ছবিসূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক।
বুড়ো মানুষ তার উঠোনের শেষ মাথায় অবস্থিত পুরনো পেয়ারা গাছের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে চিৎকার করছিলো, ”যা ! যা ! যাস না ক্যা??” আশেপাশের লোকজনের কাছে তার এই চিৎকার পাগলের প্রলাপ বলেই মনে হচ্ছিলো । কেননা সে যাকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করছে তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না,যদিও তার শব্দ শোনা যাচ্ছিলো । সেই শব্দ সকলেই শুনতে পাচ্ছিলো এবং জানতেও পেরেছিলো জিনিসটা আসলে কী!! কিন্তু এই শব্দকে এতটা গুরুত্ব দেয়ার কোনো মানে আর সকলের জানা নেই। শব্দটি বুড়ো মানুষটির খুবই চেনা।কয়েকদিন ধরে প্রতিদিনই শোনে। সে শব্দটির উৎস সম্পর্কে জানে। যদিও আর সকলের মতো সে নিজেও দেখতে পাচ্ছে না শব্দের উৎস। কিন্তু কেউ যদি কোনো শব্দ না করে শব্দের উৎস ধরে সন্তপর্ণে পেয়ারা গাছের দিকে হেঁটে যায়,তাহলে দেখতে পাবে পেয়ারা গাছের মগডালে পাতার আড়ালে একটি ঘুঘু বূড়োর দিকে মুখ করে বিষন্ন সুরে ডাকছে। ঘুঘুর বিষন্নতায় শ্রোতার মন আপ্লুত হতেও পারে আবার নাও পারে।তবে এই বিষন্নতা বুড়োর মনে তীব্র বিরক্তি সৃষ্টি করছে। সে ঢিল মারতে চায়।কিন্তু এত দূরে ঢিল ছুড়ে মারার মতো শক্তি নেই তার শরীরে। সে আবার চিৎকার করে, যাস না ক্যা,বলদা পাখি???
'বলদা পাখি' মানে কী সেটা পাখিটা জানে না। জানলে হয়তো ডাকতো না।আবার ডাকা অব্যাহতও রাখতে পারতো। তবে পাখিটার বিষন্নতা 'বলদা পাখি' গালিতে রাগান্বিত হবার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলেই প্রতীয়মান হলো। কারণ পাখিটা তার ডাক থামায় নি। বুড়োর বিরক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সে বিষন্নমনে অনেকক্ষণ পর পর ডাকতে থাকে। গতকাল,গত পরশু এমন করতে করতে চার-পাঁচদিন দিন পূর্বে গেলে দেখা যাবে পাখিটার ডাকে কোনো বিষন্নতা নেই। সেখানে আছে উৎফুল্লতা। তার সাথে আরেকটা পাখিকে দেখা যাবে। সেই পাখিটা আগের পাখিটার চেয়ে বেশি সুন্দর ও উৎফুল্ল। দুজন একসাথে উঠোনে ছড়ানো গম খেতে থাকে। তাদের সাথে আরো কয়েকটা কবুতর যোগ দেয়। অল্প কিছু মোরগ-মুরগিও দেখা যায়। সবাই একসাথে গম খায় পরমানন্দে। গম খেতে খেতে হঠাৎ করেই সাথের পাখিটার একটা ডানা আটকে পড়ে লাউক্ষেত বেষ্টন করে রাখা একটি জালে। পাখিটা দাপাদাপি করতে থাকে। তার ডানা ঝাপটানোর শব্দে ধীর পায়ে বের হয়ে আসে সেই বুড়ো মানুষ। বুড়ো মানুষটাকে দেখে বাকি সব পাখি উড়ে যায়। আজকের পাখিটি খুঁজে পায় তার নতুন ঠিকানা। পেয়ারা গাছের মগডালে উঠে তারস্বরে চিৎকার করে ডাকতে থাকে।যদিও সেটাকে চিৎকার বলে মনে হয় না।বরাবরের মতোই চেনা শব্দ। হয়তো সঙ্গীকে বাঁচানোর আকুতি জানাচ্ছিলো সে সেদিন। তার মনে হতে পারে বুড়ো মানুষটা তার চিৎকারে চলে এসেছে। অথবা এও মনে হতে পারে সে তার সঙ্গীকে ধরতে এসেছে। সে গাছের মগডাল থেকে দেখতে পায় বুড়ো মানুষটা তার সঙ্গীকে জাল থেকে উদ্ধার করলো।
বুড়ো মানুষটা ঘুঘু পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দে বাইরে চলে আসে। এই পাখি এবং তার সঙ্গীকে সে আগেও দেখেছে।তারা প্রতিদিনই তার কবুতরের সাথে গম খেতে আসে। জালে আটকে যেতে দেখে তড়িঘড়ি করে বুড়ো মানুষটা পাখিটিকে জাল থেকে উদ্ধার করে। কিন্তু সে দেখতে পায় পাখিটার ডানা থেকে রক্ত ঝড়ছে। বেশ ভালোই ক্ষত হয়েছে। ক্ষত দেখে উদ্বিগ্ন হয় বুড়ো মানুষটা। আলতো করে পাখিটাকে হাতে তুলে নেয় সে। ডানায় খুব যত্নের সাথে হলুদ পানিতে মিশিয়ে সেই হলুদের প্রলেপ দেয়,যাতে তার ক্ষতটা সেরে যায়। হলুদ মেখে প্রফুল্ল বোধ করে সে। সারাটা সময় পাখিটা ছটফট করেছে।এখনো করছে। হয়তো ব্যাথায়, অথবা মুক্তির আশায়। বুড়ো মানুষটা চেষ্টা করে পাখিটাকে শান্ত করার। সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। বুড়োর হাত যখনই পাখিটার লেজের দিকে গেল তখনই হঠাৎ পাখিটা বুড়োকে হতচকিত করে দিয়ে ফুরুৎ করে উড়ে গেল। যদিও ব্যাপারটা স্বাভাবিকই। কিন্তু সেটা স্বাভাবিকতার মাত্রা অতিক্রম করে গেল, যখন বুড়ো দেখলো তার হাতে পাখিটার লেজের পালকগুলো আটকে আছে এবং সেই সাথে উড়ে যাবার সময় পাখিটার নগ্ন পশ্চাদ্দেশ রোদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। লেজ না থাকায় পাখিটা উড়ে বেশি দূরে যেতে পারলো না। অল্প দূরে গিয়েই আছড়ে পড়লো উঠোনে। বেশ দূরে কিছু বেড়াল ওৎ পেতে ছিলো শিকারের আশায়। তারা ঘুঘুটার দিকে তাদের লক্ষ্য স্থির করে। কিন্তু তারা কিছু করার আগেই ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয় বুড়ো মানুষ। আলতো করে হাতে তুলে নিয়ে একটি খাঁচায় পুরে দেয়।লোহার মজবুত খাঁচা। কোনো প্রাণী তার অনিষ্ট করতে পারবে না। নিশ্চিন্ত হয় বুড়ো মানুষ। পাখিটাকে আলাদা করে কিছু চাল দেয়। একটি আলাদা পাত্রে দেয় বিশুদ্ধ পানি। মনে মনে ভাবে, লেজের পালক আবার গজালে ছেড়ে দেবে পাখিটাকে।
সঙ্গী পাখিটাকে ধরা পড়তে দেখার সময় থেকেই পাখিটা পেয়ারা গাছের মগডালে বসে তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে। সঙ্গীর পাখায় হলুদ লাগানো, তার উড়ে যাওয়া, পুনরায় ধরা পড়া সবই সে দেখেছে গাছে বসে। হয়তো একবার উড়ে যেতে দেখে খুশি হয়েছিলো সে।ভেবেছে তার সঙ্গী আবার ফিরে আসছে। কিন্তু পরক্ষণেই তার পতন দেখা গেল। সে চিৎকার করে যাচ্ছে অনেকক্ষণ পরপর। ঘটনা ঘটার পর থেকে একেবারে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাছের মগডালে বসে সে ডাকলো। কোনো ফল হলো না।সঙ্গীকে দেখতে পেলো না। পরদিন সকালে সে আবার পেয়ারা গাছের মগডালে এসে বসলো। এবার সে দেখলো, একটা লোহার খাঁচার মধ্যে তার সঙ্গী পাখিটা। ডালে বসে ডাকতে থাকে সে পাখিটাকে। প্রবল ব্যাকুলতা মিশে ছিলো সেই ডাকে। তার সেই আহ্বান শুনতে পায় বন্দি পাখিটা। উতলা হয়ে ওঠে সঙ্গীর সাথে চলে যাওয়ার জন্য।কিন্তু তার সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় লোহার খাঁচা। খাঁচার চারদিকে দেয়াল ঘেষে চরকির মতো ঘুরতে থাকে পাখিটা। খাঁচায় ধাক্কা দেয়। ঠোঁট গলিয়ে, মাথা গলিয়ে দেয় খাঁচার ফাঁক দিয়ে।কিন্তু শরীর বের করতে পারে না। তার ব্যাকুলতা দেখে গাছের পাখিটা চিৎকার করতে থাকে। সন্ধ্যার সময় সে দেখলো বুড়ো মানুষটা খাঁচাসহ বন্দি পাখিটাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। পরেরদিন সকালে সে আবার আসে পেয়ারা গাছের মগডালে। ডাকতে থাকে তার সঙ্গীকে।এবারও গতকালের পুনরাবৃত্তি। ব্যার্থ মনোরথে সে ফিরে যায়। পরেরদিন সে আবার আসে।ভাবে একটু পরেই তার সঙ্গীকে আবার দেখতে পাবে। কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেল পাখিটাকে দেখা যাচ্ছে না।তার খাঁচাও অদৃশ্য। একটু পরে দেখা যায় বুড়ো মানুষটা উঠোনে গম ছড়াচ্ছে। কতগুলো কবুতর ও মোরগ-মুরগি এসে গম খাচ্ছে। কিন্তু তার সঙ্গীটা কোথায়? আতঙ্কিত স্বরে ডাকতে থাকে সে। অনেকক্ষণ ধরে ডাকে।কিন্তু তার সঙ্গী আসে না। একসময় সেই ডাক রূপ নেয় বিষন্নতায়। বুড়ো মানুষটা হাঁক দেয়। যা! যা! পাখিটা কানে নেয় না। সে ডাকতে থাকে। পরের দিন সে আবার আসে। সারাদিন ডাকে। সঙ্গীর দেখা পায় না।তবুও সে বিষন্ন সুরে ডাকতে থাকে তার সঙ্গীকে।
সেদিন সন্ধ্যায় বুড়ো মানুষটা পাখিটাকে ঘরে নিয়ে যাবার পর দেখতে পায় সারাদিনে পাখিটা কিছু খায় নি। সকালের চালের পরিমাণ আগের মতোই আছে। ঘুঘু পাখি সরিষা খেতে পছন্দ করে। সে কিছু সরিষার দানা দেয় খাঁচার মধ্যে। পাখিটা সরিষার দানা ছুয়েও দেখে না। উদ্বিগ্ন হয় বুড়ো মানুষ। পাখিটার অসুখ হলো না তো?? পাখিটাকে ছেড়ে দেয় সে। পাখিটার ডানার ক্ষত সেরে গেলেও লেজের পালক গজায় নি।ফলে সে উড়তে পারে না। তাই পাখিটাকে আবার খাঁচায় পুড়ে দেয় বুড়ো মানুষ। সরিষা দানার পরিমাণ বাড়িয়েও কাজ হয় না। পাখি খায় না। হঠাৎ পাখিটার ডাকে একটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ করে সে।পাখিটা কেমন বেড়ালের মতো ম্যাও শব্দ করে ডাকছে। অসুখ হয়েছে পাখিটার। সে ঝিমায় কিছুক্ষণ পরপর। ব্যাকুল হয়ে কবুতরের জন্য কেনা একটা ওষুধ পানিতে মিশিয়ে সিরিঞ্জে ভরে খাওয়ায় তাকে। পাখিটাকে একটু চাঙ্গা হতে দেখা যায়। ঘুমোতে যায় বুড়ো মানুষটা। হঠাৎ মাঝরাতে সেই বেড়ালের মত ডাক শুনতে পায় সে।পাখিটা শুয়ে আছে। তার শরীর কাঁপছে। বুড়ো মানুষটা বুঝতে পারে পাখিটা মারা যাবে। ব্যাকুল স্বরে সে মিনতি করতে থাকে পাখিটার প্রতি। "মরিস না ! মরিস না ! তোরে কাইলই ছাইড়া দিমু।উড়তে পারোস আর না পারোস !! তার কাকুতি মিনতি শুনতে পায় না পাখিটা। হঠাৎ তার কাঁপুনি থেমে গেল। শক্ত হয়ে গেছে তার শরীর। প্রবল কষ্টে কেঁদে ফেলে বুড়ো মানুষটা। তার ওপর অভিমান করেই মরলো পাখিটা। মাঝরাতেই পাখিটাকে ডোবায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে আসে সে। পরদিন সকালে সে যখন উঠোনে গম ছড়িয়ে দেয় তখন সে শোনে বিষন্ন সুরে ঘুঘু ডাকছে।সে বুঝতে পারে এটা মরা পাখিটার সঙ্গী। এই ডাকটা তার সহ্য হয় না। যা! যা! বলে তাড়িয়ে দিতে চায় সে। পাখিটার ডাক শুনে তীব্র অপরাধবোধে আচ্ছন্ন হয় তার মন। "বড় একটা ভুল করলাম।" মনে মনে বলে সে। তার চেয়ে ক্ষতবিক্ষত ডানাসহ ছেড়ে দিলে হয়তো সে এখন বেঁচে থাকতো। গম ছড়ানো হয়ে গেলে সে ঘরে ফিরে যায়। কিন্তু গাছের ঘুঘুটার ডাক থামে না। পরের দিন সকালেও সে দেখে পাখিটা ডাকছে পেয়ারা গাছের মগডালে। তীব্র যন্ত্রণা দিতে থাকে ডাকটা তাকে। যা! যা! বলদা পাখি!! বলে তাড়িয়ে দিতে চায় সে পাখিটাকে। কিন্তু বলদা পাখি থামে না। আবার সেই অপরাধবোধ জাগ্রত হয় বুড়ো মানুষটার মনে। "আমি তো ভালোই চাইছিলাম।ছাইড়া দিলে তো বিলাইয়ের প্যাডে যাইতো।" কিন্তু পাখিটাতো সেটা জানলো না। সারারাত আর্তনাদ করতে করতে মরেছে। হয়তো তাকে অভিশাপ দিতে দিতে মরেছে। বনের পাখিকে সে খাঁচায় ভরেছে। হয়তো দুয়েকদিন পরে সে ভুলে যেতে পারতো। কিন্তু অন্য পাখিটা তাকে ভুলতে দিচ্ছে না।সারাদিন থেমে থেমে ডাকে!!! অসহ্য!!! গলাও কি ব্যাথা করে না?? বিরক্ত হয়ে পাখিটার দিকে ঢিল ছুড়তে যায় সে।কিন্তু শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারে না। গলার সকল শক্তি দিয়ে সে চিৎকার করে, " বলদা পাখি থাম এহন!! তোর লগেরটা মরছে!!! বুঝস না কিছু???" গলা ধরে আসে বুড়ো মানুষটার।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১২:৫৬