মেয়েটি যখন লঞ্চে উঠলো তখন কেউ তাকে বিশেষ একটা খেয়াল করে নি।খেয়াল করার মতোও কেউ ছিলো না সে।বেঁটে, মোটা এবং দেখতে কালো।অন্য সাধারণ লোকেদের মতোই লঞ্চের ডেকে বিছানা পেতে বসেছে যখন ,তখন সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত ছিলো।কেউ মোবাইল ফোনে কথা বলছিলো,কেউবা তাস খেলছিলো।একজন লোক এমপিথ্রি পড়ছিলো।হয়তো সামনে তার কোনো চাকুরির পরীক্ষা আছে,হয়তো বেকারত্বের গ্লানি থেকে মুক্তি পাবার স্বপ্ন নিয়ে সে পাড়ি দিচ্ছে এই নদীপথ।অন্য কোনদিকে তার খেয়াল নেই।হয়তো এই রাতটাই বাকি আছে। মেয়েটি ঠায় বসে ছিলো লঞ্চে,অন্য সবার মতো।তখনো হকারের কোলাহল শেষ হয় নি।শেষ হয় নি সিট দখলের লড়াই।সবাই সবার কাজে ব্যস্ত।অন্য কারো দিকে দৃষ্টিপাতের সময় নেই কারো।
এমন ব্যস্ততার মাঝেই লঞ্চ ছেড়ে দিলো একসময়।সময় এগিয়ে চলেছে।নদীর বুক চিড়ে এগিয়ে চলেছে লঞ্চ।সবকিছুই ঠিকঠাক চলছে।গতানুগতিক,নিস্তরঙ্গ। এই ব্যাপারটা হয়তো সহ্য হলো না মেয়েটির। ডেকের টিভিতে একটি হিন্দি গান চলছিলো।হঠাৎ মেয়েটি গানটির সাথে গলা মিলিয়ে গাইতে শুরু করলো এবং ঢুলে ঢুলে জায়গায় বসে নাচতে লাগলো। এই ব্যাপারটা একটা আজব ঘটনা হিসেবে প্রতীয়মান হয়ে গেল লঞ্চের সবার কাছে। মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। বেশির ভাগ লোকই মুখ টিপে হাসছে।এরকম বিনোদন সচরাচর দেখা যায় না।ডেকের এতগুলো লোকের সামনে সে গান গাইছে ,নাচছে।দেশ থেকে লজ্জা-শরম উঠে গেল।মহিলাগন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে,যেন কোনো বিশাল পাপ করে ফেলেছে,মেয়েটির ধ্বংস অনিবার্য।এমপিথ্রি পড়ুয়া লোকটি বিরক্ত হলো।তার চাকুরির পরীক্ষা সামনে।মেয়েটা গান তো গাইছে না,যেন চিৎকার করছে। সে একটা ধমক দিলো দূর থেকে মেয়েটিকে। "এখনই থামেন।নিজের বাড়ি পাইছেন এটা?" মেয়েটি কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে অবিরত থাকলো নিজের কাজে। তার কানে প্যানপ্যান করা বৃথা বলে মনে হলো লোকটির।ঝগড়া করার পর্যাপ্ত সময় এখন হাতে নেই তার।তাই আবার মনোযোগ দিলো তার এমপিথ্রি তে। মেয়েটির সাথে তার স্বামী এবং একটি ছোট বাচ্চা ছিলো।তারা মেয়েটির এই উচ্ছ্বলতা উপভোগ করছে বেশ।তাদের শুনিয়ে শুনিয়ে লোকে কথা বলছে।কিন্তু কেউ কানে নিচ্ছে না।মেয়েটি হঠাৎ গান থামিয়ে ছোট বাচ্চাটিকে পিঠে নিয়ে ঘোড়া হবার ভান করতে লাগলো।মেয়েটি এবং বাচ্চাটির যুগপৎ অট্টহাসি ছড়িয়ে গেল পুরো লঞ্চে।মেয়েটি কখনো ঘোড়া হচ্ছে,আবার কখনো গোরু হয়ে গুঁতো দিচ্ছে বাচ্চাটিকে। এমপিথ্রি লোকটি আবারো ধমক দিতে যাচ্ছিলো আবার,তার পড়ায় ব্যাঘাত ঘটছে।কিন্তু পাশ থেকে একজন বলে বসলো,
"ভাই,তারা নিজেগো মতো কইরা আনন্দ করে,করতে দেন না ভাই।সবাই তো আমাগো লাহান রোবট না,আর মাইনষে কী ভাবব হেইডা লইয়া বইয়া থাহে না।"
লোকটি ঠিক কথাই বলেছে। তারপরও এটা পাবলিক প্লেস,নিজেদের আনন্দের জন্য অন্যকে বিরক্ত করা অন্যায়। এবার সে কঠিন কিছু বলার প্রস্তুতি নিলো।এবার আর দূর থেকে ধমক দেবে না। জায়গা থেকে উঠতে যাবে তখনই তাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি থেমে গেল।মেয়েটির পরিবারের সাথে কয়েকটি বস্তা ছিলো। একটা বস্তার মধ্যে থেকে সে একটা হারমোনিয়াম ও করতাল বের করলো,অপর একটি বস্তা থেকে একটি ছোট আকারের ঢোল। মেয়েটির স্বামী হারমোনিয়াম নিয়ে কসরত করলো একটু।অপূর্ব সুর।সবার দৃষ্টি সেদিকে।মেয়েটি ঢোলটি কোলে নিয়ে বসে ছিলো।হঠাৎ করেই ঢোলটিকে মৃদুলয়ে বাজাতে শুরু করলো মেয়েটি। মৃদু লয়ে বাজাতে বাজাতেই হঠাৎ মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুতলয়ে বাজাতে শুরু করলো।চারিদিকে পিনপতন নীরবতা। ঢোলের শব্দ আছড়ে পড়তে লাগলো লঞ্চের ভেতরে।যেন নিশ্চুপ,নির্জন প্রকৃতিতে হঠাৎ করে কালবৈশাখীর ঝড় শুরু হয়েছে। আকাশ ফেঁটে যাচ্ছে।করতাল থেকে বজ্রপাতের মতো কড়াৎ কড়াৎ শব্দ হচ্ছে।মেয়েটি ঢোল বাজাতে বাজাতে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করলো।নাচের প্রতিক্রিয়ায় তার খোলা চুল আকাশে উড়ছে। কালো মেঘে আকাশটা ছেয়ে গেছে যেন। সাথে প্রবল ঝড় ও বজ্রপাত।মেয়েটি উন্মাদের মতো নাচছে, যেন প্রাণহীন এই বিশ্বকে ধ্বংস করে দেবে সে আজ। পরক্ষণেই তার গলা থেকে বের হয়ে এলো,
"কে বানাইলো এমন রঙমহল খানা
হাওয়া দমে দেখ তারে আসল বেনা।।"
বিনা তেলে জ্বলে বাতি
দেখতে যেমন মুক্তা মতি
জলময় তার চতুর্ভিতি মধ্যে খানা।।"
হাওয়ার দমেই তো মানুষ চলছে।জলময় এই দেহ দেখতে কী সুন্দর!!
"তিল পরিমাণ জায়গা সে যে
হদ্দরূপ তাহার মাঝে
কালায় শোনে আঁধলায় দেখে নেংড়ার নাচনা।।"
এইটুকু দেহে মানুষের কত চেহারা!! একই অঙ্গে মানুষের কত রূপ!! কখনো সভ্য,কখনো অসভ্য, কখনো জ্ঞানী,আবার কখনো কুয়োর ব্যাঙ!!
"যে গঠিল এ রঙমহল
না জানি তার রূপটি কেমন।
সিরাজ সাঁই কয় নাইরে লালন তার তুলনা।।"
এই মানবদেহ এবং মানুষ যিনি গঠন করলেন,তার কোনো তুলনা হয় না।
গানটি গেয়ে লঞ্চের সকল মানুষকে উপর্যুক্ত বার্তাগুলোই কি দিতে চাচ্ছে মেয়েটি? তার গানে হয়তো কেউ সামান্য সময়ের জন্য চিন্তা করেছে,হয়তো কেউই তার বার্তা নেয় নি। ডেকের সকল যাত্রী হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে ছিলো তার দিকে। গানটি শেষ হবার কিছুক্ষণ পরও কারো মুখে কথা নেই। সবাই একটা ঘোরের মধ্যে আছে। ঝড় থামার পর চারিদিকে বিরাজ করা শূন্যতা যেন আঁকড়ে ধরেছে সবাইকে।এমপিথ্রি পড়ুয়া লোকটি কিছু সময় আগেও বিরক্ত ছিলো মেয়েটির প্রতি। এখন আর তার বিরক্তি নেই।এক অদ্ভূত ভালোলাগা গ্রাস করেছে তাকে। সে আবার পড়তে বসলো। হঠাৎই তার মনে হলো, "পৃথিবীতে হাজার কিসিমের পাগল আছে। এই মেয়ে তাদের মধ্যে একটা।"
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৪৮