somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লালন ফকির ও কতিপয় গুরুতর প্রসঙ্গঃ পর্ব-৬

১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সকাল ১১:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পর্বঃ ৬
আমার লেখার মূল লক্ষ্য হলো, ভুলক্রমে অথবা যথেষ্ট গুরুত্ব না দেয়ার কারণে আমরা যে লালনকে নিয়ে কামপন্কিল অমার্জনীয় অশ্লীলতা ও শিরকের এক গভীর গহবরে নিজেদেরকে নিক্ষেপ করছি, এক্ষেত্রে কিছুটা হলেও বোধোদয় ঘটানো। সুখের বিষয় আমার আগের আলোচনা একেবারে বিফলে যায় নি, কেউ কেউ কিছুটা ক্রুদ্ধ হলেও, কারো কারো মধ্যে অল্পাধিক পরিবর্তনও এসেছে। আসলে ইসলাম এমন একটা শ্লীল, পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন জীবনের কথা বলে, যেখানে কোন কপট ও রিরংসু লালন ফকিরের স্থান নেই। স্থান তো নয়ই বরং এই জাতীয় জঘণ্য যৌনদর্শনকে যথাসাধ্য প্রতিরোধ করা যে কোন মুসলমানের জন্য ফরজ। এবং এটা শুধু হঠাৎ আমিই বলেছি তা নয়, লালনের সমসায়িককালে এবং পরে বহু আলেম তাকে ইসলামের ঘোরতর দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করে এই ফিতনাকে উৎপাটিত করার যথাসাধ্য ব্যবস্থা নিয়েছেন। কিন্তু শয়তান ও তার কুৎসিত অপকর্মকে দীর্ঘায়ূ দান করে আল্লাহপাক যেহেতু নানাভাবে মুসলমানদের পরীক্ষা করে নিতে চান, তাই লালনকে দৃশ্যপট থেকে একেবারে বহিস্কার করা যায়নি। না যাক, কিন্তু তার অশ্লীল বুজরুকি যে সমূলে উৎখাত করা প্রয়োজন, এই ঈমানী সাহস নিয়ে আল্লাহর একদল তওহীদি বান্দা লালনের জীবদ্দশাতেই যেমন সক্রিয় ছিলেন, এখনো আছেন। আমরা পশ্চাদদিকে লক্ষ্য করতে পারি, কি ছিল তখনকার প্রতিক্রিয়া।

এই ধরণের বাউল বা নাড়ার ফকির সম্পর্কে মুন্সী মেহেরুল্লাহর ধারণা ছিল, বানাইল পশু তারা বহুতর নরে। মীর মোশাররফ হোসেনও বাউল সম্পর্কে অকেশে বলেছেন, এরা আসলে শয়তান, কাফের, বেঈমান, তা কি তোমরা জান না। কবি জোনাব আলী প্রচন্ড ঘৃণায় ও আক্রোশে সরাসরি এই উক্তি করেছেন, লাঠি মারো মাথে দাগাবাজ ফরিরের। (সূত্র লালন শাহঃ আবুল আহসান চৌধুরী) লালনের মৃত্যুর ঠিক সাথে সাথেই প্রকাশিত (১৯০০ সাল, লালনের মৃত্যু ১৮৯০) মৌলভী আবদুল ওয়ালী তার একটি ইংরেজী প্রবন্ধে খুব সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন, কিছু তথাকথিত মুসলমান ফকির অন্য মুসলমানকে ইসলামের বিরুদ্ধে ভূমিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করছে, তাদের কাজ হলো নিজেদের মতবাদের সমর্থনে (কুরআরন করিম থেকে) ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও ভুল উদ্বৃতি তুলে ধরা। মুন্সী এমদাদ আলী লালনের নাম পরিস্কার নামোল্লেখ করে বলেছেন, নাড়া যে কি ধর্ম তাহা ব্যক্ত করা বড়ই দুরূহ। এমন অসভ্য অশ্লীল ব্যবহার জগতে কোন মনুষ্যের দ্বারা হইতে পারে, এমন বিশ্বাস হয় না। এমনকি সর্বজন শ্রদ্ধেয় মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁও মুসলিম সমাজের অধঃপাত ও শোচনীয় অবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে মারেফতি ফকিরদের উদ্ভবকে দায়ী করেছেন এবং বলেছেন সামাজিক জীবনের মারাতœক ব্যাধি।

মোঃ আবু তাহের বর্ধমানী লালনকে বলেছেন, ইসলামবিরোধী, শরীয়ত বিরোধী, বেশরাহ, বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট ফকির; বলেছেন, লালনের গানে আছে নরনারীর অবাধ মিলনের প্রেরণা, লালনের গানে আছে গুপ্ত যৌনপ্রক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়ার গভীর উৎসাহ, লালনের গাছে আছে নাপাক দ্রব্য (কামাচারপ্রসূত বীর্য ও রতিরস) ভণ করার প্রেরণা, লালনের গানে আছে তৌহিদ বিরোধী কামাম।

আফসোস, এরপরও লালন আজ আমাদের কাছে আউলিয়া, গভীর আধ্যাত্নিক জগতের এক অবিসংবাদিত কামেল পুরুষ। কামেলই বটে! কিন্তু এই মহাপুরুষের শিষ্য-প্রশিষ্যেরা এখন যদিও মুক্তবুদ্ধি, উদার, অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিসেবীদের ব্যবস্থাপনা ও সরকারী পৃষ্টপোষকতায় আনন্দে-নির্বিঘ্ন বছরে অন্তত দু'বার লালন আখড়ায় জমজমাট গঞ্জিকাসেবন ও রসরতির আসর বসায়, কিন্তু একদা বড় বিপদের মধ্যে ছিল। অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী জনাব শামসুদ্দিন আহমদের অগ্রজ মাওলানা আফসার উদ্দিন ছিলেন ইসলামপ্রেমী এক তেজস্বী পুরুষ। তিনি দোলপূর্ণিমার বার্ষিক উৎসবে আগত বহু ফকিরের ঝুটি বাবরি কেটে দিয়েছিলেন। তার জীবদ্দশায় লালনের আখড়া ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলে বাউলদের কোন অনুষ্ঠানতো হতেই পারেনি, ভয়ে অনেক লালন শিষ্য বহুদিন পলাতকও ছিল।

এই হলো লালন ও বাউল ফকিরদের নিয়ে সমসামিয়ক ও অব্যবহিত পরবর্তীকালের প্রতিক্রিয়া। আজ অনেকটা স্তিমিত বটে, কিন্তু এই ঘৃনা ও প্রতিরোধের ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত। এই মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর আগেও মওলানা মেছবাহুর রহমান লালনের বিরুদ্ধে একটি ছোটখাটো আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তিনি তার প্রচারপত্রে লিখেছিলেন, চারিচন্দ্রভেদ ষড়চক্র........ প্রেমভাজা প্রভৃতি কাম আরাধনার ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দ সমূহের তাৎপর্য কি তা জানলে যে কোন রুচিসম্পন্ন মানুষ লালন এবং তার অনুসারীদের নাম মুখে আনতেও ঘৃণা বোধ করবে। এই ঘৃণা এখনো অত। ম. আ. সোবহান, মুহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন প্রমুখ লেখকের সাম্প্রতিক রচনাসমূহে এই ঘৃণারই তীব্রতা লক্ষ্য করি।

অবশ্য লালনের প্রতি অনেকের মধ্যে অনেক সহানুভূতি আছে। ডঃ আবুল আহসান চৌধুরী প্রতিরোধের এই অবিরাম ধারাবাহিকতার কারণে কিঞ্চিত বেদনার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন, একতারার বিরুদ্ধে চলছে লাঠির সংগ্রাম। বাঙলার সামাজিক ও ধর্মীয় ইতিহাসের এ এক বেদনাদায়ক অধ্যায়। তিনি আরও বলেন, লালনের প্রতি আলেম সমাজের একটি বিদ্বেষপ্রসূত মনোভাবের প্রকাশ ল্য করা যায়। এগুলো নিশ্চয় সহানুভূতির কথা, কিন্তু ডঃ চৌধুরী বিদ্বেষ বলছেন কেন? তিনি ভালভাবেই জানেন, উমাইয়া ও আবাসীয় খেলাফত উভয় আমলেই এই ধরণের ধর্মভ্রষ্ট জিন্দিকী মুসলমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। কারণ এই ক্ষেত্রে নির্বিকার থাকার কোন পথ নেই; রাসূল (সাঃ) বলেন, সত্য মিথ্যার প্রশ্নে যারা নীরব ও নিরপেক্ষ তারা বোবা শয়তান। ডঃ চৌধুরী আরো বলেছেন, বারংবার তিনি(লালন) হয়েছেন লাঞ্ছিত-অপমানিত-সমালোচিত। কিন্তু লালন ধীর স্থির লক্ষ্যগামী। কোন অন্তরায়, প্রতিবন্ধকতাই তাকে নিরুৎসাহিত বা নিরুদ্ধ করতে পারে নি।

আসলে পারার কথাও না; কারণ মিথ্যা, অন্ধকার ও অশ্লীলতাকে আঁকড়ে থাকাও একটি অতিক্রমণ্য প্রচন্ড নেশা। অতএব লালন বা লালন শিষ্য প্রশিষ্যেরা যদি প্রচন্ড ঘৃণার মুখেও নিজেদের নোংরা মত ও ততোধিক নোংরা পথকে আঁকড়ে ধরে থাকেন, সেটাই স্বাভাবিক।

প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পঞ্চম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সকাল ১১:৩১
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×