আনন্দবাজার পত্রিকার মতে ঢাকার পহেলা বৈশাখ উদযাপন কলকাতার পুজোর সাথে খাপে খাপে মিলে গেছে। তাদের কথায়, "কার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে! কখনও মনে হচ্ছিল কলকাতার কলেজ স্কোয়ার বা একডালিয়ার পুজো মণ্ডপ।" মাদ্রাসার বুজুর্গ হুজুর আর আমার মত সেক্যুলার শিক্ষিত হুজুররা যখন কয়ছি যে এ "মঙ্গল" শোভাযাত্রা পৌত্তলিকতা চর্চা ভিন্ন কিছুই নয়, তখন আমাদেরকে "ব্যাকডেটেড" মনে করছেন (যদিও ব্যাকডেটেড হইতে আমগ আপত্তি নাই)। এখন যেহেতু "ফ্রন্টডেটেড" আনন্দবাজার খুশিতে গদগদ হয়ে ঘোষণা দিছে এ অনুষ্ঠান উদযাপন পুজো মন্ডপের মত, তখন নিশ্চয়ই অযথা আর তর্ক করবেন না।
পৌত্তলিকতাকে সার্বজনীন বাঙালি উৎসব বলে চালিয়ে দেওয়াটাকে অনেকেই গুরুত্বসহকারে দেখছেন না। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রভাব সম্পর্কে এদের ধারণা নেই সেজন্যই। ইতিমধ্যেই স্কুল-কলেজ এবং মাদ্রাসায় "মঙ্গল শোভাযাত্রা" পালনের জন্য সরকারি নির্দেশ এসেছে। স্কুল-কলেজের কথা নাই বা বললাম, মাদ্রাসার কথাই বলি। ইসলাম হইল চরম একত্ববাদের (radical monotheism) ধর্ম, একত্ববাদ ইসলামের মৌলিক এবং প্রথম বিষয়, পৌত্তলিকতা মক্কার সমাজে বিরাজমান ছিল, সে পৌত্তলিকতাকে অস্বীকার করেই ইসলামের বয়ান শুরু। এখন সার্বজনীন বাঙালিত্বের নামে আপনারা ইসলামি দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর জোরজবরদস্তিমূলক ইসলামের সবচেয়ে মৌলিক বিষয়ের বিরোধী আক্বীদা চাপিয়ে দিচ্ছেন। হিন্দুদের যদি জোরজবস্তি করে পূজা করতে না দেন সেটা তাদের জন্য যেরকম, সেরকমই হচ্ছে মুসলমানদের উপর পৌত্তলিকতা চাপিয়ে দেয়া। যখন মাদ্রাসার লোকজনকে "মঙ্গল শোভাযাত্রা" বের করতে বাধ্য করছেন, তখন তাদেরকে শুধুমাত্র আল্লাহর কাছে "মঙ্গল" প্রার্থণা করার যে একত্ববাদের বিধান, সে বিধানের বিপক্ষে দাড়াতে বলছেন। এটা সম্ভব হয়েছে কারন আপনারা পৌত্তলিকতাকে সার্বজনীন বাঙালিত্ব বলে জাহির করেছেন।
১৯৪৮ সালে জিন্নাহ আমাদের কইছিল "উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ঠ্রভাষা হবে" তখন সেটা ছিল সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। ভাষা হইল সংস্কৃতির অংশ। এখন ২০১৮ সালে কইতেছেন "পৌত্তলিকতা চর্চা" সার্বজনীন বাঙালি হওয়ার পূর্বশর্ত। এবং আপনার সে সার্বজনীন বাঙালির সংজ্ঞা মুসলমানদের ধর্মের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে ফান্ডামেন্টাল বুনিয়াদ, একত্ববাদ, সে বুনিয়াদের সাথে সাংঘর্ষিক পৌত্তলিকতাকে স্কুল-কলেজ এমনকি দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসায় চালু করার নির্দেশ দিছেন। অনেকে বলছেন "মঙ্গল শোভাযাত্রায়" না গেলেই তো হয়। সেটা হয়, এবং সেখানে লোকে যাওয়া অনেক কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই যে জোরজবরদস্তি করে মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া, এটারে কি কইবেন? এখানে তো চয়েসের কোন ব্যাপার নাই। শোভাযাত্রায় না গেলেও তো তা আমগ মাথায় জোর করে ভর করছে।
কেউ কেউ দেখি যুক্তি দিচ্ছেন "হিন্দুরা ভাত খায়, আমরাও ভাত খায়, তাহলে তো ভাত খাওয়া বাদ দিতে হবে"। এসব বলদীয় যুক্তি। বলদীয় যুক্তির সাথে তর্কে যাওয়া মানা, তবুও এটা আলোচনা করছি। যারা এ ধরণের যুক্তি দিচ্ছে তারা ধরে নিচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রার সাথে পুজামন্ডপের মিলটা অবশ্যম্ভাবি এবং কাকতালিয়। ক্ষিধে লাগলে খাবার খাওয়া অবশ্যম্ভাবি, তাই সেখানে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান সবার মিল থাকবে। তেমনি বৃষ্টি হলে হিন্দু আর মুসলমান দুজনের ছাতা থাকলে দুজনই ছাতা ধরবে, এটা কাকতালিয়, বৃষ্টি আসা হেতু কাকতাল। ঢাকার পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা অবশ্যম্ভাবিও না, কাকতালিয় হওয়ার প্রশ্নই নেই। ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রায় মূর্তিসমূহের মধ্যে অর্থ খুঁজে পাওয়া নিতান্তই পৌত্তলিকতা বৈ কিছু নয়, কাকতাল হওয়ার কোন যুক্তি নেই। মূর্তিগুলোর শুভ আর অশুভ অর্থ আরোপ নিয়ে উৎসব আয়োজনের উদ্যোক্তারাই অনেকবার বলেছেন, তাই এটা তর্কসাপেক্ষ কোন ব্যাপার না। আর মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালির হাজার বছরের কোন ঐতিহ্য না, তাই এটা অবশ্যম্ভাবি কোন অনুসংগ না। তাহলে এটা কি? এটা হল পরিকল্পিতভাবে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ/আগ্রাসন। এবং সেটাকে সার্বজনীন বলে জোরজবরদস্তি করা, ইউনেস্কোর কাছে লবিং করে ভুলভাল তথ্য দিয়ে এটাকে হাজার বছরের ঐতিহ্যের সনদ নেওয়া, এবং স্কুল-কলেজে এমনকি মাদ্রাসায়ও এটা চালু করার জন্য নির্দেশ জারি করা, এসবে বুঝা যায় এটা খুবই পরিকল্পিত।
আপনি যদি মুসলমান হোন তাহলে তো আপনি অবশ্যই পৌত্তলিকতাকে আপনার উপর চাপিয়ে দিয়ে আপনার ধর্মের সবেচয়ে মৌলিক বুনিয়াদকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ব্যাপারে চিন্তিত হবেন। কিন্তু আপনি যদি মুসলমান নাও হন, যদি ধর্ম আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ন নাও হয়, বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বি হোন, তবুও আপনার এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করা দরকার। কেননা এক ধর্মের উপর অন্য ধর্মের আচার-আচরণ চাপিয়ে দিলে সেটা অনেক খারাপ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করবে। এরকম দৃষ্টান্ত অনুসরন করে ভবিষ্যতে মুসলমানরা ক্ষমতা ব্যবহার করে হিন্দুদের তাদের ধর্মীয় আচার-আচরন পালন করা বা না করার জন্য বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করতে পারে, সে ভয় অমূলক নয়। তখন কিন্তু আপনারা কিছুই বলতে পারবেন না, সে মুখ আর থাকবেনা। এরচেয়েও বড় কথা হল এটা মুসলমান আর হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস এবং দ্বন্দ সৃষ্টি করে। মুসলমানরা মনে করবে নিজেদের দেশে সংখ্যাগরিষ্ট্য হয়েও তাদের উপর হিন্দুদের আচার আচরন পালন করার বাধ্যবাধকতা আসছে, পৌত্তিলিকতা চর্চা না করলে তারা বাঙালি হতে পারছেনা, এটা জনমনে ঘৃনা সৃষ্টি করবে এবং এর পরিণতি ভয়ংকর। তাই আপনি মুসলমান হোন বা না হোন, ধর্মের ব্যাপারে সিরিয়াস হোন বা না হোন, এটা আমাদের দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোন ইস্যুকে বিভাজনের মাধ্যম হওয়ার আগেই অংকুরে বিনষ্ট করা জরুরী। পরে ইস্যু বড় হয়ে গেল, বিভাজন বেড়ে গেলে, তখন সেটা আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ে, সেটা তখন দমন করা কঠিন হয়ে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪২