ী বেষ্টনীর কারণে পার্কটির ভেতরে আলো অন্ধকারের ভৌতিক এক আবহের সৃষ্টি করেছে।পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে একটি ক্যানাল বা নালা।নালা মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরের উপর দীর্ঘদিনের জমে থাকা তুষার কঠিন বরফে রূপান্তর হয়ে মুক্তার মত চিকচিক করছে। নালাটিতে পানির প্রবাহ তেমন নেই।।পাহাড় থেকে বয়ে আসা পানির ধারা পাথরের গায়ে গায়ে লেগে কল কল ধ্বনি তুলে ধীর গতিতে বয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের প্রাচীর টপকে সূর্যের তির্যক রশ্মি প্রাচীন বৃক্ষ শাখা ভেদ করে এমন ভাবে পড়েছে যে মনে হচ্ছে পাহাড়ের ওপার থেকে প্রোজেক্টরের আলো ফেলা হয়েছে ভূমির উপর। সবমিলিয়ে শৈল্পিক আলোকচিত্র ধারণের জন্য যেমন প্রকৃতি প্রত্যাশা করেছিলাম ঠিক তেমন আবহ পার্কটির ভেতরে বিরাজমান। ভূমির উপর দীর্ঘদিনের তুষারের জমে থাকা স্তর কংক্রিটের পাটাতনে পরিণত হয়ে আছে। তাই পার্কের ভেতরের রাস্তা ছাড়া অন্য জায়গা দিয়ে হাঁটা বেশ বিপদজনক।তবুও ছবি তোলার নেশায় ঝুঁকি নিয়েই পার্কের বরফের ভূমির উপর ঘুরে ঘুরে বেশ কিছু পছন্দের ল্যান্ডস্কেপ তোলার কাজ সেরে ফেললাম।
প্রকৃতির অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি পার্ক, কিন্তু বাইরের প্রবেশ দ্বার দেখে তেমনটা অনুধাবন করা যায় না।মনে হল, এখানে না আসলে আল্পস ভ্রমণটা অসম্পূর্ণই থেকে যেত।
মোবাইল ফোনের স্কিনে চোখ রাখরেই দেখি,কল লিস্টে সুমির বেশ কয়েটা কল উঠে আছে। ছবি তোলার গভীর মগ্নতা আর প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য ফোনের রিংটোনের আওয়াজ কানে পৌছুতে দেয়নি। আমি ওকে দ্রুত ফোন করলাম, ও জানালো ওরা ট্রেন স্টেশনে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।তাই,পার্ক থার্মাল থেকে দ্রুত বেরিয়ে সোজা চলে গেলাম ট্রেন স্টেশনে।ওরা দুজন অপেক্ষমাণ কক্ষে বসে আছে। ওদের সাথে দেখা করেই চলে গেলাম ষ্টেশনের টিকেট কাউন্টারে।স্টেশনে যাত্রীর হুড়োহুড়ি নেই। কাউন্টারের কর্তাব্যক্তি বেশ আয়েশী সময় পার করছে।ভদ্রলোক জানালো শামনি যাওয়ার পরবর্তী ট্রেন পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর।কি আর করার,টিকিট কেটে বসে থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই।কিন্তু, এতো সময় ষ্টেশনে বসে থাকা আমার জন্য অস্বস্তিকর তাই ওদেরকে বসিয়ে রেখে আমি আবার বেরিয়ে পরলাম, আশপাশটা ঘুরে দেখার জন্য। কুয়াশাহীন রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া কারণে চারপাশের পাহাড়ের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠেছে।কুয়াশার কারণে অন্য সময় দূর পাহাড়ের দৃশ্য এতো স্পষ্ট সাধারণত দেখা যায় না।
ঘোরাঘুরি করে ট্রেন ছাড়ার পনেরো মিনিট পূর্বে ষ্টেশনে চলে এলাম। ওদের সঙ্গে গল্প করতে করতে আমাদের ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এলো।তাই পাঁচ মিনিট সময় হাতে রেখে আমরা ট্রেনে প্রবেশ করলাম। লোকাল ট্রেন কিন্তু ভেতরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।টয়লেট,মোবাইল চার্জ দেবার ব্যবস্থা সহ সব ধরণের যাত্রী সুবিধা রয়েছে ভেতরে। আমাদের পঁয়তাল্লিশ মিনিটের যাত্রাপথ।মাঝে দশটি স্টেশনে স্বল্প সময়ের বিরতি নিয়ে ট্রেন পৌঁছুবে শামনি মোঁ ব্ল স্টেশনে।দিনের মধ্যভাগেের নির্ধারিত সময়ে ট্রেন যাত্রা শুরু করলো।কিছু দূর এগুনোর পর থেকে শুরু হল বিস্ময়।ট্রেন যতই পথ পাড়ি দিতে লাগলো আমাদের বিস্ময় ততই বাড়তে লাগলো।
রেলপথের দুপাশেই পাহাড়ি প্রকৃতি।পাহাড়ের পাদদেশের সমভূমিতে গড়ে উঠেছে ছোটো ছোটো সাজানো গোছানো গ্রাম। গ্রামগুলো সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ।সুশৃঙ্খলিত গ্রামগুলোর ছোট্ট বাড়ীগুলো দৃষ্টিনন্দন ও বৈচিত্র্যময় নান্দনিকতায় ভরা ।তুষারের শুভ্রতায় স্বর্গীয় এক আবহ তৈরি হয়ে আছে। দূর থেকে মনে হচ্ছিলো, গ্রামগুলোকে যেন কোনও এক বিশেষ আনন্দ উৎসবের জন্য সাজানো হয়েছে।
ভাবছিলাম, Auvergne-Rhône-Alpes অঞ্চলের আজকের যে সহজ জীবন যাপন ও সৌন্দর্যের যে দৃশ্যপট দৃশ্যমান তা এক দিনে কি তৈরি হয়েছে? সম্পূর্ণ এক বৈরি প্রকৃতিকে পরিপূর্ণ শাসনের মধ্যে নিয়ে আসতে এখানকার মানুষকে কতই না শ্রম ঘাম ঝরাতে হয়েছে।যেখানে ফসল উৎপাদনের আবাদযোগ্য একখণ্ড কৃষি জমি নেই, সেই অবাসযোগ্য অঞ্চল আজ হয়ে উঠেছে পর্যটনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল।নাগরিক জীবনের সমস্ত সুবিধা আজ স্থানীয়দের হাতের নাগালে।
কোথাও নিম্নাঞ্চলের সড়কের সঙ্গে পাহাড়ের গায়ে বয়ে যাওয়া রাস্তার সংযোগের জন্য সুউচ্চ পিলার দ্বারা নির্মাণ করা হয়েছে ফ্লাই ওভার ব্রিজ।আবার কোথাও পাহাড়ের শরীর কেটে সুরঙ্গ তৈরি করে করা হয়েছে রেলপথ।
রেলপথের দুইধারের কোল ঘেঁষে কোথাও পাহাড়ের বৈচিত্র্যময় দৃশ্য, পথের দুই ধারে মাঝে মাঝে সাড়ি সাড়ি ঘন গাছের ছোট ছোট বন।এক পাশ দিয়ে ছোট্ট নদীর বুকে বয়ে চলছে বরফ শীতল জলের ধারা। নদীর দুই ধারের তুষারের আবৃত ঘন জংলা গাছগাছালির নদীর জল ছুঁয়ে চুপচাপ স্থির হয়ে থাকার দৃশ্য যেন ক্যানভাসের ছবির মত ।
আমরা যখন ট্রেনের মধ্যে ছিলাম তখন আমি আর মিশেল দুজনেই ক্যামেরায় দৃশ্য ধারণে এতো ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম যে,মনে হচ্ছিলো একটু বেখেয়াল হলেই কোন নতুন সৌন্দর্যের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবো।
আমার কেন যেন মনে হচ্ছিলো, আজ আমার পৃথিবীতে আসা সার্থক। স্রষ্টার উপহার দু চোখকে যদি এমন সৌন্দর্যের স্বাদ আস্বাদন না করিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতাম তাহলে বড় এক অপূর্ণতা থেকে যেতো। কল্পকাহিনীর সিনেমাগুলোতে সাধারণত যেমন দৃশ্য অ্যানিমেশন করে দেখান হয়, আমি অনুভব করছিলাম ঠিক সেই দৃশ্যের বাস্তবত ভূমিতে আমরা অবস্থান করছি।আল্পস অঞ্চলের যেসব ছবি ও ভিডিও দেখে একসময় অভিভূত হতাম সেসব ছবির চেয়ে বাস্তব দৃশ্য আমার মনে বেশী মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছিল।
আমরা পৃথিবীর বেশীর ভাগ মানুষ এই বিশ্বের কোন এক প্রান্তে জন্মগ্রহণ করে ঐ প্রান্ত থেকেই বিদায় নেই।কিন্তু, আমাদের এই ধরিত্রী যে কত বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যে ভরপুর তার কিঞ্চিত অংশও দুচোখ মেলে দেখার সৌভাগ্য হয়না।পৃথিবীর কোথাও সমভূমিতে ফসলী মাঠের বাতাসে নেচে চলা,কোথাও আকাশমুখী পাহাড়ের দাঁড়িয়ে থাকা,কোথাও বৃক্ষরাজিহীন উত্তপ্ত ধূধূ মরু প্রান্তর,কোথাও আগুনের লাভা উদগীরণকারী আগ্নেয়গিরি,কোথাও সবুজে সবুজময় প্রাণ প্রকৃতিতে ভরপুর বনভূমি,কোথাও অবিরাম ঝরে পড়া স্বচ্ছ জলের ঝর্নাধারা, কোথাও তুষার ধবল বরফে ঢাকা অঞ্চল,আবার কোথাও ধুধু জলরাশির নীলচে সমুদ্র। এই বৈচিত্র্যতার সবকিছু যে মানুষ দেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারলো,আমার মনে সেই মানুষটিই পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান।যে মানুষ সারা জীবন অর্থ উপার্জন করে শুধু ব্যাঙ্কের জমা অর্থের পরিমাণের অংক দেখে জীবন কাঁটালো কিন্তু দুচোখ মেলে পৃথিবীর এই বৈচিত্র্যতা দেখার সময় বের করতে পারলো না, তার থেকে হতভাগা কেউ হতে পারে বলে আমার মনে হয় না।
ভূস্বর্গের মধ্যদিয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের যাত্রাপথের ইতি টেনে আমাদের ট্রেন এসে দাঁড়ালো শামনি ষ্টেশনে। ষ্টেশন থেকে কিছু দূর এগুতেই মনে হল,আমরা একটি বিনোদন পার্কে এসেছি পৌঁছেছি।ষ্টেশন সংলগ্ন ছোট্ট শহর, মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে নদী। সরু নদীর সামান্য দূরত্বে দূরত্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুপারের সংযোগ সৃষ্টিকারী দৃষ্টিনন্দন সেতু।আমরা নদীর দুপারে কিছুটা ঘোরাঘুরি করে মায়াবী শহরের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিলাম।রেস্তরা, সুভেনিরের দোকান,হোটেল, কাসিনো,নানারকম বিনোদন কেন্দ্র,স্থানীয়দের বাড়িঘর আর পর্যটকদের পদচারনামুখর পাহাড়ের প্রাচীরের ঘেরা শামনি যেন এক ফ্যান্টাসি’র নগরী।
ঐতিহাসিক ভাবে, শামনি শহরের দখলকৃত অঞ্চলটি বসতি সৃষ্টির পূর্বে জলবায়ু ও ভৌগলিক অবস্থানের কারণে মূলত অবহৃত ও প্রতিকুল অঞ্চল ছিল।জনবসতিহীন অঞ্চলটি ১২১ খ্রিষ্ট পূরবের দিকে রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৭৪১ সালে ইংরেজ অভিযাত্রী উইলিয়াম উইন্ডহাম William Wyndham তার বন্ধু Richard Pocock রিচার্ড পোকোক এর সাহায্যে শামনি আসেন।এদের আগমনকে শামনি’র পর্যটনের সূচনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।এই অর্থ এই নয়, তাদের পূবে অন্য কেউ বাইরে থেকে এখানে ঘুরতে আসেনি। উইন্ডহাম এই হিমবাহ উপত্যকায় এসে আবিষ্কার করেন একটি দরিদ্র পীড়িত পর্বত আরোহী জনগোষ্ঠী, যাদের প্রধান উপজীব্য পশুপালন ও জব চাষ।এই দুই অভিযাত্রী প্রথম বিশাল মোঁ-ব্লঁ’র (আল্পস) উত্তর মুখে অবস্থিত লা মের দো গ্লাস la Mer de Glace অর্থাৎ বরফের সমুদ্র নামক উপত্যকা পরিদর্শন করেন।উইন্ডহাম ফিরে গিয়ে তার এই ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখেন, যা তখনকার বড় বড় পত্রিকা,ম্যাগাজিন ও সাহিত্যের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে সমস্ত ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পরে।যার ফলে, শামনি সম্পর্কে ইউরোপিয়ানদের চরম ভাবে আকৃষ্ট করে তোলে।তাছাড়া,আঠারো শতক এমন একটি সময় যখন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির এক আমূল পরিবর্তন ঘটতে থাকে এবং পাহাড়ের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে।পরবর্তীতে ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপিয়ান অভিজাত শ্রেণীর এই অঞ্চলে ভ্রমণ উপলক্ষে আসতে শুরু করে।যা ওই সময়ের অনেক বিখ্যাত চিত্রকর্মে ফুটে উঠেছে ।
১৯৭০ সালে এখানে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় মাদাম কুতরোঁ (Madame Coutterent) সরাইখানা।
১৯৮৩ সালে ছুছুর (Saussure),গোত( Goethe),বুররি (Bourrit) মত খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের আগমন এই অঞ্চলকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে।
এছাড়া, এই অঞ্চলে এক সময় ক্রিস্টাল শিকারিদের আগমন ঘটে, তারা পাহাড়ের দামি দামি কোয়ার্টজ পাথরের সন্ধান করতো। তাদের কারণেও এই শহর পরিচিত হয়ে ওঠে।এসব ক্রিস্টাল পাথর সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে বিক্রি করা হত।সেখান থেকে চলে যেত ইউরোপের বড় বড় প্রাসাদের সৌন্দর্য বর্ধন কাজে ব্যবহারে জন্য।এটিও এক সময় এখানকার বাসিন্দাদের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম উৎস হয়ে ওঠে।
পর্যটন ব্যস্ততা বাড়ার ফলে ১৮১৬ সালে এখানে প্রথম স্থাপিত হয় বিলাসবহুল হোটেল « Hôtel de l’Union »।পরবর্তীতে La Couronne, le Royal এর মত আরও অনেক হোটেল গড়ে ওঠে।
১৮৬০ সালে শামনি ও সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টির জন্য পাহাড়ি গ্রাম ছালানস sallanches এর ভেতর দিয়ে নির্মাণ করা হয় সড়ক পথ ।
এভাবেই অতি সাধারণ ছোট্ট শামনি ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে পৃথিবীর অন্যতম এক পর্যটন স্থানে।
উনিশ শতক অবধি শামনি’র প্রধান অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি ছিল এখানকার পর্যটক গাইড বা প্রদর্শকেরা কিন্তু বিশ শতকের শুরু থেকেই বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে এই ক্ষমতা দখলে হোটেল মালিকেরা।
আমরা একটি স্যান্ডুইচের দোকানে ঢুকে দ্রুত মধ্যাহ্ন ভোজের পর্ব শেষ করে শহরের ভেতরটা আরও একটু ঘুরে দেখলাম।মেঘ ও রোদের লুকোচুরি খেলার সঙ্গে পাহাড়ের রূপ পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত।পাহাড়ের একই চূড়া কিছুক্ষণে ব্যবধানে নানা রঙ রূপে ধরা দিলো আমার ক্যামেরার ফ্রেমে।
শহরের এককোনে ক্যাবল কার ছুটে চলছে আকাশ চুম্বী পাহাড় চূড়ার দিকে।আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে দুঃসাহসী একদল সৌখিন প্যারাস্যুট আরোহীর দল।স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছ থেকে ক্যাবল কারের দিকে যাওয়ার রাস্তা জেনে আমরা ধীরে ধীরে এগুতে লাগলাম। আমাদেরকে বেশ কিছু সময়ের পথ হেঁটে স্টেশনে এসে পৌঁছুতে হল।দূর থেকে ক্যাবল কার স্টেশনটি কাছে মনে হলেও ততটা কাছে নয়।এটি লো ব্রেভো টেলেফেরিক (Le Brévent Téléphérique) স্টেশন। টিকেট কাউন্টারের কর্মরত ব্যক্তিকে পরবর্তী যাত্রার সময় জানতে চাইলে সে বলল, আর মাত্র দুবার পাহাড় চূড়ার দিকে যাত্রা করে ক্যাবল কার দিনের কার্যক্রম শেষ করবে।আমরা টিকেট সংগ্রহ করে দ্রুত স্বচ্ছ কাঁচে ঘেরা ক্যাবল কারের মধ্যে অবস্থান নিলাম।এখানেও ক্যাবল কারের টিকেটের দাম বেশ চড়া।এই যানে করে পাহাড় চূড়ায় ওঠার জন্য আমাদের দুজনকে ব্যয় করতে হল প্রত্যেকের ৩৭ ইউরো করে ৭৪ ইউরো এবং মিশেলের জন্য ৩১ ইউরো।তবে পাহাড়ের চূড়া থেকে কিছুক্ষণের জন্য ভিন্ন রূপে পৃথিবী দেখার নেশা পর্যটকদের এই অর্থ ব্যয়ের চিন্তাকে ভুলিয়ে দেয়।
কিছুক্ষণের মধ্যে ক্যাবল কার আমাদেরকে শামনির লো ব্রেভো (Le Brévent) চূড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য যাত্রা শুরু করলো। কার যতই উপড়ে উঠতে লাগলো দৃষ্টিতে শামনি শহর ততই ছোটো হয়ে এলো।ভূমি থেকে ২৫২৫ মিটার উচ্চতায় পৌঁছানোর পর উড়ন্ত পাখীর দৃষ্টির মত এক পলকেই পুরো শহরের দৃশ্য চোখে ধরা দিলো।দুই পাহাড়ের মধ্যে গড়ে উঠেছে এক মনোরম উপত্যকা শহর।উপর থেকে শামনির বাড়ীঘর ও স্থাপনাগুলোকে এতোই ছোটো মনে হচ্ছিলো যে,এক একটি ইটের খণ্ড ভূমির উপর নান্দনিক ভাবে বিছিয়ে প্রদর্শন করা হয়েছে।
লো ব্রেভো (Le Brévent) চূড়া যেন পর্যটকদের এক আন্তর্জাতিক মিলন স্থল।শামনির অন্যান্য চূড়া থেকে লো ব্রেভো উচ্চতায় ছোটো হলেও এখান থেকে আল্পস পর্বতমালা এবং শামনি শহর সহ এর চারপাশ বিস্তৃত ভাবে দেখার জন্য এই চূড়াটি পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান।খুব ছোট্ট একটুকরো উঠানের মত ঢালুভূমি। তার উপর কেউ স্কি খেলছে,কেউবা অবাক বিস্ময়ে সুদূরের বিশাল তরঙ্গের মত বয়ে চলা আদিগন্ত আল্পসের চূড়া দেখছে।পাহাড়ের উপর থেকে পৃথিবীর এই বৈচিত্র্যময় রূপ যে কারো একটু সময়ের জন্য হলেও বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড ও সৃষ্টি সম্পর্কে ভাবনার ফেলে দেবে।ভূমি,আকাশ ও আদিগন্ত পাহাড় চূড়ার দিকে তাকিয়ে মনে হবে বিশাল সৃষ্টির মাঝে কতটা ক্ষুদ্র আমাদের অবস্থান।অথচ, এই ক্ষুদ্র মানুষই এই বিশালতাকে চিন্তায় ধারণ করে উন্মোচন করে চলেছে একের পর এক অকল্পনীয় অজানা অধ্যায়ের দুয়ার।
এখানকার পর্বতমালার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী ইটালি এবং সুইজারল্যান্ডের আল্পস মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।এগুই দু মিদি (aiguille de midi) চূড়া হচ্ছে শামনি’র সব চেয়ে উচ্চতম চূড়া। ভূমি থেকে উচ্চতা ৩৮৪৩ মিটার। এই চূড়াকে বলা হয়ে থাকে আল্পস পর্বতমালার হৃদয়।মনে হচ্ছিলো, আল্পসের হৃদয়ের উপরে গিয়ে যদি দাঁড়াতে পারতাম তবে তবে হৃদয় পরিপূর্ণ পরিতৃপ্ত হত।যাহোক,কিছুটা অতৃপ্তি নিয়ে লো ব্রেভো’র পৃষ্ঠে আমরা স্বাধীন ভাবে যার যার কার্যক্রমে ব্যস্ত হয়ে পরলাম।নিরাপত্তা জালের বেষ্টনী দেয়া পাহাড় চূড়ার এক কোনে বসে সুমি পর্বতমালার সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলো। মিশেল নিজের ক্যামেরা নিয়ে ওর মত ঘুরে ঘুরে ছবি তুলতে লাগলো।আমি ছবি তুলছি আর মাঝে মাঝে মিশেলকে লক্ষ্য রাখছি দৃষ্টির মধ্যে রাখতে।কিন্তু,চোখের একটু আড়াল হতেই ও মুহূর্তেই স্থান পরিবর্তন করে চোখের আড়াল হয়ে যাচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে ও লো ব্রেভো’র ছোট চূড়াটি নিজের আয়ত্তে মধ্যে নিয়ে নিয়েছে। যদিও চূড়ার বিপদজনক স্থানগুলোতে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেয়া থাকলেও বিপদে পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনাও রয়েছে।তাই,ওর দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে আমার ছবি তোলায় মন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হচ্ছিল বারবার।হঠাৎ চোখ আটকে গেল দারুণ এক মনোরম দৃশ্যে।এক তরুণ তরুণী যুগল চূড়ার এক পাড়ে বসে সেলফি স্ট্যান্ডের সাহায্যে খুব নিবিড় ভাবে নিজেদের ছবি তুলছে। ওদের একে অপরকে জড়াজড়ি করে বসে থাকার অঙ্গ ভঙ্গি,ভাব বিনিময়,ছবি তোলার দৃশ্য দেখে আমার কিছুটা কৌতূহল হচ্ছিলো।ওদেরকে অন্য সাধারণ যুগলদের থেকে একটু ভিন্ন মনে হতে লাগলো।সুমি আমার কাছে আসতেই ওদেরকে দেখালাম।দুজন বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর নিশ্চিত হলাম ওরা বাকপ্রতিবন্ধি দম্পতি। ওদের দুজনের মুখে ভাব বিনিময়ের ভাষা না থাকলেও দুজন দুজনের প্রতি আবেগের যে উচ্ছ্বাস ও আকুলিবিকুলি ভাব ফুটে উঠেছে তা দেখে মনে হয়েছে, অন্তরে যদি একে ওপরের প্রতি নিখাত ভালোবাসার অনভুতি থাকে তবে ভাব বিনিময়ের জন্য কণ্ঠ না থাকলেও কোন ক্ষতি নেই।শরীরের ভাষা দিয়েও একে অপরকে বুঝে নেয়া যায়।
দিনের আলো প্রায় শেষের দিকে।পশ্চিম দিগন্তে সূর্য অস্ত যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এক ঘণ্টা পর ক্যাবল কার শেষবারের মত সমস্ত দর্শনার্থীদের নিয়ে পাহাড়চূড়া থেকে ভূমির উদ্দেশ্যে রওনা করবে।শেষ সময়টুকু একসাথে কাটাবার জন্য আমরা তিনজন চূড়া থেকে খানিকটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলাম।দারুণ একটা কাঠের পাটাতনের ছাউনি বিহীন তেরাস বা বারান্দা সম্বলিত রেস্তরাঁ।বারান্দা নিরাপত্তার জন্য কাঁচের বেষ্টনী দেয়াল দিয়ে ঘেরা।আমরা দুটি কফির অর্ডার দিয়ে তেরাজের একটি টেবিলে বসলাম।বেলা শেষের সূর্যের সোনালি আলোর আভায় দূরপাহাড়ের চূড়াগুলো তামাটে রঙ ধারণ করেছে।সুদূরে উপত্যকার মাঝ দিয়ে সূর্য ধীরে ধীরে নিজেকে আড়াল করে নিচ্ছে।সমুদ্রের পাড়ের সূর্যাস্ত যেমন মনোহর,তেমনি পাহাড় চূড়ার সূর্যাস্তের দৃশ্যও কম মনোমুগ্ধকর নয়।দিন শেষের মনোলোভা এমন ক্ষণে ২৫২৫ মিটার উপরের হিমশীতল বাতাসের মধ্যে বসে কফির কাপের চুমুক বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠল। মনে হচ্ছিলো জীবনের অন্যরকম এক সেরা মুহূর্ত পার করছি আমরা। লো ব্রেভোতে (Le Brévent) অনেকটা নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে।আমাদের মত কিছু পর্যটক সমস্ত কার্যক্রম শেষ করে ভূমিতে পদার্পণের জন্য ক্যাবল কারের অপেক্ষায় প্রকৃতির সান্নিধ্যে অলস সময় পার করছে।
আল্পসের চূড়া থেকে ভূপ্রকৃতি সম্পর্কে ভিন্নরকম এক অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা ক্যাবল কারে গিয়ে বসলাম। সুদূরের বরফের প্রলেপ মাখা পাহাড়ের গা জুড়ে ধূসর বিস্তীর্ণ পাইনের বন যেন তৃণভূমি সদৃশ। যখন আমাদের কার গাছগুলোর মাথার উপর দিয়ে ধীরে নামতে শুরু করলো তখন বোঝা গেলো, গাছগুলো কত লম্বা ও পুরনো।কার যতই নিচে নামতে লাগলো শামনি শহর ততই আমাদের চোখে বড় হতে লাগলো।পাহাড় চূড়া থেকে নামার সময় চারপাশের পাহাড়ের দৃশ্য ভিন্ন ভিন্ন রূপে ধরা দিচ্ছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে চূড়ার উন্মুক্ত আকাশের নিচ থেকে নেমে আমরা আবার অবস্থান নিলাম পাহাড়ের প্রাচীরে ঘেরা শামনি শহরে।ক্যাবল কার ষ্টেশন থেকে আমরা সরাসরি চলে গেলাম ট্রেন ষ্টেশনে।ট্রেনের শেষ যাত্রার সময় জেনে রাতের শামনি উপভোগের জন্য হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম।।রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে পাহাড়ের অবয়ব অনেকটাই ঝাপসা হয়ে এলো, কিন্তু খ্রিস্মাস উপলক্ষে শহরের আলোকসজ্জার রঙ্গিন বাতিগুলো জ্বলে ওঠায় সামনি শহর রূপ নিলো নতুন আঙ্গিকে।
আমি কোথাও ঘুরতে গেলে মনে হয়, আর কখনো এই স্থানে আসা হবে কিনা তা অনিশ্চিত।তাছাড়া নতুন স্থানের বাড়িঘর দোকানপাট, মানুষের জীবনযাপন আমাকে কৌতূহলী করে তোলে। তাই ঐ স্থানের আকর্ষণীয় দৃশ্যপট ক্যামেরায় ধরে রাখার প্রতি আমার দারুণ এক নেশা রয়েছে।যার ফলে আমার সাথে মিশেল ও ওর মা ঘুরতে বের হলে ওরা খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেনা।মিশেল ফরাসি ভাষায় একটি কথা বলে Profite du temps »প্রফিতে দু ত »অর্থাৎ সময়কে উপভোগ কর, ওর মত হচ্ছে,ঘুরতে বেরিয়ে সময়টাকে দেখে ও গল্প করে উপভোগ করতে হবে,অন্যদিকে মনোযোগ দিলে একসাথে ঘুরতে বেরনোর অর্থ হয়না।এজন্য আমার ছবি তোলা নিয়ে ও আমাকে অনেক সময় ব্যঙ্গ করে।যে কোন একটা কিছু দেখিয়ে বলবে,বাবা এটার ছবি তোল,ওটার ছবি তোল।ওর রসাত্মক ব্যঙ্গ আমি বেশ উপভোগ করি।ওর কথার যুক্তি থাকলেও নেশার কারণে আমি এই অভ্যাস থেকে বেরুতে পারিনা।এবারও তাই হল,আলো ঝলমল বরফে ঢাকা রাতের শামনি’র মাঝদিয়ে বয়ে চলা সরু নদীর রঙ্গিন জলের ধারা,নতুন রূপে উদ্ভাসিত নদীর দু পাশের দালানকোঠার দৃশ্য,রাস্তায় পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য পথশিল্পীদের নৃত্য ইত্যাদি আমাকে বারবার ওদের থেকে বিচ্ছিন্ন করছিল।অবশেষে ওদেরকে বলে আমার মত করে একটু আলাদা হয়ে ছবি তোলায় মনোনিবেশ করলাম।ওরা মা মেয়ে ওদের মত করে ঘোরাফেরা ও কিছু কেনাকাটা করে সময় কাটালো।
স্বপ্নের শামনিতে বাস্তব পদচারনামুখর একটি আনন্দঘন দিনের ইতি টানিয়ে আমরা আবার ছা জারভে লে বাঁ লো ফায়ে’র উদ্দেশ্যে ট্রেনে উঠলাম।ফেরার পথে এবার আর চারপাশের অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যগুলো চোখে ধরা দিলনা। রাতের আবছায়ায় নিস্তব্ধ পাহাড়ি উপত্যকা পথ পেরিয়ে চলে এলাম আমাদের ক্ষনিকের নীড়ে।
বরফে ঢাকা আল্পস ভ্রমণের দিনগুলো (পর্ব-২ , মোঁ ব্লঁ)
বরফে ঢাকা আল্পস ভ্রমণের দিনগুলো (পর্ব-১)
সাম্য সম্মান সুন্দর ধরিত্রী
মুহাম্মদ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল)
পারিস ,ফ্রান্স ।