অনেকে বলে থাকেন, টুথব্রাশ ও পেস্ট দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করলেই মিসওয়াকের সুন্নত আদায় হয়ে যায়; গাছের ডাল কিংবা শিকড়ের মিসওয়াকের প্রয়োজন নেই। বিষয়টির জটিলতা নিরসনে সামান্য আলোচনার প্রয়োজন। মূলত: টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করলে দাঁত ও মুখের পরিচ্ছন্নতা যে অর্জিত হয় এতে সন্দেহ নেই, কিন্তু মিসওয়াকের সুন্নত পরিপূর্ণ আদায় হয় না।
বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে হলে লক্ষ্য করা দরকার, মিসওয়াকের সুন্নতের ক্ষেত্রে দু'টি দিক রয়েছে। প্রথমত: দাঁত ও মুখের পরিচ্ছন্নতা অর্জন। টুথপেস্ট, ব্রাশ ইত্যাদি ব্যবহার করে দাঁত পরিষ্কার করা হলে দাঁত পরিষ্কার করার উদ্দেশ্য সাধিত হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত: মিসওয়াকের সুন্নতের ক্ষেত্রে অন্য দিকটি হলো মিসওয়াক করার মাধ্যম, যার দ্বারা দাঁত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হবে। এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে- আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁত পরিষ্কার করার জন্য ঠিক কোন্ জিনিষটি ব্যবহার করতেন! উত্তর হচ্ছে- অবশ্যই তিনি গাছের ডাল অথবা শিকড়ের মিসওয়াক ব্যবহার করতেন। অতএব গাছের ডাল বা শিকড় ব্যবহার করা না হলে মিসওয়াকের সুন্নতের দ্বিতীয় দিকটির উপরে আমল করা হয় না।
সুতরাং, টুথপেস্ট, ব্রাশ ও মাজন দিয়ে মিসওয়াক করার ক্ষেত্রে মিসওয়াকের সুন্নতের প্রথম দিকটি আদায় হবে। ইমাম নববী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, দাঁতের দুর্গন্ধ ও ময়লা দাগ পরিষ্কার করার জন্য যেকোনো জিনিস দিয়ে মিসওয়াক করলেই দুর্গন্ধ থেকে মুক্ত করার সুন্নত আদায় হয়ে যায়। (শরহে মাজহাব ১/২৮১)
কিন্তু দ্বিতীয় সুন্নতটি আদায় তখনই হবে, যখন মিসওয়াকটি রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর মিসওয়াকের মতো (গাছের ডাল অথবা শিকড়) হবে। (জাদিদ ফিকহি মাসায়েল ১/৬৫)
তাহলে বোঝা গেল, টুথব্রাশ দিয়ে মিসওয়াক করলে পরিপূর্ণ সুন্নত আদায় হয় না।
অবশ্য যেসব যুক্তিবাদী ভাইয়েরা প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নতি পোষাক লম্বা জামা এবং জুব্বাকে গ্রহন না করার অযুহাত হিসেবে আরবের মরুময় আবহাওয়ার যুক্তি দেখিয়ে বলতে চান যে, 'এগুলো সেখানকার পরিবেশ ও আবহাওয়ার জন্য উপযোগী বিধায় আরবের লোকজন এই ধরণের পোষাক পরিধানে অভ্যস্ত, পোষাক যে কোনোটি পরিধান করলেই হয়ে যায়;' -তাদের কথা এক্ষেত্রেও ভিন্ন। তারা হয়তো মিসওয়াকের ক্ষেত্রেও যুক্তি দেখিয়ে বলতে পারেন যে, 'তখন (নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সমসাময়িক কালে) এখনকার মত এমন আধুনিক প্রযুক্তির টুথ ব্রাশ ইত্যাদির উদ্ভাবন ঘটেনি, তাই সেকালের মানুষেরা গাছের ডাল বা শিকড় ব্যবহার করে দাঁত ও মুখের পরিচ্ছন্নতা অর্জন করতেন। এখন যেহেতু পৃথিবী এগিয়ে গিয়েছে, তাই ব্রাশ ব্যবহার করাই যুক্তিযুক্ত।' তাদের কথা তাদের নিকট। আমাদের মুহাব্বত প্রতিটি সুন্নতের প্রতি।
তবে, বিতর্ক নিরসনের লক্ষ্যে বলে রাখা প্রয়োজন, আধুনিক ভালো মানের ব্রাশ ব্যবহার করায় কোনো দোষ নেই। কিন্তু ব্রাশ ব্যবহারের মাধ্যমে কেউ মিসওয়াকের সুন্নতের পরিপূর্ণ আমল করেছেন, এমনটা দাবি করার সুযোগ নেই। তাই ব্রাশ ব্যবহারের পাশাপাশি ছোট আকারের একটি মিসওয়াক সার্বক্ষনিক কলমের মতই পকেটে রাখা যেতে পারে। এতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পূর্বে মিসওয়াক করার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত আদায় করার মাধ্যমে হাদিসে বর্ণিত প্রতি রাকাআত নামাজে পচিশ কিংবা সাতাশ গুন সাওয়াবলাভ করা সহজ হয়ে যায়।
হাদিসের আলোকে মিসওয়াকের গুরুত্ব:
এ প্রসংগে হযরত আবু উমামা (রা) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, তিনি বলেনঃ
عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: «ما جاءني جبريل قط إلا أمرني بالسواك حتى لقد خشيت أن أحفي مقدم فمي»
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, 'এমনটি কখনো হয়নি যে, জিবরাইল (আ) আমার নিকট এসেছেন আর আমাকে মিসওয়াকের আদেশ দেননি। এতে আমার আশংকা হচ্ছিল যে, (মিসওয়াকের কারণে) আমার মুখের অগ্রভাগ ছিলে না ফেলি।' (আল মুযামুল কাবীর লিত তবারানী, হাদীস নং৭৮৪৭, মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ২২২৬৯)
অন্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
لولا أن أشق على أمتي أو على الناس لأمرتهم بالسواك مع كل صلاة»
'আমি যদি উম্মতের উপর (কষ্ট হবার) আশংকা না করতাম তাহলে প্রত্যেক নামাজেই মিসওয়াক করার আদেশ দিতাম।' (বুখারী শরীফ, হাদীস নং৮৮৭, মুসলিম শরীফ, হাদীস নং২৫২)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
السواك مطهرة للفم مرضاة للرب
'মিসওয়াক মুখের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যম ও আল্লাহর সন্তুষ্টির উপায়।' (নাসায়ী শরীফ, হাদীস নং ৫)
অন্য এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «فضل الصلاة التي يستاك لها على الصلاة التي لا يستاك لها سبعين ضعفا» تفرد به يحيى بن معاوية بن يحيى الصدفي ويقال إن ابن إسحاق أخذه منه
'মিসওয়াক করে যে নামাজ আদায় করা হয়, সে নামাজে মেসওয়াকবিহীন নামাজের তুলনায় সত্তরগুন বেশী ফযীলত রয়েছে।' (শুয়াবুল ঈমান, বাইহাকী, হাদীস নং ২৫১৯)
প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, 'আমি উম্মতের জন্য কষ্টকর মনে না করলে এশার নামাজকে দেরী করে পড়তে এবং প্রত্যেক নামাজের পূর্বে দাঁতন (মিসওয়াক) করতে আদেশ দিতাম।' -(বুখারী, মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ: ৩৭৬)
অন্য হাদিসে একই বিষয়ের গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে এভাবে: 'আমি আমার উম্মতের পক্ষে কষ্টকর না জানলে (প্রত্যেক) ওযুর সাথে দাঁতন (মিসওয়াক) করা ফরয করতাম এবং এশার নামাজ অর্ধেক রাত পর্যন্ত দেরী করে পড়তাম।' -(হাকেম, বাইহাকী, সহীহুল জামে' ৫৩১৯)
'মুসলিমদের প্রকৃতিগত কর্মসমূহের মধ্যে একটি হল, মিসওয়াক করে মুখ সাফ করা।' -(মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ: ৩৭৯)
'মিসওয়াক মুখের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টির উপায়।' (বুখারি, নাসাঈ, মিশকাত)
অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, 'জিবরাইল আলাইহিসসালাম (মুসনাদে আহমাদ) আমাকে (এত বেশী) দাঁতন (মিসওয়াক) করতে আদেশ করেছেন, এতে আমার ভয় হয় যে, দাঁতন (মিসওয়াক) করা আমার উপর ফরয করে দেওয়া হবে।' -(সহীহুল জামে: ১৩৭৬)
তিনি আরও বলেন: 'দাঁতন করায় রয়েছে মুখের পবিত্রতা এবং প্রতপালক আল্লাহ তাআ'লার সন্তুষ্টি।' -(আহমাদ, দারেমী, ইবনে হিব্বান)
হযরত আয়িশা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা বলেন, 'নবী কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিসওয়াক করে আমাকে তা ধুতে দিতেন। কিন্তু ধোয়ার আগে আমি মিসওয়াক করে নিতাম। তারপর তা ধুয়ে তাঁকে দিতাম।' -(সিলসিলাহ সহীহা: ১২১৩)
যথেচ্ছ ব্রাশ ব্যবহার হতে পারে দাঁত, মাড়ি ও দাঁতের স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ:
আমরা সচরাচর প্রায় সবাই যদিও ব্রাশ ব্যবহার করে থাকি, কিন্তু অনেকেই হয়তো জানি না, জীবাণু বিশেষজ্ঞদের বছরের পর বছর গবেষণায় একথা পূর্ণতার স্তরে উপনীত হয়েছে যে, যে ব্রাশ একবার ব্যবহার করা হয়, পুনরায় তা ব্যবহারে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। কেননা, একবার ব্যবহারের পরই তাতে রোগ-জীবাণুর স্তর জমে যায়। তা পানি দ্বারা ধুয়ে ফেললেও ক্রিয়াশীল থাকে। তাছাড়া ব্রাশ ব্যহার করা হলে দাঁতের ওপরের চমকদার সাদা স্তর নষ্ট হয়ে যায়। ফলে দাঁতের মাঝে ফাঁক তৈরী হয় এবং ধীরে ধীরে দাঁত মাড়ি থেকে আলাদা হয়ে যায়। দাঁতের ফাঁকে খাদ্যকণা আটকে গিয়ে মাড়ি এবং দাঁতের ক্ষতির কারণ হয়। সুতরাং, ব্রাশ ব্যবহার করলেও তা করতে হবে সতর্কতার সাথে।
সকলকে মাহে রমজানের শুভেচ্ছা।
আল্লাহ পাক আমাদের সঠিকভাবে প্রতিটি সুন্নতের প্রতি আমল করার তাওফিক দান করুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:০৮