-অর্জিয়তা মাথা নাড়ে,বলে হ্যাঁ অনেক দিন পর।
-ঋদ্ধ তোমার সাথে এভাবে ঝড় জলের রাতে দেখা হবে কখনো ভাবিনি ।
-অর্জ তুমি বেশ মোটা হয়ে গেছ।
-আমার অতটা পরিবর্তন হয়নি যতটা তোমার হয়েছে।মুথে অত বড় বড় জঙ্গল রেখেছ কেন?তোমাকে চিনেছি তোমাকে দেখে নয় তোমার কন্ঠসর শুনে।ঋদ্ধ হাসে।
-দাড়ি গুলোর কথা বলছ?ওগুলোতে কমা দেওয়ার সময় পাইনা, তাই একেবারে দাঁড়ি টেনে দিয়েছি।
- মনে হয় অনেক ব্যস্ত সময় যাচ্ছে।কিছুটা উপহাসের ছলে বলে অর্জিয়তা।
–যার অনেক আছে তার সেটা না থাকার ভাব ধরায় এক প্রকার স্টাইল।যেমন- তোমার গায়ে কোন গহনা নেই।আমারো আছে নেই কাজের ব্যস্ত সময়।
-শোন ঋদ্ধ, এটা তুমি ভালোভাবেই জানো যে আমি গহনা পরতে পছন্দ করিনা।তারপরও তুমি এটা বলতে পারনা।
অর্জিয়তা রেগে গেছে, বুঝতে পারে ঋদ্ধ।তবুও ঋদ্ধ বলে-তাহলে আমাকে নিয়েও আমার আর কিছুর বলার থাকল না ।
অর্জিয়তা ভাবে এই সেই মানুষ যার সাথে সে জীবনের সব চেয়ে সোনালী সময় গুলো কাটিয়েছে।থুব কষ্ট হয় ওর।তার অনেক কথায় মনে পড়ে।হাটখোলা,ভোলা ময়রাদের দোকান,কুরিপাড়া,বাউড়,বাউড়ের পাশে বড় ছাতিম গাছটা, আর ঋদ্ধদের মস্ত বড় আমের বাগান।সব জীবন্ত।নিশ্বাসে গন্ধে ভরপুর।বাগানটি সবসময় অন্ধকার হয়ে থাকত।ঋদ্ধের আব্বা এক কালের প্রতাপশালী মানুষ ছিলেন।সংগে রাখতেন একটা বন্দুক।এ বংশে নারীদের মাখা পাউডারের অভাব হলেও পুরুষদের কখনো গান পাউডারের অভাব হয়নি।অসুস্থ অবস্থায় কাউকে তিনি বাড়িতে ঢুকতে দিতেন না।শুধু অর্জিয়তাকে তিনি খুব পছন্দ করতেন।বাউন্ডুলেপনার জন্য ঋদ্ধকে তিনি ভীষণ অপছন্দ করতেন।যদিও ঋদ্ধ তার একমাত্র ছেলে।যে রাতে ঋদ্ধের আব্বা মারা গেলেন সে রাতে ঋদ্ধ বাড়ি ছিলনা।ঋদ্ধ একজনকেই শুধু মানতো।সে তার মা।অর্জিয়তাকে তিনিও খুব পছন্দ করতেন। মনে মনে পুত্রবধু করবে এটা তার ভাবনায় ছিল।
মা-এর কথা মনে পড়তেই অর্জিয়তা বলল- আচ্ছা ঋদ্ধ, মা কেমন আছেন?
নির্বিকার ঋদ্ধ বলল- মা গত বছর সেপ্টেম্বরে মারা গেছেন।হঠাৎ অর্জিয়তার মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে যায়।তখনও ট্রেনের বাইরে অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি পড়ছে।বৃষ্টিতে ভেজা পচা পাট আর বুনো মাটির গন্ধ। ট্রেন চলছে কত গুলো অদ্ভুত জীবনকে নিয়ে।নৈশব্দের উঠোনে একরাশ স্মৃতি আর ট্রেনের একটানা শব্দ ওদের জীবনের সঙ্গী।
নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ঋদ্ধ প্রশ্ন করে- তোমার খবর কি বল?
-এইতো চলে যাচ্ছে।ভলোইতো চলে যাচ্ছে।
-তারপর লোকমুখে শুনলাম সেই আসমান নিয়েই নাকি আছ?ঋদ্ধের বলার ধরন শুনে হাসে অর্জিয়তা।
-আচ্ছা ঋদ্ধ তুমি কি বদলাবে না?
-তোমার মত বদলাতে পারলাম আর কই।সেই ক্ষমতা বোধ হয় আল্লা আমাকে দেয়নি।
-অর্জিয়তা রেগে বলে,আমি তখন ফ্লোরিডায় মহাকাশ গবেষণার এক সেমিনারে,বাংলাদেশী এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা,তোমাকে সে ভালোভাবে চেনে।জানলাম বাউরী পাড়ার কোন নীচু জাতের মেয়ে মানুষের সাথে তোমার সম্পর্ক।বিয়েও করতে যাচ্ছ শুনলাম।আমি সারা রাত ঘুমতে পারিনি।ভেবোনা তোমার কথা ভেবে নিজের জন্য ঘুমাতে পারিনি।সেটা ভাবলে তোমার ভুল হবে।মানুষ হিসাবে মানুষ যে কতটা নীচে নামতে পারে,সে তোমার না দেখলে বোধ হয় জানা হত না।ঋদ্ধ নীরবে সব শুনে যায়।সে জানে কতটা ভুল আর কতটা সত্য।ঋদ্ধ মনে মনে বলে,অর্জি সেদিন তোমার বাড়ির দরজা দিয়ে বের হবার সময় আমার ঠিক সেই-রকম লেগেছিল যে রকম আদমের লেগেছিল জান্নাত থেকে বের হবার সময়।আমি একটুও কষ্ট পাইনি,কাদিনি,শুধু মাথা নীচু করে চলে এসেছি।তোমার বাবার কাছে আমি বাউন্ডুলে,পূর্ব পুরুষের জমিদারি টাকায় আমি বখাটে।কোন দিক দিয়ে আমি তার মেয়ের যোগ্য না।
তারপর কত বছর গেল অর্জিয়তার সাথে ওর আর দেখা হয়নি!গেল বছর শরৎ-এ যখন মা মরল তখন ঋদ্ধ আবিষ্কার করল এ সংসারে তার আপন বলতে আর কেউ নেই।অর্জিয়তারা তখন পূর্ণ আমেরিকাবাসী।ঋদ্ধের তখন বাড়ি আছে কিন্তু ঘর নেই, টাকা আছে কিন্তু তার কোন অর্থ নেই,সাথী আছে কিন্তু বন্ধু নেই।যে বাড়িতে ঘর থাকে না সেখানে ভালোবাসা নামক বস্তুটির স্থানে জায়গায় করে নেই প্রেম।অনাচার দরজা দিয়ে ঢোকে আর আচার জনালা দিয়ে বের হয়।তবু ঋদ্ধ জানে কোন নদীতে সাতার কাটতে হয়,কোনটায় পান করতে হয়,কোনটায় গোসল করতে হয় আর কোনটায়-বা নোংরা পরিস্কার করতে হয়।তাইতো আজো সে অর্জিয়তার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।
-অর্জি সাদা চামড়ার মানুষেরা অনেক উঁচু জাতের হয়,তাইনা?উনারা অনেক উচু প্রজাতির সুন্দর বান্দর থেকে উৎপন্ন।নারীতো ওনাদের কাছে যে কোন বনের যে কোন ফলের মত।বানরের মত ক্ষুধা লাগলেই হল,খেতে হবে।মনে হয় তোমার ম্যাকলিউড সাহেব এ বিষয়ে একমত হবেন।অর্জিয়তার কষ্টে দু’চোখে পানি চলে আসে।
-ঋদ্ধ তুমি নিজেকে আর কতটা নিচে নামাবে?ম্যাকলিউড সাহেব আমার কলিগ।উনি বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলেন আমি সে বার তোমাকে কত জায়গায় খুজেছি!কেউ-ই সন্ধান দিতে পারেনি।আর তুমি....।
ঋদ্ধ বুঝতে পারে সে একটা ভুল করে ফেলেছে।গভীর ওই দুটি চোখের আভিজাত্য কখনও মিথ্যা বলেনা,সে জানে সেটা। ঋদ্ধ জানতো অর্জিয়তা এসেছে,তাকে খুজছে।ইচ্ছা করেছিল যেতে তবে যাওয়া হয়ে উঠেনি।
পরিবেশ সহজ করার জন্য ঋদ্ধ বলল তোমার হাবলা আর গালাগালিদের থবর কি?আসমান থেকে মর্তে আর নামবেনা?ওর কথা বলার ধরনে অর্জিয়তা হেসে ফেলে,বলে হাবল আর গ্যালিলিও তোমার করেছে কি?
-আমি যাকে চিনতাম তাকে ওনারা আমার চেনা মাটি থেকে আকাশ নিয়ে গেছে।তার টেলিস্কোপ সাইট আর আমাকে খুঁজে না।
-তোমাকে খুঁজবে কার এত সাধ্যি বল।
-ঋদ্ধ তুমি বিশ্বিবদ্যালয় ছেড়েছিলে কেন?
-ফেল করেছিলাম তাই।
-ঋদ্ধ সেটা আমি জানি কিন্তু তোমারতো আরো এক বছর সুযোগ ছিল।
–আচ্ছা অর্জি বলতে পারো হনুলুলুটা কোথায়?
-তুমি কথা ঘুরাচ্ছ কেন ঋদ্ধ?তোমাকেতো আর এক দিন থেকে চিনি না।
-জানো অর্জি, ছোট বেলায় যখন বাবা খুব মারতো,মনে হতো সমুদ্র পেরিয়ে হনুলুলুতে চলে যায়।কোন এক কমিকসে পড়েছিলাম ওটা পশ্চিমে।বড় হয়ে আর মনে হয়নি।তবে হ্যা একবার,বড় হয়ে একবার মনে হয়েছিল ওখানে চলে যায়।ছোট ডিঙ্গি নৌকোয়।সেবারই তোমার বাবার সাথে আমার শেষ দেখা।
-বাবা তোমাকে যাই বলুক,তুমি একটিবারের জন্য হলেও আমার সাথে দেখা করতে পারতে না ঋদ্ধ?
-তুমি কিই বা করতে?জানি তোমার বাবার মত তুমি অবহেলা করতে না।তবে এটা হয়তো তুমি জানোনা যে,আমার অবহেলা সহ্য হয় কিন্তু করুণা, না, সহ্য হয়না।
-তোমাকে কেউ অবহেলা বা করুণা করেনি।যদি কেউ তা করে থাকে তবে সেটা তুমি।ছোট নিজেকে করেছ।জীবন সম্পর্কে কখনোই সিরিয়াস ছিলে না ।তোমার সোস্যাল স্ট্যাটাস তোমার পূর্ব পুরুষের অর্জিত সম্পদ।তুমি ফেল করলে।আব্বা ঠিকই বলেছিলেন,তুমি একটা এ্যাবসুলেট ভেগাবন্ড।তোমাকে দিয়ে কিছু হবেনা।ঋদ্ধ মনে মনে ভাবে সত্যই নিজেকে নিয়ে ওর ভাবা হয়নি কখনও।না, জীবনে একবার সে নিজেকে নিয়ে ভেবেছে-যে দিন অর্জিয়তা চলে গেল।ঐদিন ওর ঠিক মনে আছে,বাড়ির উঠানের রাধাচূড়ায় প্রথম বারের মত লাল টকটকে ফুল ফুটেছিল।
-হয়তো তোমার কথায় ঠিক অর্জ।বা হয়ত তোমার মত একজনের জন্য পুরো জীবনটা হনুলুলুতে কাটিয়ে দেওয়া কতটাই না সহজ!
আস্তে আস্তে ট্রেন থেমে যায়।এ স্টেসনে নেই কোন কুলির হাকহাকি,নেই কোন দোকান বা মানুষের আধিক্য।শুধু নিয়নের মৃদু আলো।ঋদ্ধ এই স্টেসনে নেমে যাবে।
-অর্জিয়তা তুমি থাক তাহলে।আমি এই স্টেসনে নেমে যাব।অর্জিয়তার মাথায় কি যেন আসি আসি করেও আসে না।ও চুপ করে থাকে।
-আরে শাহেদ ভাই যে হঠাৎ পিছন দিকে তাকাই ঋদ্ধ।উৎস একজন মহিলা,সাথে আট কিংবা দশ বছরের ছেলে।
–শাহেদ ভাই নেমে যাচ্ছেন বুঝি?আপনার লেখা আমার খুব ভালোলাগে।
-আচ্ছা তাই নাকি?ঋদ্ধ হাসে।
-এটা আমার ছেলে অর্ক। যদি একটু বলতেন, ও যেন ভালো করে পড়াশুনা করে মানুষের মত মানুষ হয়।ঋদ্ধ ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
-অর্ক তুমি মায়ের কথা শুনবে।আর বড় হয়ে মানুষের মত মানুষ হওয়ার দরকার নেই।মানুষেরাই যেন তাদের সন্তানদের বলে, বড় হয়ে বাচ্চারা তোমরা সবাই অর্কের মত হবে।ঋদ্ধ প্লাটফর্মে নেমে যায়।
-আচ্ছা আপনি যাকে শাহেদ ভাই বললেন,উনি আসলে.....
-ওমা!আপনি চিনতে পারেননি?উনিতো এদেশের প্রথিতযশা রাইটার।আমি,আমার পরিবারের.........
মহিলার কোন কথায় অর্জিয়তার কানে আসেনা।জনালা দিয়ে সে ঋদ্ধকে খুজতে থাকে।অজস্র বৃষ্টির কুশায় অচেনা এক ঋদ্ধকে হারিয়ে যেতে দেখে সে।
তখনি তার মনে পড়ে মনে আসি আসি করে না আসা কথাটি-ঋদ্ধ কখনো,কোনদিন ওকে অর্জি ছাড়া অর্জিয়তা বলে ডাকেনি।