এক.
সাল টা ঠিক মনে নেই। তবু যতটুকু মনে পড়ে, আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি আলাউল হলে শিবিরের ক্যাডারা তৎকালীন জাতীয় ছাত্র সমাজ নেতা হামিদের বাম হাতের কব্জি কেটে দিয়েছিল। সে ঘটনা এবং তৎপরবর্তী চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিবিরের পুনপৌনিক সন্ত্রাসের কারণে ছাত্র শিবির রগ কাটা সংগঠন নামে বেশ নাম কুড়িয়েছিল। আরেক ছাত্র ফ্রন্ট নেতার, তার নামটিও এ মুহুর্তে মনে নেই, একদিন তারই এলাকার শিবির কর্মীরা বড় ভাই বলে ডেকে নিয়ে চাকসু ভবনের মেঝেতে তার বাম ও ডান হাতের সব নখগুলো উঠিয়ে নিয়ে যায়। এ রকম অসংখ্য ঘটনার কথা বলা যায়। বিগত পাঁচ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও এ রকম কিছু বিভৎস ঘটনা ঘটিয়েছে শিবির ক্যাডাররা। তবে এ মধ্যযুগীয় বর্বরতার পরও কোন শুভ বুদ্ধির মানুষ একটি বারও এ রকম মন্তব্য করেনি যে, এসব ঘটনার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর মানুষ গড়ার কারিগর নয় (শুধু আলোচনার সুবিধার্থে এ দু'টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ব্যবহারের জন্য আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থী, কারণ আমার আলোচনার উদ্দেশ্য এ দু'টি বৃহত্তর প্রতিষ্ঠানকে কোন ভাবে খাটো করে দেখা নয়)। জামাত শিবিরের এ রকম আস্ফালন দেখে সকল প্রগতিশীল শক্তি বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়েছিল এবং এখনও হচ্ছে, আর এটাই স্বাভাবিক।
দুই.
'প্রশাসন' নামে একজন ব্লগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নানা 'অশ্লীল' বক্তব্যসমেত লেখা? ছাড়ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মানুষ গড়ার কারিগর কিনা তিনি এরকম একটি প্রশ্নও তুলেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ডাকাতদের গ্রাম বলেও অভিহিত করেছেন। এ ডাকাতদের গ্রাম কথাটি তিনি উদৃতি করার ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত হয়েছেন কবি আল মাহমুদের 'কদর রাত্রির প্রার্থনা নামক কবিতাটি থেকে। যে কবিতাটিতে আল মাহমুদ জগন্নাথ হলের নাম ব্যবহার করে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকাতার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষরও রেখেছেন খুব প্রবলভাবে। সে সময় একজন প্রগতিশীল কবি প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, যাদের জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়তো দূরে থাক, দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের বারান্দায়ও যাবার সুযোগ হয়নি তাদের পক্ষেই এ রকম বক্তব্য প্রদান সাজে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে 'প্রশাসন' বা তার সমর্থক ব্লগাররা কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে এ রকম 'অশ্লীল' বক্তব্য দিচ্ছেন? কারণ খুবই সুস্পষ্ট। দেশের মধ্যে এখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্বদ্যালয় একমাত্র পবিত্র জায়গা যেখানে কোন প্রতিক্রিয়াশীল, স্বাধীনতাবিরুধী শক্তি প্রকাশ্যে কার্যক্রম পরিচালনার সাহস পায়নি। যখনই চেষ্টা করেছে তখনই কোন ছাত্র সংগঠনের প্রয়োজন হয় নি, সাধারণ শিক্ষার্থীরাই রুখে দাড়িয়েছে তাদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে। এবং খুব ভালভাবে সফল হয়েছে। সুতরাং সাম্প্রদায়িকতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং স্বাধীনতা বিরুধীদের অপতৎপরতা প্রতিরোধে অতন্দ্র প্রহরী আমাদের প্রিয় ক্যাম্পাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাছে কোন ভাল লাগার জায়গা হতে পারে না। এবং এও নিশ্চিত যে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির এ ধরনের বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এ রকম আন্তর্জাতিক ইমেজ সমৃদ্ধ জাতির গৌরবের কিছু যায় আসে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অন্য কিছু নয়। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর মানুষ গড়ার কারিগর নয় বলে তারা যদি রগকাটায় সিদ্ধহস্ত মানুষের অনুসন্ধান করেন তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সেরকম মানুষ গড়ে তোলা কোন দিনই সম্ভব নয়।
তিন.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জেল থেকে মুক্তির পর এ রকম অশ্লীল প্রচারগুলো বেড়েছে। এর আগের একটি লেখায় আমি বলে ছিলাম যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়ের বিদ্যমান পরিস্থিতি দীর্ঘতর হলে লাভ হচ্ছে দু'টি পক্ষের। পক্ষ দু'টির একটি হচ্ছে একাত্তুরের পরাজিত শক্তি জামাত-শিবির। অন্যটি শিক্ষা বেনিয়াদের। যারা প্রাইভেটেজাইশনের নামে শিক্ষা বাণিজ্য সম্প্রসারণে ব্যস্ত। তারা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে চেষ্টা করেছে। সফল হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বীর বেশেই জেল থেকে বেরিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শনের জন্য সরকারকেও অভিনন্দিত করেছি। আমরা সবাই মিলে। ঠিক এ সময় সরকারের এ ধরনের মনোভাবের বিরুদ্ধে যেমন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি অবস্থান নিয়েছে, নানা কুট মন্তব্য করেছে, পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও নানা অশ্লীল বক্তব্য দেয়া শুরু করেছে। সুতরাং এর পেছনে কোন্ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি নিয়োজিত, তাদের উদ্দেশ্য কী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতিহাস বলে, প্রতিবার পরাজিত হবার পরই এ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আমাদের শ্রেষ্ঠ গৌরবের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়েছে। অপপ্রচার চালিয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু তাতে সাম্প্রদায়িকতা, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সকল প্রগতিশীল শক্তির লড়াই-সংগ্রাম কখনও থেমে যাবে না। জয়তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়........
পুনশ্চ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ আমাদের সকল গৌরবময় অর্জনের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অপকার্যক্রমে সহযোগী না হওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীত অনুরোধ করছি।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০০৮ দুপুর ১:৩৮