অপার সম্ভাবনাময় ড্রাগন ফলের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা এবং সংক্ষেপে এর চাষ পদ্ধতি:
ড্রাগন নামটা শুনলেই কেমন যেন বিশাল সাইজের একটা কিছুর প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ফলের নামও যে ড্রাগন থাকতে পারে আমরা খুব বেশি দিন আগেও জানতাম না। অনেকের নিকটই এই ফলটি অচেনাই ছিল। এর পেছনে কারণও রয়েছে। প্রধান কারণ হচ্ছে, ড্রাগন ফলটি বিদেশি। বিদেশি অনেক ফল বাংলাদেশে অহরহ পাওয়া গেলেও এই ফলটি ততটা চোখে পড়েনি আগে। তবে বিদেশি ফল হলেও ড্রাগন ফলের সতেজ করা স্বাদ ও পুষ্টিগুণের জন্য বাংলাদেশেও এখন এই ফল চাষ হচ্ছে। আর পুষ্টিগুণ কমলা বা গাজরের চাইতে বেশি। ড্রাগনের রয়েছে অবিশ্বাস্য স্বাস্থ্য উপকারিতা। বয়স বাড়ার চিহ্ন দূর করা থেকে শুরু করে ক্যান্সার ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে এই ফল। গর্ভবতী মায়েরাও খেতে পারেন সুস্বাদু ড্রাগন। চলুন তা হলে জেনে নেওয়া যাক ড্রাগন ফলের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে-
গাছ থেকে তুলে আনা আকর্ষনীয় ড্রাগন ফল
ড্রাগন ফলের জন্ম ইতিহাস: ড্রাগন ফল (যা পিতায়া নামেও পরিচিত, চীনা: 火龍果/火龙果, থাই: แก้วมังกร, বৈজ্ঞানিক নাম Hylocereus undatus) এটি এক প্রজাতির ফল, একধরনের ফণীমনসা (ক্যাক্টাস) প্রজাতির ফল, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে এর মহাজাতি হায়লোসিরিয়াস (মিষ্টি পিতায়য়া)। এই ফল মূলত ড্রাগন ফল হিসেবে পরিচিত। গণচীন-এর লোকেরা এটিকে আগুনে ড্রাগন ফল এবং ড্রাগন মুক্তার ফল বলে, ভিয়েতনামে মিষ্টি ড্রাগন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতে ড্রাগন ফল (ໝາກມັງກອນ), থাইল্যান্ডে ড্রাগন স্ফটিক নামে পরিচিত। অন্যান্য স্বদেশীয় নাম হলো স্ট্রবেরি নাশপাতি বা নানেট্টিকাফল। এই ফলটি একাধিক রঙের হয়ে থাকে।
এই মহাজাতির হায়লোসিরিয়াস এর দ্রাক্ষালতা মত পিতায়য়া প্রথমে আসত স্থানীয় মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। বর্তমানে এগুলো পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া দেশগুলোতে যেমন ইন্দোনেশিয়া'র হিসাবে (বিশেষ করে পশ্চিমা জাভা), তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া,[১] এবং আরও সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে চাষ হয়। [২] এছাড়াও ওকিনাওয়া, হাওয়াই, ইসরায়েল, প্যালেস্টাইন, উত্তর অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ গণচীন পাওয়া যায়। সূত্র: উইকিপিডিয়া।
ড্রামে ড্রাগন চাষ।
পুষ্টিগুণ: প্রতি ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলের সাদা বা লাল অংশে ২১ মি.গ্রা. ভি’টামিন সি পাওয়া যায় যা দৈনিক ভিটামিন সি’র চাহিদার ৩৪ শতাংশ পূরণ করতে সাহায্য করে। ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে যে পরিমাণ ভিটামিন সি পাওয়া যায় তা একটি ক’মলার সমান বা তিনটি গাজরের চেয়ে বেশি ভিটামিন সি সরবারহ করতে সক্ষম। প্রতি ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে ০.০৪ মি.গ্রা. ভিটামিন বি ১, ০.০৫ মি.গ্রা. ভিটামিন বি ২, ০.০১৬ মি.গ্রা ভিটামিন বি ৩ এবং ২০.০৫ মি.গ্রা. ভিটামিন সি পাওয়া যায়। ড্রা’গন ফল আয়রনের ভালো উৎস। ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে ১.৯ মি.গ্রা. আয়রন থাকে। এছাড়াও এতে ক্যালসিয়াম থাকে ৮.৫ মি.গ্রা. এবং ফসফরাস থাকে ২২.৫ মি.গ্রা.।
Yellow Dragon Fruit Pitahaya Rare Plant, বিরল প্রজাতির হলুদ ড্রাগন ফল
Yellow Dragon Fruit Pitahaya Rare Plant, বিরল প্রজাতির হলুদ ড্রাগন ফল
হলুদ জাতের ড্রাগন ফলের ভেতরের অংশ
উপকারিতা: বয়সের ছাপ দূর করা, ত্বককে দৃঢ় রাখতে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দরকার হয় শরীরের। এগুলো ক্যান্সারের স’ঙ্গেও লড়াই করে। ভিটামিন সি এর উপস্থিতির কারণে ড্রাগন ফলকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের বড় উৎস মনে করা হয়। ক্যান্সার প্রতিরোধ:২০১১ সালে এশিয়া প্যাসিফিক জার্নাল অব ক্যান্সার প্রিভেনশনে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়, প্রতিদিন প’র্যাপ্ত পরিমাণে ‘লাইকোপেনে’ নামক পুষ্টি উপাদান গ্রহণ না করলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়াও ড্রাগনে রয়েছে ক্যারোটিন। যা শরীরে থাকা টিউমার ধ্বংস করতে পারে।
হজম প্রক্রিয়া ঠিক রাখে: খাদ্যে আঁশের পরিমাণ বেশি থাকলে পরিপাক প্র’ক্রিয়া ঠিক ভাবে কাজ করে। উচ্চ আঁশের ড্রাগন ফল তাই কোষ্ঠকাঠিন্য এবং বদহজম প্রতি’রোধেও কার্যকর।
টবে ব্লু ড্রাগনের চাষ
টবে ব্লু ড্রাগনের চাষ
হার্টের সুস্থতায়: খারাপ কোলেস্ট্রোরল কমানোর মাধ্যমে হৃদযন্ত্র ভাল রাখে ড্রাগন। ভাল কোলেস্ট্রেরলও বাড়ায় এ ফল। ২০১০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে ড্রাগন খেলে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে।
ডায়াবেটিস: বেশি পরিমাণে আঁশ থাকায় ড্রাগন খেলে রক্তে শর্করার পরিমাণ স্থিতিশীল থাকে। গবেষকরা বলছেন, খাদ্য তালিকায় নি’য়মিত ড্রাগন থাকলে ডায়াবেটিস সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ফুটছে মনমুগ্ধকর ড্রাগনের ফুল।
রোগ প্রতিরোধে: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃ’দ্ধির সব উপাদানই রয়েছে ড্রাগনে। বিশেষত এর প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি কার্যকর রাখে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে। এছাড়া এ ফলে মিনারেলস, পাইটোঅ্যালবুমিনও রয়েছে উচ্চ পরিমাণে। নিয়মিত খেলে এই বিদেশি ফলটি আপনার স্বাস্থ্য ভাল করবেই।
বয়সের ছাপ দূর করতে: বয়সের ছাপ দূর করতে প্রয়োজন প্রচুর পরিমানে এন্টি-অক্সিডেন্টে। ভিটামিন সি তে ভরা ড্রাগন ফলকে এন্টি-অক্সিডেন্ট এর আধার ভাবা হচ্ছে এখন।
ক্যান্সার প্রতিরোধে: ড্রাগন ফল ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে। এই ফলে ক্যারোটিন নামক উপাদান রয়েছে, যা শরীরে থাকা টিউমারকে ধ্বংস করে।
ড্রাগন ফলের সমারোহে দৃষ্টিনন্দন বাগান
বাংলাদেশেও এই ফলের চাষ হচ্ছে: ক্যাকটাস জাতীয় এই ফল সুমেরু এলাকায় প্রচুর পরিমাণে চাষ হয়। তবে সুখবর হচ্ছে, কিছুদিন হলো বাংলাদেশের মাটিতেও এর চাষ কিছু এলাকায় শুরু হয়েছে। নাটোরে ড্রাগন ফলের সফল চাষ, ড্রাগন চাষে ফরিদপুরে সফলতা, ড্রাগন ফল, ড্রাগন চাষে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ, দেশে ড্রাগন ফল চাষের অপার সম্ভাবনা আরও আনন্দের সংবাদ হচ্ছে, নরসিংদীসহ ড্রাগন চাষে স্বাবলম্বী মনোহরদীর মুখলেছ বাংলাদেশের কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলক এই ফল চাষ করে মাটি এই ফল চাষের বেশ উপযুক্ত বলে প্রমান পাওয়া গিয়েছে।
বাসা বাড়ির ছাদে টবেও করা যায় ড্রাগন ফলের চাষ:
আপনি চাইলে বাড়ির ছাদে বা ঘরের বেলকনিতেও বড় টবে বা ড্রামে ড্রাগন ফল চাষ করে শখ পুরণ ও পুষ্টি আহরণ দুটোই করতে পারেন। নিম্নে ছাদ বাগানে ড্রাগন ফল চাষ পদ্ধতি বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করা হলো-
কখন ড্রাগন ফল চাষের উত্তম সময়:
ড্রাগন ফল সাধারণত সারা বছরেই চাষ করা যায়। এটি মোটামুটি শক্ত প্রজাতির গাছ হওয়ায় প্রায় সব ঋতুতেই চারা রোপন করতে পারেন। তবে ছাদে ড্রাগন ফল চাষ করে ভালো ফলন পেতে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে চারা রোপন করলে আপনি অবশ্যই সুফল পাবেন। লতানো ক্যাকটাসের মতন ড্রাগন গাছে সাধারণত ফল আসে মে মাসে, আর ফলন হয়ে থাকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত। পর্যাপ্ত রোদ, জল, জৈব সার এবং নিয়মিত পরিচর্যায় আসে বাহারী ফুল, তারপর সেই ফুল থেকে ধরে লোভনীয় রঙের ড্রাগন ফল।
টবে ড্রাগনের চাষ
ছাদে চাষের উপযোগী পাত্র:
আপনার ছাদ বাগানে ড্রাগন ফল চাষ করতে পারেন মাটির টবে বা ড্রামে। তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি আপনি ২০ ইঞ্চি আকারের ড্রাম বেছে নেন। কারণ এই আকারের ড্রামে চারা ভালোভাবে শিকর ছড়াতে পারবে আর তাতে ফলন অনেক ভালো হবে।
কেমন মাটি প্রয়োজন:
যদিও প্রায় সব রকমের মাটিতে ড্রাগন ফল সহজেই চাষ করা সম্ভব। কিন্তু ভালো ফলন চাইলে আপনি অবশ্যই উৎকৃষ্ট জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ বেলে দোঁআশ মাটিই বাছাই করবেন। শুরুতেই আপনাকে বেলে দোআঁশ মাটি সংগ্রহ করে ভালো ভাবে পরিস্কার করে নিতে হবে। তারপর পরিমান মত গোবর, ৫০ গ্রাম পটাশ সার ও ৫০ গ্রাম টি,এস,পি, সার সংগ্রহ করা মাটির সাথে ভালো ভাবে মিশিয়ে নিবেন। সার ও মাটির মিশ্রনে পরিমান মত পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিন। এখন আপনার বাছাই করা ড্রামে সকল উপকরণ গুলো ১০ থেকে ১২ দিন রেখে দিন। তারপর ড্রামের মাটি ভালো করে খুন্তি দিয়ে ঝুরঝুরে করে আরো ৪ থেকে ৫ দিন রেখে দিন। মাটি কিছুটা শুষ্ক হয়ে উঠলে ভালো জাতের কাটিং চারা ড্রামে বা পাত্রে রোপন করুন।
ড্রাগনের চারা
সেচ ও পরিচর্যা:
ড্রাগন ফল গাছের সঠিক পরিচর্যা না করলে ফলন ভালো হবেনা। যদিও ড্রাগন ফল গাছে তেমন একটা রোগ বালাইয়ের আক্রমন হয়না তবে পারিপার্শ্বিক অন্যান্য যত্ন নিয়মিত নিতে হয়। চারা লাগানোর পর ড্রাম টি রোদ যুক্ত স্থানে রাখুন। এটি ক্যাকটাস জাতীয় গাছ বলে চাষে খুব বেশি পানি দিতে হয়না। চারায় পানি দেয়ার সময় লক্ষ্য রাখুন যেন গোড়ায় পানি না জমে। ড্রামের ভিতরের বাড়তি পানি সহজেই বের করে দেবার জন্য ড্রামের নিচের দিকে ৪ থেকে ৫ টি ছিদ্র করে দিন মাটি ভরাট করার পুর্বেই। ড্রাগন গাছের ডালপালা লতার মত হওয়ার কারনে গাছের হালকা বৃদ্ধির সাথে সাথেই খুঁটির সাথে বেঁধে দিবেন এতে করে গাছ সহজেই ঢলে পরবেনা।
ড্রাগন ফল সংগ্রহ:
ড্রাগন ফলের কাটিং চারা রোপনের ১ বছর থেকে ১৮ মাস বয়সে ফল সংগ্রহ করা যায়। গাছে ফুল ফোঁটার মাত্র ৩৫-৪০ দিনের মধ্যেই ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়।
এই ফল কাটলে ভেতরে রসালো যে অংশ থাকে, সেটাই খাবার অংশ, প্রয়োজনে ঐ শাসালো অংশ ফ্রিজে রেখে সংরক্ষন করা যায়।
আগামী দিনগুলোতে সরকারী এবং বেসরকারী উদ্যোগে এই ফল চাষে মনযোগী হলে নিজেদের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানী করা সম্ভব হবে ড্রাগন ফল।
তথ্যসূত্র:
উইকিপিডিয়া।
https://bangla.asianetnews.com/life/dragon-fruit-has-many-health-benefits-q2qpjv
https://bengali.indianexpress.com/lifestyle/miracle-dragon-fruit-successfully-grown-in-birbhum-west-bengal-53648/#
https://www.jubokantho.com/51850
ছবি: অন্তর্জাল।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:৩০