মৃত্যু অনিবার্য এক সত্যের নাম:
মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, 'কুল্লু নাফসিন জা-য়িকাতুল মাউত’ অর্থ্যাৎ প্রতিটি প্রাণীই একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। পৃথিবীর নিষ্ঠুর এই সত্য কথাটি জেনেও কেন জানি আমাদের মৃত্যু নিয়ে ভাবার সময় থাকে না। শুধু একটিবার নিজের মৃত্যুর চিত্রটি এভাবে ভেবে দেখুনতো পাপ কাজ করতে পারেন কি না-
বন্ধুরা, ভেবে দেখেছেন কি কখনো, মৃত্যুর সাথে সাথেই আমাদের নাম হয়ে যায় ‘লাশ’? লোকে বলবে ‘লাশের’ পা টা একটু সোজা করেন। ‘লাশ’কে একটু বরফে রাখলে ভালো হয়। ‘লাশ’কে কবরে নেয়ার সময় হয়েছে। তখন কেউ আর আমার ডাক নাম ধরে ডাকবে না, ডাকবে না ম্যাডাম বা স্যার বলেও, বলবে শুধুই একটা লাশ। অনেকে রাতে ভয় পাবে বলে চেহারাটাও দেখবে না। যদিও আপনার আমার জীবদ্দশায় আমাদের আপন আপন রূপ সৌন্দর্য ছিল অতুলনীয়। আমরা সুদর্শন ছিলাম। সুশ্রী ছিলাম।
ভেবে দেখুন, সেই দিনটি কতইনা কষ্টের হবে। যখন আপনার আপনজনই আপনার লাশ কাঁধে নিয়ে আপন ঘর থেকে আপনাকে বের করে দিয়ে বাড়ীর পাশে অন্ধকার একটা জায়গার দিকে নিয়ে যাবে। যেই জায়গার পাশ দিয়ে আপনি হয়তো অসংখ্য বার আপনার বন্ধু বান্ধব নিয়ে হাসতে হাসতে পথ চলেছিলেন। সেই দিনটিতে আপনি সবই দেখতে পাবেন, শুনতে পাবেন কিন্তু কিছুই বলতে পারবেন না। কতই না অসহায়ত্বপূর্ণ হবে আমাদের সেই দিনগুলো!
বন্ধুরা, আসুন আজ আমরা হযরত সুলাইমান (আ.) -এর জীবন থেকে নেয়া একটি গল্প শুনি।
হযরত সুলাইমান আলাইহিসসালাম এর দরবার থেকে মৃত্যুভয়ে পালানো সেই লোকটির গল্প:
অনেক অনেক আগের কথা।
আল্লাহর নবী হযরত সুলাইমান আলাইহিসসালাম এর সময়কাল তখন। একদিন দুপুরে হযরত সুলাইমান আলাইহিসসালাম তার শাহী দরবারে বসে আছেন। এমন সময় এক লোক হন্তদন্ত হয়ে সেখানে ছুটে এল। লোকটি আল্লাহর নবীকে দেখেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। হযরত সুলাইমান আলাইহিসসালাম তার এ অবস্থা দেখে খানিকটা অবাক হলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, "কী হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন? কী চাও তুমি?"
লোকটি বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল: "হে আল্লাহর নবী! হে মহান বাদশাহ!! আমাকে আজরাইলের হাত থেকে বাঁচান। আমি আজ আজরাইলকে দেখেছি। আমার দিকে ভীষণ ক্রোধের সঙ্গে তাকিয়ে ছিল। আমাকে ভয় দেখিয়ে পাশ কেটে চলে গেল। আমার ভয় হচ্ছে আজরাইল আবার ফিরে আসবে এবং আমার জান কবজ করে নেবে।"
হযরত সুলাইমান আলাইহিসসালাম লোকটিকে অভয় দিয়ে বললেন, "এতে ভয়ের কী আছে! আজরাইল হচ্ছেন আল্লাহর মহান ফেরেশতা। তিনি কেবল আল্লাহর হুকুমেই জান কবজ করেন। আমি তো প্রায় প্রতিদিনই আজরাইলকে দেখি কিন্তু কই আমি তো ভয় পাই না। যাই হোক, এখন বলো, তোমার জন্য আমি কী করতে পারি, তুমিই বা কী চাও?"
লোকটি বলল: "আপনি ভয় না পেলে কী হবে, আমি আজরাইলকে ভীষণ ডরাই। কিন্তু আজ তার রাগ দেখে আরও ভয় করছে। তার কাছ থেকে আমি বাঁচতে চাই। লোকের নিকট শুনেছি, বায়ু আপনার হুকুম পালন করে। এখন আপনি বায়ুকে হুকুম করুন আমাকে এ দেশ থেকে দূরে নিয়ে যাক। মানুষ একথাও বলে থাকে যে, সুলাইমান বাদশাহ মানুষের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করে থাকেন। এখন আমার দাবি হল- বাতাসকে এক্ষুণি হুকুম দিন আমাকে হিন্দুস্তান নামক দেশে নিয়ে যাক। আমি চাই আজরাইল যেহেতু এদেশে আমার ঠিকানা জেনে গেছে সেহেতু এদেশে আর থাকব না। আপনি দয়া করে আমাকে হিন্দুস্তানে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।"
হযরত সুলাইমান আলাইহিসসালাম বেচারার কাকুতি-মিনতি ও কান্নাকাটি দেখে বললেন, "বেশ ভালো কথা। জীবন-মরণের ভার আমার হাতে নেই। তবে বায়ু আমার কথা শুনে থাকে। যাও তোমার দাবি আমি পূরণ করব। এক্ষুণি বায়ুকে বলছি তোমাকে হিন্দুস্তানে নিয়ে যাক।"
হুকুম পেয়ে বাতাস লোকটিকে হযরত সুলাইমানের গালিচায় বসিয়ে কয়েক মুহূর্তেই বনবাদাড়, মরু সাহারা, নদ-নদী ও সাগর-দরিয়া পার হয়ে হিন্দুস্তানের এক শহরে পৌঁছে দিল।
সেদিন পার হল। পরের দিন হযরত সুলাইমান আলাইহিসসালাম তার দরবারে বসে আছেন। এমন সময় হযরত আজরাইল আলাইহিসসালাম সেখানে উপস্থিত হলেন। তাকে দেখেই হযরত সুলাইমান আলাইহিসসালাম জিজ্ঞেস করলেন, "ভাই আজরাইল! গতকাল এক লোক ভীত অবস্থায় আমার দরবারে এসেছিল এবং আপনার বিরুদ্ধে নালিশ করেছে। সে বলেছে, আপনি নাকি তার দিকে মারাত্মক ক্রোধের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন! লোকটি আমার কাছে অনুরোধ জানাল আমি যেন বাতাসকে নির্দেশ দেই যাতে তাকে ওই মুহূর্তেই এই শহর থেকে হিন্দুস্তানে পৌঁছে দেয়। আমি তাকে হতাশ করতে চাইনি। বাতাসকে তার ইচ্ছেমতো হিন্দুস্তানে পৌঁছে দিতে হুকুম করলাম। এখন সে হয়তো হিন্দুস্তানেই আছে। কিন্তু আমি খুব তাজ্জব হয়েছি যে, আল্লাহর এত বড় একজন ফেরেশতা হয়ে আপনি কেন তাকে ভয় দেখালেন। বেচারা আপনার ভয়েই আজ ঘরবাড়ি ও দেশছাড়া হল।"
হযরত সুলাইমানের কথা শুনে আজরাইল আলাইহিসসালাম বললেন, "আমি আল্লাহর হুকুম পালন ও তার আদেশ মানা ছাড়া আর কিছুই করি না। ওই লোকটির প্রতি আমি রাগ করে কিংবা ক্রোধের দৃষ্টিতে মোটেই তাকাইনি। সে ঠিকই বলেছে, আমি তাকে গতকাল এই বায়তুল মুকাদ্দাস শহরে দেখেছি। তার প্রতি আমি যে দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম তা আসলে বিস্ময়ের দৃষ্টি ছিল। কারণ আল্লাহর নির্দেশ ছিল গতকালই যেন হিন্দুস্তানে তার জান কবজ করি। তাই তাকে তার মৃত্যুর মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগেও বায়তুল মুকাদ্দাসে দেখে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে যাই যে, কী করে সে এখন এই এলাকায় ঘোরাফেরা করছে! তাকে দেখে আমি মনে মনে ভাবলাম, তার যদি শত শত পাখাও গজায় তাহলেও সে আছরের আগে হিন্দুস্তান পৌঁছুতে পারবে না। যাই হোক, যেহেতু তখনো তার মরণের সময় উপস্থিত হয়নি সেহেতু খুব আশ্চর্য হয়েই তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম এবং পাশ কেটে হিন্দুস্তানে চলে গেছি। কিন্তু সময়মতো হিন্দুস্তানে পৌঁছেই দেখি সেখানে সে নির্ধারিত স্থানে হাজির! এরপর আর দেরি না করে তার জান কবজ করে নেই।"
সব শুনে হযরত সুলাইমান আলাইহিসসালাম বললেন, একদম ঠিক কথা। সব কিছু থেকে পালানো সম্ভব কিন্তু মৃত্যুর হাত থেকে পালানো সম্ভব নয়। তার সেই মুহূর্তে অবশ্যই হিন্দুস্তানে থাকা দরকার ছিল। কিন্তু বায়ু ছাড়া তাকে সেই মুহূর্তে সেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। সে নিজেই সেচ্ছায় আমার কাছে ছুটে এল এবং নিজের মুখেই কাকুতি-মিনতি করে নিশ্চিত পরিণতির দিকে ছুটে গেল।
কবি সুন্দর বলেছেন, ঠিকই বলেছেন-
মরণ থেকে যতই পালাও মরণ তোমায় লইবে ঘিরি,
যদিও সুদূর আকাশপানে লুকাও সেথায় লাগিয়ে সিড়ি!
বন্ধুরা, এ ঘটনাটি থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, মৃত্যু থেকে পালানোর শক্তি কারও নেই। এটা সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, 'কুল্লু নাফসিন জা-য়িকাতুল মাউত’ অর্থাৎ 'প্রত্যেক প্রাণিকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে।' (সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ১৮৫)
মহান আল্লাহ আরও বলেছেন, "তোমরা যেখানেই থাক না কেন; মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই। যদি তোমরা সুদৃঢ় দূর্গের ভেতরেও অবস্থান কর, তবুও।" (সূরা নিসা, আয়াত নং ৭৮)
শেষের প্রার্থনা:
হে বিশ্বজাহানের মালিক, হে জীবন জগতের স্রষ্টা, হে হায়াত মউতের একচ্ছত্র অধিপতি আল্লাহ, আমরা শিকার করছি অমরা অনেক গুনাহগার। এই জীবনে, বুঝে না বুঝে অনেক অপরাধ করেছি কিন্তু আপনি যে দয়াবান সে বিশ্বাস তো আমাদের পরিপূর্ণরূপেই রয়েছে। হে আল্লাহ, আমরা সকল পাপ থেকে আপনার দরবারে তওবা করছি, আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন।
আমিন ।
ছবি: অন্তর্জাল।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১৯ সকাল ১১:২৬