somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

নতুন নকিব
আলহামদুলিল্লাহ। যা চাইনি তার চেয়ে বেশি দিয়েছেন প্রিয়তম রব। যা পাইনি তার জন্য আফসোস নেই। সিজদাবনত শুকরিয়া। প্রত্যাশার একটি ঘর এখনও ফাঁকা কি না জানা নেই, তাঁর কাছে নি:শর্ত ক্ষমা আশা করেছিলাম। তিনি দয়া করে যদি দিতেন, শুন্য সেই ঘরটিও পূর্নতা পেত!

বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৯)

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
প্রত্যাশারা ডানা মেলে



অসম্ভব এবং অবর্ননীয় সুন্দর আঁকাবাকা পাহাড়ি পথ উপড়ে উঠে গেছে তায়িফের দিকে। রোমাঞ্চকর যাত্রায় পাহাড়ি এ বন্ধুর পথ অতিক্রম করেই আমরা প্রবেশ করেছি প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য স্মৃতি বিজড়িত শহর তায়িফে।

মন ছুটে যায়। আগে থেকেই কল্পনা করে রেখেছিলাম, মহিমান্বিত হজ্বের মহান সফরে আসার তাওফিক দয়া করে মহামহিয়ান মালিক যেহেতু দিয়েছেন তাই একটিবারের জন্য হলেও প্রিয় নবীজীর অনেক স্মৃতির ধারক-বাহক তায়িফ ঘুরে আসব। মনের আঁকুতি মনেই লুকিয়ে রেখেছি। কাউকে বলিনি। একজনকে বলেছি। তিনি জানেন। তিনি সবকিছু জানেন। তিনি ভিতরের খবর জানেন। বাইরের খবরও। তিনি গোপন জানেন। প্রকাশ্যও। তিনি আদি জানেন। অন্তও। তিনি অন্তর্যামী। তিনি মালিক মহিয়ান। তাঁর কাছে কোন কিছুই অজানা নেই। অজ্ঞাত নেই। অনুদ্ঘাটিত-অশ্রুত নেই। অদৃশ্য-আড়াল নেই। আবডাল নেই। লুকোচুরি নেই। ‘ইয়া‘লামু খায়িনাতাল আ‘ইউনি অমা তুখফিচ্ছুদূর’ - ‘তিনি চোখের চাতুরি বোঝেন এবং তোমরা যা গোপন করে রাখ মনের গহীনে।’

তাঁর নিকট কোন কিছু অদেখা নেই। কোন কিছু গোপন নেই। কোন কিছু তার দৃষ্টি থেকে কোন কিছুকে আড়াল করতে পারে না। অদৃশ্য করতে সক্ষম নয়। তাঁর কুদরত সর্বোতভাবে সদা বিরাজমান। তাঁর করুনাধারা সর্বব্যপী সমভাবে প্রযোজ্য। তিনি নিত্য সত্য। তিনি অজড়। অমর। অক্ষয়। অব্যয়। চির জাগ্রত। চির সত্য। তিনিই সত্য। বাকি সব মিথ্যে। তিনিই সমস্ত ক্ষমতার আধার। তাঁর উপরে কারও ক্ষমতা কার্যকর নয়। তিনি যা ইচ্ছে করতে সক্ষম। তাঁর দয়া সকলের জন্য অবারিত। অবধারিত। অপরিহার্য্য। তামাম মাখলূকাত তাঁর দয়ার ভিখারী। তিনি স্বয়ং দয়া করে খুশি হন। আনন্দিত হন। উতফুল্ল হন। দয়া করাই তাঁর অভ্যাস। ক্ষমা করাই তাঁর আদত। মার্জনা করাই তাঁর পছন্দের। মাখলূকের ক্ষুদ্রতা, অসহায়ত্ব অবলোকনে তাঁর দয়ার সাগরে জোশ আসে। ফেনায়িত তরঙ্গের মত তাঁর সীমাহীন রহমতের অথৈ পাথারে প্লাবন নামে। তিনি দয়া করেন। মুঠি মুঠি দয়া ছড়িয়ে দেন বিশ্বময়। প্রতিনিয়ত প্রতি দিন চলে তাঁর এ অপরিসীম দয়ার বর্ষন। তিনি দয়া করেন বলেই প্রভাতে সূর্য্য জেগে ওঠে প্রতি দিন। তিনি দয়া করেন বলেই গোঁধুলি বেলা নেমে আসে পৃথিবীর কোলজুড়ে। চাঁদ জোসনা ঢালে। তিনি দয়া করেন বলে ঝর্নারা ছুটে চলে। তিনি দয়া করেন বলে পাখিরা ডানা মেলে দেয় অসীম শুন্যতায়।



রাতের আঁধারে অন্যরকম তায়িফের পাহাড়ি পথ।

আকাশে বাতাসে তাঁর দয়ার বিচ্ছুরন। মাটিতে-পাহাড়ে-ঝর্না-গিরিতে তার রহমতের ফল্গুধারা বহমান। পাখির কুজনে সাগরের গর্জনে তাঁর কৃপা আশীষের সদা প্রকাশ। মাখলূকের আবেদন নিবেদন শ্রবনে তাঁর পরিতৃপ্তি। তিনি আহকামুল হাকিমীন। কুল কায়িনাতের সমস্ত বাদশাহদের বাদশাহ। রাজাধিরাজ। স¤্রাটগনের স¤্রাট। তাঁর সকাশে হৃদয়ের গোপন কোটরে জমিয়ে রাখা প্রত্যয়গুলো সবিনয়ে পেশ করেছি। যেভাবেই হোক তায়িফ যাব। তায়িফের পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্নের সেই মধুর প্রতীক্ষার ক্ষনগুলো কাছে আসতে থাকে। দূরে সরে যেতে থাকে। প্রতীক্ষার প্রহর সহজে কাটে না। কখনও কখনও সময়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরো যেন বিশালাকার পাষানের আয়তনে রূপ নিতে থাকে। অপেক্ষার প্রহর বুঝি এমনই হয়ে থাকে। আরবি ভাষার একটি প্রবাদ রয়েছে- ‘আল ইনতিজারু আশাদ্দু মিনাল মাউত’ - ‘অপেক্ষা মৃত্যুর চেয়ে কঠিন।’

এরমধ্যেই এক দিন শুনতে পাই- আমাদের এজেন্সির পক্ষ থেকে জানানো হয়- তায়েফে তারা আমাদের নিয়ে যাবেন না। আসলে মক্কা থেকে প্রায় ১০৬ কিলোমিটার দূরের পথ তায়িফে হাজ্বী সাহেবানদের নিয়ে যাওয়া এজেন্সির পক্ষে সহজ সমাধানযোগ্য কোন বিষয়ও নয়। বিষয়টি জেনে মন কিছুটা বিষন্ন হলেও আল্লাহ পাকের ফায়সালার প্রতি রাজী থাকার প্রতি মনযোগী হই এবং তাঁর সাহায্যের প্রত্যাশায় উম্মুখ হয়ে রই। তাওফিক তো তিনিই দিয়ে থাকেন।

দিন যায়। ক্রমে তায়িফের পথে হেটে আসার উদগ্র আগ্রহরা ডানা মেলে দেয়। প্রিয় মক্কাহর চিরচেনা আলোকিত মায়াময় পথে পথে ঘুরে ক্রমে ছোট হয়ে আসতে থাকে সময়ের ছোট্ট পরিধি। প্রিয়তম হাবিব শাফিউল মুজনাবিন সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্মৃতিধন্য তায়িফের ধুলো শরীরে মেখে নেয়ার অব্যক্ত বাসনারা মনকাননে আরও বেশি করে উঁকি ঝুকি দিতে থাকে।

মালিকের খোশখবরী



যুগপথ ভয় আর আনন্দের সংমিশ্রন ঘটায় তায়িফের যে পথ!

আলহামদুলিল্লাহ, এরইমধ্যে একদিন মহান প্রভূ পালয়িতা মালিক মহিয়ানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য খোশখবরী নসীব হয়। মক্কাতে অবস্থানরত নরসিংদী নিবাসী আলামীন এসে জানালেন, তিনি তার ট্যাক্সিতে করে আমাদের তায়িফ ঘুরিয়ে নিয়ে আসবেন। বন্ধু, আপনাকে হয়তো বোঝাতে পারব না! হয়তো আপনি বুঝে নিতে পারবেন! হয়তো পারবেন না! এরকম একটি সুসংবাদের অপেক্ষায় কতটা তীব্রভাবে অপেক্ষমান ছিলাম। খুশিতে বুকটা ভরে উঠল। আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করলাম! সিজদাবনত হয়ে! আহ! মুখ ফুটে না চাইতেই তিনি সবকিছু দিয়ে দেন! তাঁর দয়ার কি কোন শেষ আছে? তিনি তাঁর এক বান্দাকে দিয়ে আরেক অসহায় বান্দার মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা গোপন বাসনার বীজে জলসিঞ্চন করেন! তাতে অঙ্কুরোদগম করেন! সুবহানাল্লাহ! কতই না মহান আমার মালিক! তাঁর কুদরত, তাঁর শান, তাঁর হিকমত, তাঁর কৌশল, তাঁর প্রজ্ঞা, তাঁর সৌন্দর্য্য, তাঁর জামাল, তাঁর কামাল, তাঁর মহত্ত্ব, তাঁর মর্যাদা, তাঁর প্রেম, তাঁর পূর্নতা, তাঁর ক্ষমা, তাঁর বিশালতা, তাঁর অসাধারনত্ব চিন্তা করার কোন যোগ্যতা কি আমাদের আছে? মানবের আছে? থাকে? থাকতে পারে? থাকা সম্ভব? আদৌ সম্ভব?

নাহ! বন্ধু না! আদৌ সম্ভব নয়! আমাদের পক্ষে! মানবের পক্ষে সম্ভব নয় যে, তাঁর সৌন্দর্য্যের সরোবরের অতলস্পর্শী বারিধারায় আপাদমস্তক সিক্ত করে! মানুষ তো শুধু পারে, তাঁর সৃষ্টি সুষমা দর্শনে, সৃষ্টির ভেতরে ¯্রষ্টাকে খুঁজে নিতে! তাঁর সন্ধান করে নিতে! মানুষের, মানবের এছাড়া আর করার কিইবা সাধ্য আছে! আমরা যে কেবল তাঁর অন্তহীন দানের ভিখারী! দয়ার ভিখারী!

দুঃখ প্রকাশ করছি, প্রসঙ্গ ছেড়ে কিছুটা দূরে সরে যাওয়ার জন্যে! আসলে মহান মালিক রাজাধিরাজ আল্লাহ জাল্লা শানুহুর কুদরতের কারিশমা নিয়ে ভাবলে কি আর প্রসঙ্গে আটকে থাকা যায়! নিজেকে আটকে রাখা যায়! তিনি যে সীমাহীন! তাঁর আলোচনাও যে সীমাহীন! তিনি যেমন ধারনাতীত! ধারনার উর্দ্ধে যেমন তাঁর উচ্চকীয় অবস্থান তেমনি তাঁর আলোচনাও যে সকল স্বাভাবিকতাকে ছাড়িয়ে ভিন্নতর উচ্চতায় আকীর্ন! অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, উদ্যমী বাংলাদেশী যুবক ভাই মোঃ আল আমীনের প্রতি। আমাদের প্রতি তার ইহসান দেখে আপ্লুত হয়েছি। কর্মজীবনে তার শত ব্যস্ততার ভেতরেও পুরো একটি দিন তিনি আমাদের তায়িফ সফরের জন্য বরাদ্দ রেখেছেন।

মক্কাহ থেকে পার্বত্যাঞ্চল দিয়ে পাহাড়ের গা কেটে তৈরি করা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ঘোরানো পথে তায়িফ গমন। রোমাঞ্চকর সে পথের সৌন্দর্য্যের কি বর্ননা দেব! এটা হচ্ছে মক্কা থেকে তায়িফ গমনের পাহাড়ি আধুনিক রাস্তা। পাহাড়ের গা কেটে অত্যন্ত মনোরমভাবে তৈরি করা হয়েছে এই রাস্তা। সমতল ভূমি থেকে প্যাচানো লতার মত পাহাড়ের গা বেয়ে ক্রমে উপরে উঠে গেছে সড়ক। আশ্চর্য্য অনুভূতি! মনে হয় স্বপ্নের ভেতরে ছিলাম! ঘোরের মত লাগছিল! সা সা করে উপরে উঠে যাচ্ছিল আমাদের প্রাইভেট ট্যাক্সি! আর ক্রমেই মুগ্ধতায় ডুবে যাচ্ছিলাম! অজান্তেই মুখ ফুটে বেরিয়ে আসছিল- সুবহানাল্লাহ! হে আল্লাহ! আপনি কতই না মহান! আপনার সৃজিত পাহাড় যদি হয় এত সুন্দর! আপনি কত সুন্দর! আপনি কত সুন্দর! সারাটি দিন তায়িফের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরিয়ে ভিন্ন পথে সমতল রাস্তায় তায়িফ থেকে মক্কাহ পৌঁছে দেন ভাই আল আমীন। হোটেলে এসে পৌঁছে দেখি রাত প্রায় বারোটা। তার প্রতি অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে কল্যানের দুআ। আল্লাহ পাক তার দুনিয়া আখিরাত উজ্জল করুন। বিদেশ বিভূইয়ে তাকে নিরাপত্তার চাদরে আচ্ছাদিত করে রাখুন। এই সফরে হাফেজ মুখলেস ভাই, খাজা ভাই এবং আমিসহ আমরা ছিলাম তিনজন। আমাদের সাথে ছিলেন আরেক মহত প্রান বাংলাদেশী মোঃ সবুজ ভাই। পবিত্র মক্কায় পৌঁছার পর থেকে প্রিয় এই মানুষটি আমাদের ছায়ার মত সঙ্গ দিয়েছেন। হরেক রকমের ফল ফ্রুট থেকে শুরু করে প্রায়শই ‘লাবান’ (দুধের তৈরি বোতলজাত সুস্বাদু পানীয়। গরুর দুধের পাশাপাশি উটের দুধের ‘লাবান’ এখানে অহরহ পাওয়া যায়। তবে উটের দুধের ‘লাবান’ এর দাম অপেক্ষাকৃত বেশি।) ইত্যাদি কিনে ব্যাগ ভর্তি করে হোটেলে এসে আমাদের দিয়ে যেতেন। এই কেনাকাটার কাজটি ভাই মো: আল আমীন এবং আরেক ভাই মোঃ বকুল সাহেবও যথারীতি করে এসেছেন। আমাদের প্রতি এই থ্রি স্টারের ইহসান ভুলে যাওয়ার নয়। আল্লাহ পাক এদের সকলকে উপযুক্ত জাজা দান করুন।

মক্কা থেকে তায়িফের পথে

মক্কার সমতল ভূমি পেরিয়ে দুই পাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়! যেন দুই পাহাড়ের ভেতর দিয়ে নদীর মত বয়ে চলে গেছে সউদি সরকার নির্মিত আধুনিক এই রাস্তা! রাস্তা তো নয়! বিশাল হাইওয়ে! সউদি আরবে যত দিন ছিলাম, যত স্থানে গিয়েছি, কোথাও কোন একটি রাস্তার সামান্য স্থানের পিচ খসে গেছে অথবা রাস্তা ভাঙ্গা - এমনটা চোখে পড়েনি! আপনি এটাকে পেট্রো ডলারের কেরামতি বলুন আর অন্য যে কারিশমা হিসেবেই আখ্যায়িত করুন না কেন, আমার তো মনে হয়, আপনার অনুমান একেবারে খারাপ নয়। তবে আমাদের দেশের মত প্রচন্ড লোভী আর অসত ব্যক্তিদের হাতে যদি গোটা সউদি আরবের তেল আর স্বর্ন তুলে দেয়া হয়, কিছু দিনের ভেতরে আমরা আটলান্টিকের ওপাড়ে, কানাডা, সুইডেনে অট্টালিকা নির্মানে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ব যে, রাস্তা-ঘাটের কথা বেমালূম ভুলে যাব! সউদি আরবের রাস্তাগুলো দেখে আমার দেশের রাসÍা-ঘাটের চেহারা মনের পর্দায় ভেসে উঠতো। দুই দেশের রাস্তার তুলনা না দিলেও কাছাকাছি ধরনের কোন সমতাও যখন পেতাম না তখন নিজেকে নিজের ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হত! নিজের ভেতরে নিজে গুমরে কাঁদতে ইচ্ছে হত! হায়, আমার দেশের সাধারন মানুষের জীবন মান কত নিচুতে! হায়, আমার দেশের রাস্তা-ঘাটের কি শ্রী! শুধুমাত্র গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি আর বারিধারার উন্নয়ন মানে বাংলাদেশের উন্নয়ন নয়। গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া কৃষক মজুর কুলি মুটেরা চলাচল করেন যে রাস্তা দিয়ে ৬৮ হাজার গ্রাম-গঞ্জের কোন একটি গ্রামও কি এমন পাওয়া যাবে, যে গ্রামে যাতায়াতের সেই পথটি নির্বিঘœ-নিরাপদ-ঝুঁকি এবং ঝাকুনিমুক্ত! সম¥ানিত পাঠক, প্রিয় বন্ধু, এই প্রশ্নটি আপনার কাছে রেখে গেলাম। আপনার বিবেকের কাছে রেখে দিলাম। হায় আল্লাহ! আপনি ক্ষমা করুন! ভাঙ্গা রাস্তায় চলতে গিয়ে ঝাকুনি খেয়ে কোমর ভাঙ্গা এই জাতির সাধারন জনগনের অভিশাপ থেকে আমাদের দেশের অসাধারন নেতাদের রক্ষা করুন! আমাদের ক্ষমা করুন!

যত দূর চোখ যায়, উঁচু নিচু ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি! একটির চেয়ে যেন অন্যটি বড়! কাছেরটির চেয়ে যেন দূরেরটি আরও বড়! লাল কালো নানান রঙের পাহাড়ের গা! পাহাড়ের পাদদেশে কোথাও কোথাও উটের দলের কদাচিত সাক্ষাত! দুম্বাদের উপস্থিতি অনেক! অসম্ভব সৌন্দর্য্যের অন্যরকম অনুভূতি! বর্ননা করে হয়তো বুঝানো যাবে না! বন্ধু, বুঝে নিতে হবে আপনাকে হয়তো! পাহাড়ের বাঁক পেরিয়ে গাড়ি উপরে উঠতে উঠতে এক জায়গায় এসে ব্রেক কষলো। ভাই আল আমীন আমাদের গাড়ি থেকে নামতে ইশারা করলেন। আমরা দরজা খোলার পূর্বেই লক্ষ্য করলাম অসংখ্য বানর আমাদের গাড়ির দিকে ছুটে আসছে। ছোট বড়, বাচ্চা বুড়ো নানান বয়সের ঝাক ঝাক বানর। এরা এসে গাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করছে। পরে কারন অনুসন্ধান করে যখন জানতে পারলাম, সমতল ভূমি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার উঁচুতে অবস্থিত পাহাড়ের এই চূড়ায় বসবাসকারী এসব বানরদের খাবার সরবরাহ করেন সাধারনত: এই পথে ভ্রমনকারীগন, তখন আমাদের সাথে কোনও খাবার না থাকায় এবং বানরদের কিছু দিতে না পারায়, আমাদের গাড়ির কাছে ভিড় জমানো বানরদের কাছে লজ্জিত হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। বানরদের ক্ষুধা তৃষ্ণার কষ্টের কথা ভেবে, তাদের কষ্টকর পাহাড়ি জীবনের কথা চিন্তা করে মনে কষ্টও পেয়েছিলাম অনেক। সাথে খাবার না আনার কারনে নিজেকে তিরষ্কার করছিলাম আর প্রতিজ্ঞা করছিলাম, আগে যেহেতু বুঝিনি তাই না এনে বানরের সামনে লজ্জায় পড়েছি, ফেরার পথে এই ভুলের মাশুল আদায় করতে হবে। রুটি কলা ইত্যাদি নিয়ে আসব এদের জন্য। কিন্তু, সব আশা হয়তো পূরন হবার নয়। আসরের পর থেকেই দেখি, তায়িফে ঝড়ো বাতাস। মাগরিবের পরপরই বৃষ্টি। আমরা তখন তায়িফ থেকে মক্কাহর পথে রওনা হচ্ছি। অভিজ্ঞ ট্যাক্সি ড্রাইভার ভাই মো: আল আমীন জানালেন, বৃষ্টি হলে পাহাড়ী রাস্তা সরকার বন্ধ করে দেয়। বৃষ্টি হলে পাহাড়ের উপর থেকে পাথর গড়িয়ে রাস্তায় চলে আসে। ফলে তখন এ রাস্তায় চলাচল বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। তাই সমতল ভূমি দিয়ে ভিন্ন পথে মক্কা গমন করতে হবে। যে কারনে আর দ্বিতীয়বার তায়িফের পাহাড় চূড়ার বাসিন্দা বানরদের সাথে দেখা করা হয়ে ওঠেনি। বানরদের প্রতি আমাদের শুভকামনা। তারা যেন সুখে থাকে। খাদ্য পানীয় পেয়ে। ও পথে চলাচলরত হাজারো লাখো মানুষের মমতা পেয়ে তারা সুন্দর থাকুক।

আমরা চলছি। তায়িফের পথে। আজকের তায়িফ। আধুনিক ইমারতে অপূর্ব তায়িফ। আধুনিক রাস্তা-ঘাটে সাজানো গোছানো সুন্দর পরিপাটি শহর তায়িফ। কিন্তু আমার মন হারিয়ে যায় প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বের সেই পার্বত্য দুর্গম তায়িফের পথের পানে। দুগ্ধপোষ্য শিশু নবীর বেড়ে ওঠার পূন্য ভূমি তায়িফ। এখানের সবুজ ঘাস বিছানো মাঠে শিশু নবীজী খেলা করেছেন অন্যান্য শিশুদের সাথে।

তায়িফের পথে দাওয়াতের উদ্দেশ্যে

নবুয়তের সুমহান দায়িত্বপ্রাপ্তির পরে, নবুয়তের দশম বছরের শাওয়াল মাসে ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দের মে কিংবা জুন মাসের প্রথম দিকে যে পথে নবীজী দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে সুদূর মক্কা থেকে তায়িফ এসেছিলেন। মক্কা থেকে তায়িফ। প্রায় ১০৬ কিলোমিটার পথ। সুদীর্ঘ এই পথ প্রিয় রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতিক্রম করেছিলেন পদব্রজে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর মুক্ত করা ক্রীতদাস যায়িদ বিন হারিসাহ রাদিআল্লাহু তাআ‘লা আনহু। তায়িফ গমন করে সাক্বীফ গোত্রের আবদে ইয়ালাইল, মাসউ’দ ও হাবীব নামের তিন সহোদর নেতার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এই তিন ভাইয়ের পিতার নাম ছিল আমর বিন উমাইর সাক্বাফী। তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআ’লার অনুগত হয়ে চলার জন্য এবং ইসলামকে সাহায্য করার জন্য তাদের নিকট দাওয়াত পেশ করেন। তদুত্তরে একজন বলেন যে, ‘‘সে কা’বার পর্দা (আবরন) ফেড়ে দেখাক, যদি আল্লাহ তাকে রাসূল করে প্রেরন করে থাকেন।’’ দ্বিতীয়জন বললেন, ‘‘নবী করার জন্য আল্লাহ কি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে পাননি?” তৃতীয়জন বললেন, “তোমার সঙ্গে আমি কোনক্রমেই কথা বলব না। প্রকৃতই যদি তুমি নবী হও তবে তোমার কথা প্রত্যাখ্যান করা আমার জন্য বিপজ্জনক। আর যদি তুমি আল্লাহর নামে মিথ্যা প্রচারে লিপ্ত হও তবে তোমার সঙ্গে আমার কথা বলা সমীচীন নয়।” তাদের এহেন আচরন ও কথাবার্তায় তিনি মন:ক্ষুন্ন হলেন এবং সেখান থেকে যাওয়ার প্রাক্কালে শুধু বললেন, “তোমরা যা করলে এবং বললে তা গোপনেই রাখ।’’

আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়িফে দশ দিন অবস্থান করেন। এ সময়ের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগনের সঙ্গে সাক্ষাত করে তিনি ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। কিন্তু সকলের উত্তর একই ‘তুমি আমাদের শহর থেকে বের হয়ে যাও।’ ফলে ভগ্ন হৃদয়ে তিনি সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতি গ্রহন করলেন। প্রত্যাবর্তনের পথে যখন তিনি পা বাড়ালেন তখন তাঁকে উত্যক্ত, অপমানিত ও কষ্ট প্রদানের জন্য শিশু কিশোর ও যুবকদের তাঁর পেছনে লেলিয়ে দেয়া হল। ইত্যবসরে পথের দু’পাশে ভিড় জমে গেল। তারা হাত তালি, অশ্রাব্য অশ্লীল কথাবার্তা বলে তাঁকে গাল মন্দ দিতে ও পাথর ছুঁড়ে আঘাত করতে থাকল। আঘাতের ফলে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পায়ের গোড়ালিতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়ে পাদুকাদ্বয় রক্তাক্ত হয়ে যায়।

তায়িফের হতভাগ্য কিশোর ও যুবকেরা যখন রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর প্রস্তর নিক্ষেপ করছিল তখন যায়িদ বিন হারিসাহই তাঁকে রক্ষার জন্য ঢালের মত কাজ করছিলেন। ফলে তাঁর মাথার কয়েকটি স্থানে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হন। এভাবে অমানবিক যুলূম নির্যাতনের মধ্য দিয়ে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পথ চলতে থাকেন এবং দুরাচার তায়িফবাসীগন তাদের এ অত্যাচার অব্যাহত রাখে। আঘাতে আঘাতে জর্জ্জরিত রুধিরাক্ত কলেবরে পথ চলতে গিয়ে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুবই ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত এক আঙ্গুর উদ্যানে আশ্রয় গ্রহনে বাধ্য হন। বাগানটি ছিল রাবী’আহর পুত্র উতবাহ ও শাইবাহর। তিনি বাগানে প্রবেশ করলে দুরাচার তায়িফবাসীগন গৃহাভিমুখে ফিরে যায়।

তায়িফ থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত এ বাগানটিতে প্রবেশ করে নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আঙ্গুর গাছের ছায়ায় এক দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লেন।

তায়িফের অভিনব, অবিস্মরনীয় এবং অসাধারন সেই দু‘আটি

কিছুক্ষন বিশ্রাম করার ফলে কিছুটা সুস্থতা লাভের পর রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আল্লাহ তা’আলার দরবারে হাত তুলে দু‘আ করলেন। তাঁর এ দু’আ ‘দুর্বলদের দু’আ’ নামে সুপ্রসিদ্ধ। তাঁর দু’আর এক এককটি কথা থেকে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, তায়িফবাসীগনের দুব্যবহারে তিনি কতটা ক্ষুব্ধ এবং তারা ঈমান না আনার কারনে তিনি কতটা ব্যথিত হয়েছিলেন। পাশাপাশি তাঁর ঐতিহাসিক এ দু’আটির প্রতিটি শব্দ এবং বাক্যই ভাবের আবেগে পরিপূর্ন এবং বিপদে আপদে কেবলমাত্র আল্লাহর দিকে রুজূ’ হওয়ায়, একমাত্র তাঁরই নিকট নিজেকে অর্পন-সমর্পন-সোপর্দ করায় এবং সর্বোপরি মহান আল্লাহ তা‘আলার প্রতি নির্ভরশীলতায় পূর্নতম এবং পূন্যতম আদর্শ। দু’আটির আবেগপূর্ন ভাষা ও ভঙ্গিমায় শত্রুও বলতে বাধ্য হয়- বিশ্বের প্রতি, বিশ্ব মানবতার প্রতি মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আহবান যে ঐশ্বরিক, তিনি যে সত্যিকারের আল্লাহ প্রেরিত মহান রসূল, সেই বিশ্বাসে যোগান দেয় তাঁর এই প্রার্থনা বা দু‘আ।

নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী রচনার নামে তাঁর নামে কুৎসা রটনাকারী পাশ্চাত্যের জনৈক ম্যুর পর্যন্ত এই দু’আটির ভাবাবেগে মুগ্ধ হয়ে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন-

It sheds a strong light on the intensity of his belief in the divine origin of his calling (Life of Mohamet, By Mwir)

আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু‘আ করলেন,

‏(‏اللهم إِلَيْكَ أَشْكُوْ ضَعْفَ قُوَّتِىْ، وَقِلَّةَ حِيْلَتِىْ، وَهَوَانِيْ عَلَى النَّاسِ، يَا أَرْحَمُ الرَّاحِمِيْنَ، أَنْتَ رَبُّ الْمُسْتَضْعَفِيْنَ، وَأَنْتَ رَبِّيْ، إِلٰى مَنْ تَكِلُنِىْ‏؟‏ إِلٰى بَعِيْدٍ يَتَجَهَّمُنِى‏؟‏ أَمْ إِلٰى عَدُوٍّ مَلَّكْتَهُ أَمْرِيْ‏؟‏ إِنْ لَمْ يَكُنْ بِكَ عَلَيَّ غَضَبٌ فَلَا أُبَالِيْ، وَلٰكِنْ عَافِيْتُكَ هِيْ أَوْسَعُ لِيْ، أَعُوْذُ بِنُوْرِ وَجْهِكَ الَّذِيْ أَشْرَقْتَ لَهُ الظُّلُمَات، وَصَلُحَ عَلَيْهِ أَمْرُ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ مِنْ أَنْ تُنَزِّلَ بِيْ غَضَبُكَ، أَوْ يَحِلُّ عَلَيَّ سَخَطُكَ، لَكَ الْعُتْبٰى حَتّٰى تَرْضٰى، وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِكَ‏)‏‏.‏

যারা আরবি পড়তে পারেন না তাদের সুবিধা চিন্তা করে কিছুটা কষ্টকর হলেও বাংলায় টাইপ করে দেয়া হল প্রিয় এই দুআ'টি:

'আল্লাহুম্মা ইলাইকা আশকূ দু'ফা ক্কুয়্যাতী- ওয়া ক্কিল্লাতা হী-লাতী- ওয়া হাওয়ানী- আলান্নাসি ইয়া আরহামার র-হিমী-ন। আনতা রব্বুল মুসতাদআফী-না ওয়া আনতা রব্বী-। ইলা- মান তাকিলনী- ইলা- বায়ী-দিন ইয়াতাজাহহামুনী- আম ইলা- আদুয়্যিন মাল্লাকতাহূ- আমরী-। ইল্লাম ইয়াকুমবিকা আলাইয়্যা গদাবুন ফালা উবা-লী ওয়ালা-কিন আ-'ফিয়াতুকা হিয়া আউছাউ' লী-। আউ'-যুবিনূ-রি অযহিকাল্লাজী- আশরাক্কাত লাহুজ্জুলুমা-তু ওয়া ছলাহা আলাইহি আমরুদ্দুনইয়া- ওয়াল আ-খিরাতি মিন আন তুনাজ্জিলা বী- গদাবাকা আও ইয়াহিল্লা আলাইয়্যা ছাখাতুকা লাকাল আতবী- হাত্তা- তারদ্বা- ওয়ালা- হাওলা ওয়ালা- ক্কুওয়্যাতা ইল্লা- বিক।'

‘হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট আমার শক্তির দুর্বলতা, অসহায়ত্ব আর মানুষের নিকট স্বীয় মূল্যহীনতার অভিযোগ প্রকাশ করছি। ওহে দয়াময় দয়ালু! আপনি দুর্বলদের প্রতিপালক, আপনি আমারও প্রতিপালক, আপনি আমাকে কার নিকট অর্পন করছেন যে আমার সঙ্গে রূঢ় আচরন করবে, না কি আপনি আমাকে এমন শত্রুর নিকট ন্যস্ত করছেন যাকে আপনি আমার যাবতীয় বিষয়ের মালিক করেছেন। যদি আপনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট না হন তবে আমার কোন আফসোস নেই, তবে আপনার ক্ষমা আমার জন্য সম্প্রসারিত করুন। আমি আপনার সেই নূরের আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যদ্বারা অন্ধকার দূরীভূত হয়ে চতুর্দিক আলোয় উদ্ভাসিত হয়। দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় বিষয়াদি আপনার উপর ন্যস্ত। আপনি আমাকে অভিসম্পাত করবেন কিংবা ধমক দিবেন, তার থেকে আপনার সন্তুষ্টি আমার কাম্য। আপনার শক্তি ব্যতিরেকে অন্য কোন শক্তি নেই।’



রাস্তা তো নয়, যেন অনবদ্য সুন্দরের হাতছানি!

ফেরেশতাদের নিয়ে জিবরাইল আলাইহিস সালামের আগমন

তায়িফবাসী কর্তৃক নির্মম নির্যাতনে রক্তাক্ত জখম আহত বিশ্বনবী! আল্লাহ পাকের রহমতের দরিয়ায় জোশ এসে যায়! তিনি ফেরেশতা পাঠালেন প্রিয় হাবিবের নিকট! পাহাড় রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতামন্ডলীকে সাথে নিয়ে হযরত জিবরাইল আলাইহিসসালাম এসে নিবেদন করলেন, ‘ আপনার প্রতি লোকদরে প্রতক্রিয়িা আপনার প্রতপিালক দখেছেনে, তারা আপনাকে যা বলছেে তাও তনিি সম্যক অবগত, সুতরাং তনিি আমাকে পাহাড় রক্ষাকারী ফরেশেতাদরে নয়িে পাঠয়িছেনে আপনার মতামত জানার জন্য। আপনি যদি চান, আমাকে আদশে করুন, আমি তায়ফেরে দুই পাহাড়কে একত্রতি করে তাদরে ধ্বংস করে দবে।’

তবুও তিনি বলতে থাকলেন- ‘হে আল্লাহ, আমার জাতকিে ক্ষমা করে দনি, কারণ তারা জানে না।’

দয়ার আধার আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! রহমাতুল্লিল আলামীন তিনি! সমগ্র জগত ও জাতির জন্য রহমতের অনি:শেষ বারিধারা বইয়ে দিতে ধুলোর ধরায় যার শুভাগমন তিনি কিভাবে এই প্রস্তাবে সম্মত হবেন? সম্মতি তিনি দিলেন না! রক্তাক্ত অবয়বে জখম শরীর তাঁর! ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর জগতের শ্রেষ্ঠতম মহামানব! প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষতস্থান থেকে তখনও রক্ত ঝড়ছে এবং তখনও তাঁর জুতা মোবারক রক্তে রঞ্জিত! এমতাব্স্থায়ও তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, ‘না! বরং, আমি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি, তিনি হয়তো তাদের সন্তান-সন্তুতিদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে তাদের মুসলিম হওয়ার তাওফিক দিবেন এবং একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করার সুযোগ দিবেন। এমনকি তারা যদি ইসলাম প্রত্যাখ্যান করে, তবু আমি আল্লাহর নিকট তাদের বংশধরদের মুসলিম হওয়ার জন্য প্রার্থনা করছি।

তিনি দুআ করতে থাকলেন-

, اللهم اغفر لقومي فإنهم لا يعلمون

র্অথ- ‘হে আল্লাহ, আমার জাতিকে ক্ষমা করে দিন, কারণ তারা জানে না।’

ঠিকই। অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিনত হয়েছিল প্রিয় নবীজীর অশ্রুসিক্ত নয়নে, রক্তাক্ত কলেবরে ব্যথিত হৃদয়ে ফরিয়াদের সেই বানীগুলো! তায়িফের লোকেরা তখন বুঝেননি! পরে বুঝেছিলেন! ঠিক বুঝেছিলেন! সঠিক বুঝেছিলেন! মক্কা বিজয়ের পরে এই তায়িফবাসীরাই তাঁর পবিত্র হাতে হাত রেখে ইসলামের সুমহান আদর্শের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিলেন!

কত ঘটনাবহুল তায়িফ! কত স্মৃতির ধারক বাহক তায়িফ!

মসজিদে ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু পরিদর্শন



তায়িফের অন্যতম দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থান হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু মসজিদ।

তায়িফ শহরে ঢুকে ভাই মোঃ আল আমিন প্রথমেই আমাদের নিয়ে যান মসজিদে ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু প্রাঙ্গনে। তায়িফের সর্ববৃহত মসজিদ এটি। প্রখ্যাত সাহাবি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহুর স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র এই মসজিদ। আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাচাত ভাই, রয়ীসুল মুফাসসিরীন খ্যাত হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহুর মাকবারাহ (কবর) সংলগ্ন বিশাল এই মসজিদ তায়িফ শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহুর পিতা ছিলেন রাসূলে পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতৃব্য হযরত আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু। মাতা উম্মুল ফজল, যিনি ছিলেন উম্মুল মু‘মিনীন হযরত মাইমূনাহ রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহার বোন। প্রিয় নবীজীর হিজরতের তিন বছর পূর্বে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু জন্মগ্রহন করেন। তিনি জন্মের পরপরই স্তন্যপানের পূর্বে তাঁর মাতা তাকে নবীজীর নিকট নিয়ে আসেন। আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ মুখের পবিত্র লালা নবজাতক এই শিশুর জিহবায় লাগিয়ে দেন। এটা ছিল আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে তাঁর বিশেষ ঘনিষ্টতার সূচনা। পরবর্তীতে তিনি যখন বেড়ে ওঠেন, তিনি নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গভীর সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ পান। নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পাশে থেকে তাঁর উযুর পানি এগিয়ে দেয়া কিংবা এ জাতীয় ছোটখাট কাজ অত্যন্ত আগ্রহ ভরে তিনি করে দিতেন। নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে তিনি প্রার্থনায় অংশ নিতেন। প্রায়শ তাঁর সাথে ভ্রমনে বের হতেন। পরামর্শে উপস্থিত থেকে নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয়ভাজনে পরিগনিত হন। নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জন্য দু’আ করতেন- ‘হে আল্লাহ, তাকে ইসলামের গুঢ় তত্ত্ব আত্মস্থ করার তাওফিক দিন। এবং তাকে (কুরআনের) মর্ম ও ব্যাখ্যা করার যোগ্যতা দান করুন।’

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, ‘নবী কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার চিবুক ধরলেন এবং বললেন, হে আল্লাহ, তাকে জ্ঞান দান করুন।’



হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু মসজিদের ভেতরের দৃশ্য।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু স্বয়ং নবী কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহান শিক্ষা এবং অনুপম আদর্শ বাস্তবে রূপায়নের মাধ্যমে তাঁর সমগ্র জীবন জ্ঞানের সাধনায় অতিবাহিত করেন। যার ফলে তিনি ভূষিত হন, ‘রয়ীসুল মুফাসসিরীন’, ‘মুফাসসিরকূল শিরোমনি’, ‘হিবরুল উম্মাহ’, ‘জাতির জ্ঞানের আকর’, ইত্যাদি উপাধিতে।

ঐতিহাসিক এই মসজিদটি পরিদর্শনের মাধ্যমে আমাদের তায়িফ পরিদর্শনের শুভ সূচনা। মসজিদ লাগোয়া বিশাল সড়কের অপর পাশে পার্কিংয়ের স্থানে গাড়ি রেখে আমরা ছুটে যাই মসজিদ পানে। মসজিদের ভেতরের সৌন্দর্য্য অনবদ্য, নয়নজুড়ানো। মসজিদের সামনের জায়গাটিতে স্থানীয় কৃষকরা আঙুর, বেদানা ইত্যাদি বিক্রির জন্য পসরা সাজিয়ে বসেন। আজও বসেছেন। সফরকারী হাজী সাহেবানদের কাছে বিক্রির আশায় এরা আসেন। মক্কা কিংবা মদিনার তুলনায় এখানে ফল মূলের দাম কিছুটা কম দেখেছি। প্রায় তিন কেজির মত ওজনের আঙুরের ঝাকা আমরা কিনেছি মাত্র পাঁচ রিয়ালে। ২২ টাকা করে প্রতি রিয়াল হলে টাকার অংকে যার দাম হয় মাত্র ১১০ টাকা। দীর্ঘ পথ গাড়িতে সে আঙুর পাঁচ জন মিলে বেশ পরিতৃপ্তির সাথে খেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ! বেশ সুস্বাদু। টসটসে রসে ভরা। এতটা সস্তায় আঙুর পাওয়া যেতে পারে, ভেবে অবাক হয়েছি। আল্লাহ পাক যাদের দেন, এমন করেই বুঝি দেন। উপর করে ঢেলে দিয়ে দেন। মরুভূমির মরা মাটিতে রসে ভরা আঙুরের বাগান। বাহারি স¦াদ আর আস্বাদের নানান জাতের খেজুরের ফলন। টসটসে রসে ভরপুর সুস্বাদু আঙুর, আনার আর পিসসহ নানান রকমের ফল। অথচ, আমাদের দেশের মত সবুজ শ্যামল উর্বর আর সুফলা সুজলা মাটিতে আঙুরের গাছ লাগালে তাতে টক বড়ই টাইপের কিছু ধরতেও দেখা যায় না।

আল্লাহর কুদরত বুঝা মানবের
সাধ্যের অতীত, তাঁর দয়া অবিরাম
ঝরে পড়ে জলস্থলে অন্তরীক্ষে ঢের
তাঁর দয়াগুনে ধরা নয়নাভিরাম!

মুগ্ধতায় রুদ্ধবাক, হায় কি দারুন!
সৃজন সুসমা দেখে জুড়াই পরান
সিজদায় বলি, প্রভূ! বাঁচান-মারুন
আপনার প্রেম প্রভা হৃদয়ে ভরান!
আপনার পরিচয় আমাকে জানান
করুনার বারিধারা দিয়ে আপনার
ক্ষুদ্রতা ধুয়ে প্রিয় আপনার বানান।
তাওফিক দিন প্রভূ-নবীকে মানার

আর কোন আশা নেই আর কোন কিছু
আপনার প্রেম চাই, ছুটি তার পিছু।

দেখা যাবে কিভাবে? আমাদের আমল যে ভাল না! আমরা যে আল্লাহর নেআমত গ্রহন করে তাঁর অকৃতজ্ঞতায় মেতে থাকি! আমাদের যে ন্যূনতম কৃতজ্ঞতাবোধটুকু পর্যন্ত নেই! আল্লাহ পাকের হাজারও নাজ নেআমত পেয়েও তাঁর সামান্য শোকরিয়াটুকু আদায় করতেও রাজি নই! অথচ, তিনি খুশি হন শোকরগোজারীদের প্রতি! বৃদ্ধি করে দেন তাদের নেআমতের পরিমান! আহ, আমরা যদি স্মরন রাখতে পারতাম তাঁর মহিমান্বিত এই ঘোষনা! কতই না সুন্দর বলেছেন মহান মনিব!

وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِن شَكَرْتُمْ لأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ

যখন তােমাদের পালনর্কতা ঘােষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তবে তােমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠাের।

তায়িফের বেশির ভাগ জমি উর্বর। প্রকৃতিও সুন্দর! অপূর্ব! হঠাৎ দর্শনে চমকে উঠতে হয়! কেন যেন মনে হয়ে ওঠে, আমার প্রিয় বাংলাদেশের কোন উপশহরে এসে পড়লাম নাতো!

গ্রামগুলো শস্য শ্যামল। বাগ-বাগিচায়ও ভরা তায়িফের বিস্তির্ন এলাকা। মক্কার তুলনায় তায়িফের তাপমাত্রায়ও বিস্তর ব্যবধান। সকাল বেলা যেখানে মক্কার তাপমাত্রা যেখানে চল্লিশ ডিগ্রির উপরে দেখে এসেছি, তায়িফে তা দুপুরবেলাও ৩০/ ৩২ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়নি। স্বাস্থ্যকর বৈচিত্রপূর্ন দারুন আবহাওয়ার কারনে হাজার বছর ধরে তায়িফ আরবদের নিকট উৎকৃষ্ট আবাস্থল হিসেবে বিবেচিত।



হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু মসজিদের পার্শ্বস্থ তাঁর কবরগাহ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সকাল ১১:১৭
২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কিছু হিন্দু অখন্ড ভারত চায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৩ রা অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৮




মুসলিম অখন্ড ভারত শাসন করেছে তখন তারা ছিলো সংখ্যা লঘু। খ্রিস্টান অখন্ড ভারত শাসন করেছে, তারা তখন সংখ্যা লঘু মুসলিম থেকেও সংখ্যা লঘু ছিলো। তারপর মুসলিমদেরকে সাথে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ্‌ সাহেবের ডায়রি ।। টাইম ম্যাগাজিনের আগামীর ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় বাংলাদেশের নাহিদ ইসলাম

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৩ রা অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৮:১২




নাহিদের ভাষ্য, ‘আমাদের নতুন প্রজন্মের পালস বুঝতে হবে। বাংলাদশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহিংসতার যে পালাক্রম– অবশ্যই তার অবসান হতে হবে। আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’ ... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে গল্প প্রকাশিত হবার পর নিষিদ্ধ হয়

লিখেছেন জাহিদ শাওন, ০৩ রা অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:৫০


এক কাপ চা, শীতের সন্ধ্যায় বেশি ঝালের ভর্তায় মাখানো চিতই পিঠার অজুহাতে বুকপকেটে কতবার প্রেম নিয়ে তোমার কাছে গিয়েছিলাম সে গল্প কেউ জানে না।
আজকাল অবশ্য আক্ষেপ নেই।
যে গল্প... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধী চেষ্টা করেছিলেন বাংলাদেশের মিলিটারীকে ক্ষমতা থেকে দুরে রাখতে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৩:২৪



১৯৭১ সালের জেনারেশন'এর কাছে ইন্দিরা (১৯১৭ - ১৯৮৪ ) ছিলেন ১ জন বিশাল ব্যক্তিত্ব; যু্দ্ধ লেগে যাওয়ার পর, উনি বলেছিলেন যে, বাংগালীরা ভালো ও নীরিহ জাতি, তিনি এই জাতিকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন - পর্ব ৩

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ৮:২৩

জুলাই ১৮: ছাত্রলীগের হামলা, সাধারণ শিক্ষার্থীদের হত্যা এবং ঢাবি প্রশাসনের নির্দেশে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের নির্বিচার হামলার প্রতিবাদে ১৭ই জুলাই কমপ্লিট শাট ডাউন কর্সুচী ঘোষনা করে বৈষম্যিরোধী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×