somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পুলিশি তল্লাশি এবং তদন্তের নির্মমতা গোলাম মাওলা রনি

২২ শে জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পুলিশি তল্লাশি এবং তদন্তের নির্মমতা এবিষয়ে গোলাম মাওলা রনির বক্তব্যঃ
বন্ধুর বাসায় নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে অদ্ভুত এক সমস্যার কথা শুনলাম। বন্ধুটি পেশায় উকিল এবং সরকারি দলের একজন মাঝারিগোছের নেতা। থাকেন উত্তরায়। দুইটি মেধাবী সন্তান নিয়ে তার গর্বের অন্ত নেই। উত্তরার রাজউক স্কুল অ্যান্ড কলেজে অধ্যয়নরত বড় ছেলেটি ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে ও ছোট টি অষ্টম শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে। ছেলেরা প্রতি বিকেলে বাসার সামনে খেলতে যায় এবং সন্ধ্যা নামার আগেই বাসায় ফেরে। সব কিছু এভাবেই ঠিকঠাক চলতেছিল। হঠাৎ করেই বিপত্তি দেখা দিলো এক সন্ধ্যায়। ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় ছেলেরা বাসায় ফিরল এবং পরপর কয়েক দিন মনমরা হয়ে থাকল। বাবা মা অনেক প্রশ্ন করার পরেও তারা কোন জবাব দিলো না। দিন দশেক পর তারা পুনরায় খেলতে যেতে শুরু করল অদ্ভুত এক পোশাক পরে। তারা পকেটবিহীন গেঞ্জি এবং ঢোলা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট কিনে আনলো এবং জাইঙ্গা ছাড়া প্যান্ট পরে খেলতে যেতে আরম্ভ করল।
পকেটবিহীন গেঞ্জি এবং পকেটবিহীন প্যান্ট জাইঙ্গা ছাড়া পরিধানের কী কারণ, এমনতরো প্রশ্ন বহুবার করার পরও সন্তানদের কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে আমার বন্ধু এবং তার স্ত্রী ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। আমাকে পেয়ে তারা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। কারণ ছেলেরা আমাকে ভীষণ পছন্দ করে এবং তাদের অনেক গোপন কথা খোলামেলাভাবে আমার কাছে প্রকাশ করে। আমি ছেলেদের জিজ্ঞেস করে যা জানতে পারলাম তার সারমর্ম হলো- তারা যখন মাঠে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলে বাসায় ফিরছিল- ঠিক তখন দু-তিনজন পুলিশ এসে তাদের দুই বন্ধুকে ধরে ফেলে। তল্লাশির নামে পুলিশ কলেজপড়–য়া সেই দুই তরুণের প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে- এই তো পেয়েছি, শালার পো শালারা ইয়াবা খাও। চলো থানায় চলো। আমার বন্ধুর ছেলেরা এই দৃশ্য দেখে কালবিলম্ব না করে ভোঁ দৌড় মেরে বাসায় চলে আসে। পরে তারা জানতে পারে যে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তাদের বন্ধুরা ইয়াবা মামলার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল বটে কিন্তু বিনিময়ে দুইজনকেই পিতার হাতে বেদম পিটুনি খেতে হয়েছিল এবং শাস্তিস্বরূপ চিরতরে মাঠে এসে ক্রিকেট খেলা বন্ধ হয়েছিল।
আমার বন্ধুর ছেলেরা বিষয়টি পরিবারকে জানায়নি এি কারণে যে তাদের পিতামাতা হয়তো তাদের খেলতে যাওয়া বন্ধ করে দেবেন। তারা অনেক ভেবেচিন্তে বের করল যে তাদের বন্ধুদের প্যান্টের যদি পকেট না থাকত তাহলে পুলিশ তো হাত ঢুকানোর সুযোগ পেত না। এই জন্য তারা দোকান থেকে পকেটবিহীন গেঞ্জি কিনল এবং মহল্লার টেইলারিং শপ থেকে বিশেষ ডিজাইনের পকেটবিহীন প্যান্ট বানিয়ে আনল। অতিরিক্ত এবং বাড়তি সতর্কতা হিসেবে তারা জাইঙ্গা ছাড়া প্যান্ট পরে খেলতে যেতে শুরু করল যাতে কোনো পুলিশ তল্লাশির নামে জাইঙ্গার ভেতর হাত ঢুকিয়ে চিৎকার করে বলতে না পারে গুপ্তস্থানে ইয়াবা রেখেছিস।
উপরি উক্ত ঘটনা ঘটেছিল প্রায় বছর দুয়েক আগে। এই সময়ে এসে অতীতের সেই কাহিনী মনে পড়ল বাংলাদেশের পুলিশপ্রধানের একটি বক্তব্যের কারণে। সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীর প্রতি নির্মম পুলিশি নির্যাতনের বিষয়ে বলতে গিয়ে পুলিশপ্রধান অনেক কথার ফাঁকে একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনকে জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন- রাব্বী ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। তিনি পুলিশকে তল্লাশি করতে দেননি। পুলিশের তদন্ত, তল্লাশি কিংবা যেকোনো কাজে বাধা প্রদান কিংবা বাধা প্রদানের চেষ্টা ফৌজদারি অপরাধ। পুলিশপ্রধানের বক্তব্যের সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। সেই সাথে তারও উচিত জনগণের বাস্তব সমস্যা এবং পুলিশভীতির কারণ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া।
বর্তমান সময়ে পুলিশ শব্দটি রীতিমতো একটি আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। এই বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্যের অদক্ষতা, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, বাড়াবাড়ি, ঘুষ, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সৎ, দক্ষ, সাহসী এবং বিচক্ষণ পুলিশ সদস্যরা কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছেন না। ফলে পুরো বাহিনী মারাত্মক ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে। কিছু পুলিশ সদস্য যতটা না অপরাধ করছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রচার পাচ্ছে ইমেজ সঙ্কটের কারণে। অব্যাহত প্রচার-প্রপাগান্ডা ও গুজবের কারণে জনগণের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে এবং এক ধরনের প্রবল ঘৃণা ও বিরক্তির সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় কোনো একটি ঘটনা ঘটা মাত্র সারা দেশের জনগণ, মিডিয়া, সুশীলসমাজ এবং বুদ্ধিজীবীরা একাট্টা হয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। ফলে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগটি পর্যন্ত পাচ্ছেন না।
পুলিশ সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত ধারণা অত্যন্ত ইতিবাচক- যদিও আমার জীবনের সর্বাধিক নির্মম কয়েকটি ঘটনা পুলিশই ঘটিয়েছে। এমপি নির্বাচিত হওয়ার আগে আমি জীবনে কোনো দিন থানায় যাইনি- কোনো ওসির সাথে সখ্য ছিল না। বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যারা পুলিশে চাকরি করতেন, তাদের সাথে হয়তো কালেভদ্রে দেখাসাক্ষাৎ হতো, কিন্তু ঘনিষ্ঠতা ছিল না। আমার চৌদ্দগোষ্ঠীর কারো বিরুদ্ধে থানায় মামলা তো দূরের কথা, একটি সাধারণ ডায়েরিও ছিল না। তার পরও আমি পুলিশকে ভালোবাসি এবং শ্রদ্ধা করি বিভিন্ন কারণে। আমার এক দাদা ছিলেন পাকিস্তান পুলিশের আইজি। এক কাকা ছিলেন অতিরিক্ত আইজি। বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে আরো অনেক নামকরা কর্মকর্তার সাথে যখন আবুল হাসনাত এবং মুজিবর রহমান ফারুকের নাম কেউ উচ্চারণ করেন তখন গর্বে আমার বুক ভরে ওঠে। অন্য দিকে পুলিশ নিয়ে কেউ মন্দ কথা বললেও আমার গায়ে লাগে।
ইদানীংকালের পুলিশের সার্বিক অধঃপতন, নৈতিক অবক্ষয় এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য শুধু পুলিশকে দায়ী করা ঠিক হবে না। রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে নিয়োজিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, লোভী ও স্বার্থপর ধনিক শ্রেণী, পাপিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী এবং নীতিহীন দুরাচার প্রকৃতির ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্তারা একত্রে মিলে আমাদের পুলিশের সর্বনাশ করে ফেলেছেন। একজন পুলিশের সিপাহি পদে নিয়োগ লাভের জন্য তিন-চার লাখ টাকা এবং এসআই পদের জন্য ১০-১২ লাখ টাকার ঘুষ তো ওপেন সিক্রেট। অন্য দিকে, ওসি থেকে ডিআইজি পদে ভালো কোনো পোস্টিং পেতে ১০ লাখ টাকা থেকে কোটি টাকার কাজকারবার জড়িত বলে নানা কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। পুলিশের যে সদস্য অর্থ পরিশোধের মাধ্যমে নিয়োগ লাভ করেন এবং পরবর্তীকালে পদোন্নতি ও বদলির জন্য পুনরায় মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করেন, তিনি ঘুষ খাবেন না তো করবেনটা কী?
সবাই পুলিশকে দলবাজ পুলিশ বলে গালি দেয়। কিন্তু একবারের জন্য ভাবেন না- পুলিশকে দলবাজ বানাল কারা। দলীয় এমপি-মন্ত্রীর সুপারিশ ছাড়া বর্তমানের কোনো ওসি পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে কোনো থানায় নিয়োগ দেয়া হয় না। অন্য দিকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কোনো দিন পুলিশকে দুর্নীতিমুক্ত হয়ে আইনশৃঙ্খলার উন্নতির জন্য চাপ দেন না। পুলিশের সততা-দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কোনো কর্মপরিকল্পনা এ দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডার মধ্যে নেই। বেশির ভাগ রাজনৈতিক নেতার পুলিশ বিভাগ সম্পর্কে স্বচ্ছ কোনো ধারণাই নেই। পুলিশ বলতে নেতারা সাধারণত দু’টি বিষয়কে ধর্তব্যের মধ্যে আনেন। প্রথমটি হলো- ক্ষমতায় থাকলে পুলিশকে পুরোপুরি বগলদাবা করতে হবে, পুলিশের অবৈধ আয়ে ভাগ বসাতে হবে এবং পুলিশি শক্তিকে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ঠেঙাতে হবে। দ্বিতীয়টি হলো- বিরোধী দলে থাকলে পুলিশের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে হবে। পুলিশের আনুকূল্য লাভের জন্য ঘুষ প্রদান করতে হবে এবং পুলিশ থেকে ৩৩ মাইল দূরে অবস্থান নিতে হবে।
আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পুলিশকে মানুষ বলে মনে করেন না। আমি নিজে দেখেছি, অনেক ওসি এমপি সাহেবের জন্য বাহারি মাছ, তরিতরকারি কিনে নিজ হাতে পৌঁছে দেন। অনেকে এমপিদের রাজনৈতিক কর্মীর মতো সারা দিন এমপির জনসভা, পথসভা এবং অন্য অনুষ্ঠানাদিতে যোগদান করেন। গভীর রাতে এমপি সাহেব বিছানায় যাওয়ার পর ওসি সাহেব থানায় ফেরেন। সরকারি দলের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে কেউ কেউ পুলিশকে ব্যবহার না করলেও বেশির ভাগই ব্যবহার করে থাকেন নিজ নিজ রুচি, পছন্দ ও ইচ্ছেমাফিক। অন্য দিকে যেসব এমপি দুর্বল প্রকৃতির অথবা দলীয় রাজনীতির অন্তর্দ্বন্দ্বে দুর্বলতম অবস্থায় রয়েছেন, তাদের সাথে ওসি সাহেবরা প্রায়ই অমানবিক আচরণ করে থাকেন।
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং পুলিশের পারস্পরিক সম্পর্কটির কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড না থাকার দরুন উভয় সম্প্রদায়ই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পুলিশ সুযোগ পেলেই রাজনৈতিক নেতাদের এক হাত নিয়ে নেয়- অন্য দিকে নেতারা সুযোগ পেলে পুলিশকে দিয়ে এমন সব মন্দ কাজ করিয়ে নেন, যা সচরাচর কোনো মনুষ্য সম্প্রদায় করে না। যে পুলিশ গতকাল রাজনৈতিক নেতার প্রতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে তার সীমা অতিক্রম করে বাজারসদাই পর্যন্ত করে দিয়েছে, সেই একই পুলিশ পরিস্থিতির কারণে ওই নেতাকে গ্রেফতার করে কিংবা রাজপথে ফেলে বেদম প্রহার শুরু করে। যেসব ঊর্ধ্বতন ও ক্ষমতাবান লোকদের নির্দেশে পুলিশ তার আচরণ পরিবর্তন করে, সেই কুশীলবরা একবারের জন্যও ভাবে না যে, রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার কী ভয়াবহ সর্বনাশ তাদের দ্বারা সংঘটিত হয়ে যাচ্ছে।
রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হওয়ার পর থেকে সমাজে রাজনীতিবিদেরাই সবচেয়ে ক্ষমতাবান এবং প্রভাবশালী বলে বিবেচিত হয়ে আসছেন। আমাদের পুলিশ গত ৪৪ বছরে রাজনীতিবিদদের এত পিটুনি দিয়েছে এবং এত লাঞ্ছিত-অপমানিত করেছে যে, তাদের পক্ষে সাধারণ মানুষকে অত্যাচার করা কোনো ব্যাপারই নয়। কোনো শিকারি যদি সারা জীবন বাঘ-সিংহ শিকার করে থাকেন, তবে তার কাছে ছাগল-ভেড়া শিকার যেমন মামুলি ঘটনা; তেমনি বড় বড় রাজনীতিবিদ এবং প্রভাবশালী হর্তাকর্তাকে পেটানো পুলিশের কাছে সাধারণ মানুষকে অত্যাচার করা কোনো ঘটনাই নয়। গত ৪৪ বছরে পুলিশের মন্দকর্ম যেমন গাণিতিক হারে বেড়েছে, তেমনি তাদের শুভকর্মগুলো কমে গেছে জ্যামিতিক হারে।
২০১৬ সালে এসে বাংলাদেশ পুলিশ সত্যিকার অর্থেই একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। পুলিশ আজ নিজেদের ভারেই ভারাক্রান্ত। নানা অনিয়ম, অপেশাদারিত্ব এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পুরো প্রতিষ্ঠানটিকে যাচ্ছেতাই বানিয়ে ফেলেছে। পুলিশের অনেক ভালো ভালো কর্মকে তাদের মন্দকর্মগুলো মহাকাশের ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের মতো গিলে খাচ্ছে। এই নির্মম সত্য যদি দেশের পুলিশপ্রধান অনুধাবন করতে সক্ষম হন, তবেই সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল। অন্যথায় পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপের দিকে চলে যাবে, যেখান থেকে কোনো অবস্থাতেই ফেরত আসা সম্ভব হবে না। পুলিশকে ধীরে ধীরে তাদের মন্দকাজগুলো পরিহার করে পেশাদারিত্ব অর্জক রতে হবে। এ ক্ষেত্রে তল্লাশি এবং তদন্তে যে অনিয়ম, দুর্নীতি ও নির্মমতা চলছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সর্বাগ্রে।
পুলিশের বদনাম এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, রাস্তায় যদি তারা কাউকে তল্লাশির জন্য থামতে বলে তবে লোকটির অন্তরাত্মায় কাঁপন ধরে যায়, আমাদের দেশের অপরাধীরা পুলিশকে একটুও ভয় পায় না। উল্টো বেশির ভাগ পুলিশ অপরাধীদের ভয় পায় এবং তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের রীতিমতো তোয়াজ করে চলে। নিরীহ ও নিরপরাধ সাধারণ মানুষ পুলিশকে যমের মতো ভয় পায় এবং তারাই পুলিশি নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয় সবচেয়ে বেশি। পুলিশ সব সময় প্রচলিত অপরাধগুলোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মানুষজনকে হয়রানি করে থাকে। হরতালের সময় তল্লাশির নামে পাইকারি হারে লোকজনকে ধরে এবং বিরোধী দলের লোক আখ্যা দিয়ে ঘুষবাণিজ্য শুরু করে দেয়। অন্য সময়ে ইয়াবা, গাঁজা, অবৈধ অস্ত্র, বিভিন্ন মাদক, বিদেশী মুদ্রা এবং পেশাদার পতিতাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তল্লাশির নামে তাণ্ডব চালায়।
তদন্তের ক্ষেত্রে পুলিশ সুযোগ পেলেই নির্মম আচরণ করে থাকে। নিম্ন আদালতের বেশির ভাগ মামলা থেকে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায় পুলিশের দুর্বল তদন্ত প্রতিবেদনের কারণে। খোদ প্রধান বিচারপতি এ ব্যাপারে তার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অন্য দিকে লাখ লাখ রাজনৈতিক মামলা তদন্তের নামে বছরের চর বছর ঝুলিয়ে রাখা হয়। যেখানে রাজনৈতিক চাপ দুর্বল থাকে ও বিবাদিরা বিত্তশালী হয়, সেখানে পুলিশের ফাইনাল রিপোর্ট দিতে ২৪ ঘণ্টাও লাগে না। অন্য দিকে টাকা-পয়সার লেনদেন না হলে কিংবা মামলাটিতে ক্ষমতাবানদের স্বার্থ জড়িত থাকলে থানা পুলিশ অন্ধ, বধির ও বোবা হয়ে যায়। থানায় দায়ের হওয়া লাখ লাখ মিথ্যা মামলার জন্য লাখ লাখ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় হাজির হয়ে পুলিশের নির্মমতার জন্য অভিশাপ দিয়ে থাকে, যার ভয়াবহ পরিণতি কল্পনাও করা যাচ্ছে না।
পুলিশি তদন্ত ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা এবং ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা না গেলে আমাদের পুলিশ কোনো দিন ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। মামলা গ্রহণের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও নীতিবোধ বা ইচ্ছাধীন জুডিশিয়াল মাইন্ড ব্যবহার না করলে পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমি সংসদ সদস্য হওয়ার পর দেখলাম, গলাচিপা থানায় অসংখ্য অদ্ভুত মামলা পাঁচ-সাত বছর ধরে চলে আসছিল। একজন ধনাঢ্য ও সম্মানিত ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে জনৈক পাগলকে দিয়ে ঝোলাগুড় চুরির মামলা দায়ের করা হয়েছিল। আরেকজন সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ছিল ডিম চুরির মামলা। এক মহিলাকে দিয়ে করানো হয়েছিল হাঁস চুরির মামলা। আমি পুলিশকে বলে সাত দিনের মধ্যে ওইসব মিথ্যা মামলার ব্যাপারে ফাইনাল রিপোর্ট দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। আমার কার্যকালীন আমার আওতাভুক্ত দু’টি থানায় মাত্র দু’টি রাজনৈতিক মামলা হয়েছিল। একটি মামলা ছিল গ্রাম্য একটি বাজারে ৫০-৬০ জন লোক নিয়ে একটি দোকান লুটের ঘটনাকে কেন্দ্র করে, যে দোকানে তিন-চার হাজার টাকার বেশি মালামাল ছিল না এবং এখনো নেই। অন্য মামলাটিতে আসামির সংখ্যা ৩০-৩৫ জন, যারা একজন গ্রাম্য টাউটকে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মুখে রাস্তার ওপর দাঁড় করিয়ে তার সর্বস্ব ছিনতাই করেছিল থানা পুলিশের সামনে। গলাচিপা থানার ওসি এবং পটুয়াখালী জেলার এসপিকে জিজ্ঞেস করলাম- এমন গাঁজাখোরি, মিথ্যা, গুজব ও অদ্ভুত কাজ করলেন কোন যুক্তিতে- কার হুকুমে এবং কার বুদ্ধিতে? তারা বললেন- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হুকুমে মামলা নিতে বাধ্য হয়েছেন। আমি হেসে বললাম, একজন মন্ত্রীর হুকুমে একটা কাজ করলেন। একটু বুদ্ধিশুদ্ধি খরচ করে বিশ্বাসযোগ্যভাবে মামলাটি এজাহার হিসেবে নিলে ভালো হতো না? তারা কোনো জবাব না দিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে অর্থপূর্ণ হাসি হাসতে লাগলেন। আমাদের আইজি সাহেব ইচ্ছে করলে গলাচিপা থানার মামলা দু’টির খোঁজখবর নিতে পারেন এবং তৎকালীন ওসি-এসপিকে পুরস্কৃত করতে পারেন চমৎকার সঠিক ইতিহাস রচনার কৃতিত্বের জন্য। অন্য দিকে বর্তমান ওসি-এসপিকে ধন্যবাদ দিতে পারেন মামলাটির চার্জশিট অথবা ফাইনাল রিপোর্ট না দিয়ে জিইয়ে রাখার জন্য।

সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:৩০
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×