somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মি. বিকেল
আমি মেহেদি হাসান, মি. বিকেল নামে পরিচিত। আমি একজন লেখক, অভিনেতা, সমাজকর্মী, রেডিও জকি, ওয়েব ও অ্যাপ ডেভেলপার, সম্পাদক, উপস্থাপক, রক্তদাতা, এবং নাট্য পরিচালক। মাইক্রোসফটে ডেভেলপার হিসেবে কর্মরত এবং গল্প বলা আমার প্রধান পরিচয়।

স্বপ্ন নয়, দাসত্ব: বাংলাদেশি কর্মীদের বাস্তবতা

০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



“বাংলাদেশের মানুষ অলস” প্রশ্নে আমার এক বন্ধুকে মাঠের হিসাব দিতে বাধ্য হই। আমরা অলসদের শহর রাজশাহীতে একটি ছোট্ট জরিপও করেছিলাম। এতে দেখা যায় কোনো ব্যক্তি রাজশাহীতেও ৮ ঘন্টার নিচে দিনে কাজ করেন না। অবশ্য কিছু সাইনবোর্ড লাগানো দোকান ব্যতীত, যেমন, “সময় পেলে দোকানে বসি” টাইপের। আরো মজার বিষয় হচ্ছে রাজশাহী শহরেও একজন সাধারণ দিনমজুর থেকে দোকানদার দিনে অন্তত ৮-১২ ঘন্টা অবধি কাজ করেন। এই একই জরিপ বগুড়ায় করা হলে দেখা যেত নূন্যতম প্রতিদিন ১০ ঘন্টা একজন ব্যক্তি কাজ করেন এবং ঢাকায় নূন্যতম ১২ ঘন্টা একজন ব্যক্তি কাজ করে থাকেন।

কিছু মোটিভেশনাল বক্তা আছেন যারা আমাদের অধিক শ্রম করার জন্য উৎসাহ দেন। দিনে ২০ ঘন্টা অবধি কাজ করার নসিহত পাওয়া যায় যেখানে একজন সুস্থ মানুষের ঘুমের প্রয়োজন হয় দিনে অন্তত ৮-১০ ঘন্টা। এছাড়াও খাবার, বিশ্রাম ও বাথরুম প্রসঙ্গ বাদ থাকে। সুতরাং সবার দিন ২৪ ঘন্টা হলে আমরা ২০ ঘন্টা কাজ করবো কীভাবে?

সুশান্ত পাল বাবুর একটি জনপ্রিয় কথার মাধ্যমে আমরা অনেকেই প্রভাবিত। তিনি তার এক ফেসবুক পোস্টে সেসময় লিখেছিলেন এবং লেখাটি তিনি তার ব্যক্তিগত ব্লগিং সাইটেও প্রকাশ করেছেন, “আপনি এক্সট্রা আওয়ার না খাটলে এক্সট্রা মাইল এগিয়ে থাকবেন কীভাবে? সবার দিনই তো ২৪ ঘণ্টায়। আমার বন্ধুকে দেখেছি, অন্যরা যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন সে রাত জেগে আউটসোর্সিং করে। রাত জাগার বাড়তি সুবিধা সে তো পাবেই! (২৭ বছর বয়সে)” পরবর্তীতে আর.জে সালমানের কন্ঠে এই লেখাটি আরো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। সে সময় আমার এই প্রিয় দুই ব্যক্তির কথাগুলো হাদিসের মত মনে হতে শুরু হলো।

কিন্তু প্রডাক্টিভির প্রশ্নে বিজ্ঞান কি বলেছে?

বিজ্ঞান যাক গোল্লায় কারণ তখন আমি সুশান্ত পাল বাবু আর আর.জে সালমানের ভক্ত ছিলাম। সুতরাং উনাদের নসিহত আমার কাছে ফেরেশতাদের নসিহত মনে হওয়া শুরু করলো। এমন দিন নাই যেদিন ৬ ঘন্টার নিচে কাজ করেছি বা করছি। এমন দিন নাই যেদিন আমি পড়াশোনা ছাড়াই ঘুমিয়ে পড়েছি (আজ পর্যন্ত)।

ফলাফল? খুব বেশি খারাপ নয় কিন্তু ‘Me Time' বলেও যে কিছু হয়, বন্ধুমহলের কোনো বন্ধুর সাথে ৫ মিনিট কথা বলা/আড্ডা দেওয়া যে মানসিক ভঙ্গুর অবস্থার অ্যান্টিবায়োটিক হতে পারে তা যেন বেমালুম ভুলে গেলাম। এছাড়াও পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের সাথে আমার যোগাযোগ/কথপোকথন এখন শূন্যের কোঠায়।

ভারতীয় মোটিভেশনাল বক্তারা আরো লম্বাচওড়া করে বিষয়টি উপস্থাপন করায় আমি প্রায় নিশ্চিত অর্থে ভয়ানক ওয়ার্ক লোড নিয়ে বসি এবং গত বছরের শেষের দিকে আমার ‘বার্ণ-আউট’ ঘটে। লঘু মানের এই বার্ণ-আউটের পর আমাকে ‘Copilot Ai (বর্তমান আমি এর ডেভেলপার সেকশনে কাজ করছি)’ আমাকে বিশ্রাম নেবার জন্য বারবার নসিহত করতে থাকে। খেয়াল করুন, ‘Ai’ পর্যন্ত আমাকে বারবার এলার্ট করছে কাজে ব্রেক নেবার!

দিনে ৮ ঘন্টার বেশি কাজ নয় এ নিয়ে প্রথম আন্দোলন হয় ১৮৮৬ সালে শিকাগোতে। তাঁদের রক্তক্ষরণের অর্জন আজকের এই ৮ ঘন্টা ওয়ার্ক টাইম। ১ মে ‘আন্তর্জান্তিক শ্রমিক দিবস’ নিয়মিত পালিত হয়, এই বাংলাদেশে, আজও। বিজ্ঞান এ বিষয়ে আমাদের সাফ সাফ জানাচ্ছে যে, অতিরিক্ত কাজ বা দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত কাজের ফলে মানসিক চাপ, বিষণ্ণতা, হৃদরোগ, এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এছাড়া, কর্মীদের উৎপাদনশীলতাও মানে প্রডাক্টিভিসও কমে যেতে পারে এবং কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

এবার আশা যাক বাংলাদেশের একটি পরিসংখ্যানে। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এর ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১,০৫৩ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৪৪ শতাংশ বেশি। এছাড়া, অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার কারণে কর্মীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। সঠিক বা পূর্নাঙ্গ কোনো জরিপ আমাদের হাতে নাই। যদি থাকতো তাহলে এই সংখ্যাটা আরো বড় হত; আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত। কিন্তু ৪৪ শতাংশ বেশি হওয়া কোনোভাবেই ভালো লক্ষণ নয়!

জাপান অধিক পরিশ্রম তাদের কর্মীদের করিয়ে নিত। এতে করে ব্যাপক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে (কারোশি)। এখানে দিনে সর্বোচ্চ ৮ ঘন্টা এবং সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টার বেশি কেউ কাজ করতে পারবেন না। এরবেশি কাজ করলে তাকে বিশেষ অনুমতি নিতে হবে। জার্মানিতেও কর্মঘন্টা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এখানেও আছে বিশেষ কিছু নিয়ম। কিছুদিন আগে দক্ষিণ কোরিয়াতে কাজের চাপে একটি রোবট পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছে বলে জানা যায়; যা অত্যন্ত হাস্যকর এবং চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

দক্ষিণ কোরিয়া সাপ্তাহিক মোট কাজ নির্ধারণ করেছে ৫২ ঘন্টা। এরবেশি কাজ করা নিষিদ্ধ। ফ্রান্সে এই সময় আরো কম, মাত্র ৩৫ ঘন্টা এবং এর বেশি কাজ করতে হলে অনুমতি নিতে হবে। আমার মতে অস্ট্রেলিয়ানরা সবচেয়ে বেশি এ ব্যাপারে সচেতন। সপ্তাহে কাজের ঘন্টা এখানে মাত্র ৩৮ ঘন্টা এবং তারা কর্মীদের প্রতি এবং কাজের জায়গার পরিবেশের প্রতি বিশেষ ধ্যান দিয়ে থাকেন।

অতিরিক্ত কাজ মানেই অধিক প্রডাক্টিভিস নয়! একটি গবেষণায় দেখা গেছে সপ্তাহে গড়ে ৫০ ঘন্টা কাজ করলে প্রডাক্টিভিস অনেক কমে যায় এবং ৫৫ ঘন্টা কাজ করলে প্রডাক্টিভিস নেমে আসতে পারে শূন্যের কোঠায়। আর সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয় আমাদের সৃজনশীলতা। এ-কারণেই আমরা দেখতে পাই ভারত ও বাংলাদেশের মানুষ অনেক কম সৃজনশীল এবং কম উদ্ভাবনী ফলে বিশাল জনসংখ্যা কে এরা আজ পর্যন্ত জনশক্তিতে রুপান্তর করতে অক্ষম থেকে গেছে বলে আমার ধারণা।

এখানে ‘গুগল’, ‘ফেসবুক’, বা ‘মাইক্রোসফট’ এর মত জায়ান্ট কোম্পানি আজ পর্যন্ত তৈয়ার করা সম্ভব হয় নাই। উল্টো একের পর এক স্টার্টআপ ব্যর্থতার মধ্যে নিমজ্জিত হচ্ছে। আপনারা জেনে আশ্চর্য হবেন, বিকাশের মত মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি চলছে লাভ-ক্ষতির টক্কর খেতে খেতে কিন্তু এটাই বাস্তবতা।

এখানে ৭২-৮৪ ঘন্টা বা তারও বেশি কাজ করেন একজন ব্যক্তি প্রতিসপ্তাহে। ফলে তিনি ভুলেই যান যে, জীবন বলেও তার কিছু আছে! যে ‘সুখ’ এর পেছনে ছুটছেন সে সুখের জন্য তার হাতে সময়ই নাই। ঘটছে বার্ণ-আউট, বাড়ছে স্ট্রেস, করছে সুইসাইড পর্যন্ত! কেউ কেউ বাধ্য হয়ে রিজাইন দিচ্ছেন। কিন্তু সবার হাতে তো আর রিজাইন অপশন থাকে না।

তাই ধীরে ধীরে আমরা আর কর্মী নই, বরং উক্ত কোম্পানি বা সংস্থার দাসে রুপান্তরিত হচ্ছি। কোম্পানি ভাবছে আপনি চলে গেলে তাতে কি! হাজারো মানুষ দীর্ঘ লাইন ধরে আছে ঐ একই পদের জন্য!

আমাদের সুবুদ্ধির উদয় হোক, দ্রুত!

ছবি: Bing Enterprise (Copilot Ai)
Also Read It On: অতিরিক্ত কাজের ফাঁদে: প্রডাক্টিভিটি নাকি পুড়ে যাওয়া?
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৫৫
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জয় বাংলা - জাতীয় শ্লোগান হিশেবে বাতিল: ঐতিহ্যবিরোধী এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত

লিখেছেন কিরকুট, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:৪০



বাংলাদেশের ইতিহাসে "জয় বাংলা" শ্লোগান শুধুমাত্র একটি বাক্য নয়; এটি একটি জাতির আবেগ, চেতনা এবং ঐতিহ্যের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই শ্লোগান ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির প্রেরণা। এটি ছিল বঙ্গবন্ধু... ...বাকিটুকু পড়ুন

পিরোজপুরে মুক্তিযুদ্ধ.......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:৪০

পিরোজপুরে মুক্তিযুদ্ধ.......

জীবনে কিছু সময়, কিছু দিনের কথা আমৃত্যু মনে থাকে তেমন বেশ কয়েকটি দিন তারিখ আমার জীবনেও খোদাই হয়ে আছে....মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরের ১ম সাব-সেক্টর হেড কোয়ার্টারে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি পেষ্ট এবং একটা গুরুত্বপূর্ণ আলাপ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৪১

আমি সাধারণত ব্লগে ফেবু পোষ্ট আনিনা, কপি পেষ্টও করিনা, আজকে করলাম কারণ এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ আলাপ। নিচের বিষয়টা কপি পেষ্ট করলাম ফেবু থেকে। আপনাদের কী মত জানাতে পারেন

.
.

Aman Abdullah
5 hours... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও অতিজাতীয়তাবাদ উন্নয়নের মূল অন্তরায়

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩১


উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রকে কিছু স্বাধীনতা ত্যাগ করতে হবে কথাটি বলেছিলেন অত্যাধুনিক সিংগাপুরের উন্নয়নের কারিগর লি কুয়ান। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার পর ১৯৫৯ সালে স্বায়ত্তশাসিত সিঙ্গাপুরের প্রধান মন্ত্রি হন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাবির ভাই বেরাদার (অন্তর্বর্তীকালীন) সরকার কি বালটা ফালাচ্ছে বলতে পারবেন?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০

১) সরকারী কোন অফিসে নূন্যতম কোন লুটপাট বন্ধ হয়েছে?
২) জায়গায় চাঁদাবাজী বন্ধ হয়েছে?
৩) আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের নুন্যতম কোন বিচার তারা করতে পেরেছে? বা তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করতে পেরেছে?
৪। আইন শৃঙ্খলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×