অভাবের সংসার আমাদের। শুধু অভাবের বললে বোধ হয় কম বলা হবে কিছুটা। কোনো কোনো দিন খাবার জুটতো। কোনো দিন উপোস করে পার করতে হতো গোটা দিন। মা কষ্ট করতেন সবচেয়ে বেশি। তীব্র অভাবের এরকম দিনগুলোতে কোনো কোনো দিন সকালবেলা আমাদের এক মুঠো পান্তা ভাত জুটলেও সবাইকে খাইয়ে মা থেকে যেতেন সম্পূর্ন উপোস। কঠিন পরিশ্রম করে বাবার আয়ে তখন সংসার চলতো একরকম অনাহারে অর্ধাহারে। মাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষুধায় কান্না করতাম সেই সময়গুলোতে। অধিকাংশ সময়ে অভুক্ত মা অশ্রুসিক্ত নয়নে আদর করে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করতেন। দারিদ্র্যের অসহায়ত্ব যে কতটা ভয়ঙ্কর আমাদের চেয়ে পৃথিবীতে কে আর ভালো বুঝতো! তবুও কেন জানি আজ মনে হয়, সে দিনগুলো বড় মধুর ছিল! আনন্দের ছিল! স্মৃতি মনে পড়ে, তখন যেদিন ঘরে কোনো খাবার থাকতো না, মা বলতেন- 'আজ আমরা আল্লাহর মেহমান।'
মায়ের মুখ নি:সৃত সে কথাগুলো আজও কানে বাজে। এ কথা শুনলেই বুঝতে পারতাম, অসহায় মায়ের সর্বশেষ চেষ্টার পরেও আজ আর তার হাতে খাদ্যসামগ্রী বলতে কিছু নেই। মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভরসা ব্যতিরেকে তার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। তিনি কষ্ট লুকিয়ে কাষ্ঠ হাসি ঝুলিয়ে রাখতেন মুখে। পেটে ক্ষুধার আগুন। মুখে স্নিগ্ধ হাসি। অন্তরে আল্লাহর প্রতি অনি:শেষ ভরসা। আমার ভালো লাগতো সেই দিনগুলো! আহ! সেদিনগু্লো কতই না মধুর ছিল! আবার যদি কোনো দিন ফিরে যেতে পারতাম সুন্দর সেই দিনগুলোতে! মায়ের মুখে আবার শুনতে পেতাম সেই মধুর ভরসার অমিয় বানী- 'আজ আমরা আল্লাহর মেহমান!'
বাবা মায়ের কাছে আমার কোনো আব্দার ছিল না। তাদের কষ্টগুলো বুঝতাম। অনুভবে তাদের মনের কথাগুলো পড়ে নেয়ার সক্ষমতা অর্জন করে নিয়েছিলাম এত্তটুকুন থাকতেই। গায়ের ভাষায় এটাকে কি 'পাকনা' বলে? কেন যেন আশপাশের ছেলে মেয়েদের, সহপাঠীদের নিত্য নতুন পোষাকাদি দেখলেও, জাঁকজমকপূর্ন চলাফেরা দেখার পরেও আমার অনুভূতিতে বাবা মায়ের কষ্টের দিকটা সবসময় প্রাধান্য পেত।
আমার জানা ছিল, কোনো কিছু চাইলে বাবার সাধ্যাতীত হলেও তিনি তা দিতে চেষ্টা করবেন। তাতে কষ্ট তার যতই হোক। এই কারনেই কোনো কিছুর বায়না ধরা আমার কাছে ছিল অচিন্ত্যনীয়। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া আব্বার কাছে কিছু চাইতে মন সায় দিত না কখনোই।
আমার মনে পড়ে না, ছোট বেলায় কবে কোন্ ঈদে নতুন জামা পড়েছিলাম। পুরনো কাপড় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তাতেই আমাদের ঈদ চলে যেত। এক কাপড়ে চার পাঁচ বছর কিংবা তারও বেশি কাটিয়েছি সেসময়গুলোতে।
এসএসসি পরিক্ষা সামনে। একটি আব্দার রাখলাম বাবা মায়ের কাছে, পরিক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশন পেলে নতুন জামা কাপড় বানিয়ে দিতে হবে। আব্বা খুশি হলেও কিছু বললেন না। মুখে তার হালকা বিষন্নতার ছাপ। ঠোঁটে একটুকরো হাসির রেখা টেনে মাথা নাড়লেন শুধু। সে হাসি যে খুব কষ্টের, আমার বুঝতে বাকি রইল না।
যে ঘরে প্রতি দিনের খাবার সংকুলান করা হয়ে ওঠে না। মাঝে মাঝে যাদের উপোস করে কাটাতে হয়, তাদের নতুন জামা কাপড় কেনার স্বপ্ন দেখাও কঠিন বৈকি। গরিব বাবার পক্ষে এক সেট জামা কাপড় বানাতে যে টাকার প্রয়োজন তা যোগার করা কঠিন ব্যাপার। কিন্তু আমি জামা কাপড় বানানোর আব্দার পেশ করে আর না করতে পারলাম না। কেনো পারলাম না, তাও জানি না।
বাড়ি থেকে মাইল তিনেক দূরে ছিল পরিক্ষা কেন্দ্র। সেখানেই এক আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে পরিক্ষা দিচ্ছিলাম। সবগুলো পরিক্ষা খুবই ভালো হল। মনমত লিখেছি। ধারনা করেছি, ফার্স্ট ডিভিশনের চিন্তা নেই। স্টার মার্কস পেয়ে যাব হয়তো। কারন, প্রায় পরিক্ষাতেই হল সচিব, পরিক্ষক, এমনকি মেজিস্ট্রেট আমার সিটের পাশে দাড়িয়ে আমার লেখা পরখ করতেন। পরিক্ষকদের ভিন্ন নজর ছিল আমার প্রতি। এতেই বুঝতাম, আমার পরিক্ষাগুলো ভালো হচ্ছে।
পরিক্ষা শেষে বাড়ি ফিরছিলাম এক দিন। সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই তখন। আকাশ পরিষ্কার থাকায় মনে হল, সাঁঝের এখনো অনেক বাকি। হাটতে হাটতে বাড়ির খুব কাছে চলে এসেছি। মাথা তুলে একবার চেষ্টা করলাম, বাড়িটা দেখার। বাড়ির আশেপাশে মানুষের সমাগম। শরীরে হালকা ঝাঁকুনি লাগলো। বুকে কেমন আলতো কাঁপন অনুভব করলাম। অজানা আশঙ্কায় বাড়ির দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারলাম না। মনের ভেতর অসংখ্য প্রশ্ন- কী ঘটতে পারে? ঝগড়া বিবাদ? মারামারি? কোনো দুর্ঘটনা? অগ্নিকান্ড?
এমনিতরো অগনিত প্রশ্ন মাথায় ভিড় ঘুরপাক খায়। ধুকপুক করছে বুক। কেউ একজন যেন হাতুড়ি পেটা করছে বুকের পাটাতনে। চেষ্টা করছি দ্রুত হাঁটার। সামনের মাঠটা পেরুলেই বাড়ি। কিন্তু পা যেন এগুচ্ছিল না কোনোভাবেই। মনের ভেতরে হাজারো রহস্য ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে যে! বাড়ির দিকে ক্রমশ: এগুচ্ছি তবুও! কৌতূহলও যুগপত বাড়তে থাকে! হঠাত কানে আসে কান্নার শব্দ! বাতাসে শোরগোল! কান্নার ধ্বনি! অনেক লোকের কথাবার্তার আওয়াজ!
বাড়ির সামনের ভির ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। কান্নার শব্দ আরও বেড়ে গেল। মেয়েলি কন্ঠের কান্নার আওয়াজ। চাপা আর্তনাদ। ভেতরে ভেতরে ঘামছিল শরির। কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা ঘরের ভেতর চলে এলাম। চোখের সামনে অনেক চেনা-অচেনা মুখ। এত লোক কেন? সবাই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। অমন করে আমার দিকে কেউ তাকালে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলি আমি। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না আমি। আম্মা কোথায়? আব্বা কই? এমন সময় কে যেনো পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ঘার ফিরিয়ে দেখার আগেই কান্নার শব্দ। সেই সাথে হাহাকার মিশ্রিত ছোট বোনের প্রশ্ন-
'ভাইয়া! তুমি এখন এলে?'
আমার ভেতরটা আরেকবার কেঁপে উঠল।
'বুশরা! কী হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেনো বোন? এত লোক কেন বাড়িতে?'
'ভাইয়া, বাবা আর নেই!'
কথাটা তীরের বেগে বুকে এসে বিদ্ধ হলো যেন! রক্ত হিম হয়ে উঠল!
বোবা হয়ে গেলাম কিছু সময়ের জন্য। নিশ্চল ঠায় দাঁড়িয়ে। মনে হল, কয়েক হাজার টন ওজনের কোনো পাহাড় যেন আমার মাথার উপরে চেপে দিয়েছে কেউ! স্তব্ধ পৃথিবী আমার! হঠাৎ ধপাস করে পড়ে গেলাম মেঝেতে। আমার মাথায় পানি ঢেলে দেয়া হল। চোখ খুলে তাকালাম। কত সময় বেহুশ ছিলাম জানি না। মাথা ভারী হয়ে উঠলো। মৃত আব্বাকে দেখিনি তখনও! অস্ফুটে শুধু বললাম- আব্বার কাছে আমাকে নিয়ে যাও!
প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন-
গল্প: স্মৃতিগুলো জোছনা হয়ে ঝরে, পর্ব-০১
ছবি কৃতজ্ঞতা: গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৯ সকাল ৮:৪৯