দুই আলোকবর্ষ দূরে
প্রথম প্রকাশ: ১৯ শে জুন, ২০২১
ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকাতেই বাহিরের ঘর-বাড়ি আর গাছপালার বৃষ্টি স্নান দৃশ্য সুজন কে মনে করিয়ে দেয়, পেছনে ফেলে আসা পুরনো কিছু স্মৃতি। যে ট্রেন চলেছে শহর অবধি, যে ট্রেন চলেছে পুরনো সংসারে সেই ট্রেনে অপেক্ষমাণ সুজনকে পুরনো স্মৃতি এসে হানা দিচ্ছে। আচ্ছা, আমাদের যা ছিলো বা আছে তা শুধু মাত্র অতীতের হাতে! ভবিষ্যতের জন্য বুঝি কিছুই বাকি নেই? হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে।
ইতি এর কথা আজকাল খুব মনে পড়ছে। আচ্ছা, সুজনের জীবনে এর চেয়ে ভালো কোনো স্মৃতি কি আর কখনো আসবে না? অথবা এমন কোনো সবুজ আসবে না? যে সবুজ ফেলে আসা অতীতের কাছে ম্লান হয়ে যাবে না। এই শহরে ওদের অনেক স্মৃতি। একসাথে ফুচকা খাওয়া, রেস্টুরেন্টে কফির আড্ডা, রিক্সায় ভিজতে বের হওয়া এই সমস্ত কিছু ছাপিয়ে আর কেউ কি নতুন কিছু উপহার দিতে পারবে না?
হয়তো পারবে, নয়তো পারবে না। কিন্তু যে মানুষটার জায়গা একবার হৃদয়ে সৃষ্টি হয় তা মেটানো সহজ নয়। অথবা সে জায়গায় অন্য কাউকে বসানো। সুজনের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা হয়তো ভিন্ন নয়। কিন্তু ওর আফসোস, “যা সবুজ, যা রঙীন, তা সহজেই হারিয়ে যায়।” মানে রঙীন যে কোনো কিছুরই রঙ বদলায়। খুব দ্রুত বদলায়। সুতরাং দিনশেষে আরো একজন রঙীন কেউ আসলে তার রুপ পরিবর্তন হবে না এমন চিন্তা করাটা অন্যায়।
ইতি বেশ বাস্তবধর্মী একজন মেয়ে। কতদিন কথা হয় না, দেখা হয় না, কিন্তু তার ফেসবুক প্রোফাইলের টাইমলাইন কি জীবন্ত। সবকিছু কত ঠিকঠাক ভাবে চলছে। প্রাণবন্ত, আর সুজন অসাড় হয়ে পড়ে আছে। এখনো নিয়মিত পরিবারের যত্ন নিয়ে যাচ্ছে, পড়াশোনাটা চালিয়ে যাচ্ছে। ওর মত মেয়ের জন্য এই শহর বেশ বেকায়দার। এখানে এত মতলবি মানুষজন আছেন যে, তারা স্রেফ তার দেহ চায়। কিন্তু সুজন ব্যতিক্রম, ইতির জানার কথা।
শেষ যেদিন ওদের দেখা হয়েছিলো, সেদিনও বাচ্চাদের মত বোতল নিয়ে খেলা করছিলো মেয়েটা। আর সুজনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। মানে সুজনের উপস্থিত থাকাটা ইতির কাছে খুব জরুরী, এমনকি তখন কথা বলারও প্রয়োজন পড়ে না। তারপর পৃথিবী অসুস্থ হয়ে পড়ে। দুজনে আবার আলাদা আলাদা রাস্তায় হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু সুজনের মনে হতে থাকে, এই দুরত্ব কয়েক আলোকবর্ষের দূরত্ব।
ম্যাসেঞ্জারে নতুন একটি মেসেজ, “আচ্ছা, সুজন। আজ থেকে দশ বছর পরেও আমাদের গল্পটি কি একই রকম থাকবে? তুমি ভুলে যাবে, আমিও। তাই না?” সুজন সেদিন বুঝে গেছিলো, যে গল্পের বীজ দুজনে মিলে কোনো একদিন সুস্থ শহরে বোপণ করা হয়েছিলো আজ তা আগাছা দিয়ে ঢেকে গেছে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুজন উত্তর দিলো, “দশবছর পর আমি বা তুমি বেঁচে থাকবো তো? আজ আছি দুজনে একসাথে। এই থাকাটা জরুরী।” সুজন নিজেকে এখন অপরাধী মনে করে। ইতির সাথে অন্যায় করেছে সে। মুক্ত পাখি কখনো কখনো এত সুন্দর হয় যে, আমাদের ইচ্ছে করে তাকে খাঁচায় বন্দি করে রাখি। যাতে আজীবন তাকে কাছে থেকে দেখতে পারি। কিন্তু মুক্ত পাখি আকাশে বেশ মানায়, খাঁচায় নয়। তাই হয়তো সুজন একসময় সব ছেড়ে দিয়েছিলো।
দীর্ঘদিন ওদের মধ্যে কথা হয় না আর। একদিন সুজনের রেজাল্ট বের হলো আর সাথে কিছু সফলতার গল্প। ভাগাভাগি করার মত শুধু সুজনের কাছে তখন ইতি-ই ছিলো। তাড়াহুড়ো করে ফোন দিয়ে এসব জানাতে গিয়ে বুঝতে পারলো, বেশ দেরি হয়ে গেছে। ইতির কন্ঠ কান্নাভেজা। শুধু বললো, “জেনে খুব আনন্দিত হলাম। কিন্তু এতদিন পর কেন? সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাকে ব্লক করে দেওয়া হলো কেন? সঠিকটা বলবে?”
সুজনের এমনিতেই নিজেকে মতলববাজ মনে হচ্ছিলো। তার উপর এমন প্রশ্নে বিদ্ধ হয়ে বেশ হড়কে গেল। বুঝানোর চেষ্টাও করলো ইতিকে। কিন্তু ইতি সত্যিটা ঠিকই ধরতে পেরেছিলো সেদিন। আসলে অসুস্থ সমাজে আর দারিদ্রতার কারাগারে ওদের মত মানুষদের অনেক কিছুই ভোগ করতে হয়। ইতি আর সেধে এসে কিছুই বললো না। আর কোনদিন বলবে কি না! সেটাও সুজনের আজও অজানা। শুধু মনে হলো, ইতি তার দিক থেকে এই গল্পের ইতি টানলো।
শুধু সুজনের ভালো করে বলা হলো না, ইতি তুমি আমার সর্বশেষ গল্প। এরপর আর হয়তো গল্প লেখা হবে না। প্লিজ! থেকে যাও না। একা হাঁটতে চলেছি। খুব কষ্ট হবে জানো। তুমি অন্য কাউকে নির্ণয় কেন করলে? অঙ্কটা এখনো বাকি থেকে গেলো।
এসব ভাবতে ভাবতে একসময় সুজনের চোখে জল চলে আসলো। নেমে পড়লো সেই পুরনো অসুস্থ শহরে। আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে ওর তা ভেবেই বেশ হয়রান লাগছে।
ছবি: Bing Enterprise (Copilot Ai)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:৫৮