বিশ্বজাহানে 'আঠারো হাজার মাখলূকাত' রয়েছে, কথাটি ছোটবেলা থেকে আমরা শুনে এসেছি। এমনকি কথাটি শুনতে শুনতে এবং বলতে বলতে এটি এতটাই প্রসিদ্ধি পেয়েছে যে, এটাকে নির্ভরযোগ্য (অথেনটিক) বলে ধরে নেয়ার মত হয়ে গেছে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, এই কথাটির উৎপত্তিটা যে কোত্থেকে তা আজও অজ্ঞাত। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই কথাটিকে ইসলাম ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত করে বলা হলেও ইসলামের মূল উৎসধারায় এমন কথার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। না কুরআনুল কারিমের কোনো বর্ণনা দ্বারা প্রমানিত, না হাদিসের আলোকে যুক্তিসিদ্ধ 'আঠারো হাজার মাখলূকাত' ধারণাটি।
সুবিশাল বিশ্ব জগতে কত যে বিচিত্র প্রাণির বিচরণ! আমরা তার কতটুকুই আর জানতে পেরেছি! বিশ্বজাহানের সৃষ্টিবৈচিত্রের সামনে নিজেকে নিতান্ত ক্ষুদ্র বলে মনে হয়। নিত্য নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের জানার পরিধিকে বৃদ্ধি করে নিচ্ছি। কিন্তু আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা (The limitation of our knowledge) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা মানবজাতির সৃষ্টির পূর্বেই জানতেন। আর জানতেন বলেই তিনি তা বলেও দিয়েছেন পবিত্র কুরআনুল হাকিমে-
وَمَا أُوتِيتُم مِّن الْعِلْمِ إِلاَّ قَلِيلاً
'আর তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে।' সূরাহ আল ইসরা, আয়াত-৮৫
of knowledge it is only a little that is communicated to you, (O men!)
আর বিশ্বজাহানের সকল সৃষ্টিকুলকে মূলত: আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা মানুষের কল্যানে সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ, কোনো না কোনোভাবে মানুষ এদের দ্বারা উপকার লাভ করে থাকে। সৃষ্টির বৈচিত্র রক্ষা বলুন আর প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখা- যা-ই বলি না কেন, প্রকৃতপক্ষে জানা-অজানা অগণিত সৃষ্টি মানবজাতির কল্যানই করে যাচ্ছে। জলে-স্থলে মানুষের তুলনায় আকার-আকৃতিতে অনেক অনেক গুন বড় এবং বিশাল বিরাটাকায় প্রাণিকুলকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রদান করে মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন করেছেন মহান স্রষ্টা বারি তাআ'লা। হিংস্র প্রাণিজগতকেও অনুগত এবং বাধ্য করার কৌশল, প্রজ্ঞা এবং জ্ঞান মানুষকে তিনি দান করেছেন। এ জন্য বলা যুক্তিযুক্ত যে, জগতের বৈচিত্রময় মাখলূকাতরাজি নি:সন্দেহে মানবজাতির প্রতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা প্রদত্ত অনন্য নিআমত।
এই নিআমত গুণে শেষ করা সম্ভব নয়। একথাও তিনি পবিত্র কুরআনে হাকিমে ঘোষনা করেছেন-
وَإِن تَعُدُّواْ نِعْمَةَ اللّهِ لاَ تُحْصُوهَا إِنَّ اللّهَ لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ
'যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।' সূরাহ আননাহল, আয়াত-১৮
If ye would count up the favours of Allah, never would ye be able to number them: for Allah is Oft-Forgiving, Most Merciful.
মূলত: যখন আমি কারও কাছে এই বর্ণনা শুনতাম যে সারা পৃথিবী তে ১৮ হাজার মাখলুক (প্রানি) আছে, আমি খুবই অবাক হতাম! কারন, একথা সবারই জানা যে, বিজ্ঞানীরা এর বেশি প্রাণী ইতোমধ্যেই আবিস্কার করে ফেলেছেন!
আসলে পবিত্র কুরআনুল কারীমে নির্দিষ্ট কোন প্রাণির সংখ্যা বলা নেই।
এমনকি এটি কোন হাদিস নয়। জাল, বানানো কোন হাদিস হিসেবে যে শোনা যায় তাও না। সবাই এমনই বলে যে ইসলামে আছে, ইসলাম বলে। প্রকৃতপক্ষে এই বর্ণনাটা সম্পুর্ণ ভুল। ইসলামের কোথাও এমন বর্ণনা পাওয়া যায় না। কোন না কোনভাবে কেউ একজন এমন কথা প্রচলন করেছিল, সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করা ব্যাতিত এভাবেই চলে আসছে।
'আঠারো হাজার মাখলুকাত' কথাটি হাদীস নয়:
উপরের কথাটি লোকমুখে এতই প্রসিদ্ধ যে, অনেকের কাছে তা কুরআন-হাদীসের বাণীর মতো স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু মাখলুকাতের এই নির্দিষ্ট সংখ্যা না কুরআনে আছে, না কোনো সহীহ হাদীসে। বাস্তবতা হল, আল্লাহ তাআলা অগণিত মাখলুক পয়দা করেছেন। জলে ও স্থলে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাখলুক আল্লাহর অসীম কুদরতের প্রমাণ। মানুষের জানার বাইরেও রয়েছে অসংখ্য মাখলুক। আল্লাহ তাআলা কত ধরনের মাখলুক সৃষ্টি করেছেন তার নির্দিষ্ট সংখ্যা সহীহ হাদীসে বলা হয়নি। একটি ‘মুনকার’ বর্ণনায় এর সংখ্যা ‘এক হাজার’ বলা হয়েছে। কিন্তু অনেক মুহাদ্দিস বর্ণনাটিকে মাওযূ বা জাল বলে আখ্যা দিয়েছেন। (আলমাওযূআত, ইবনুল জাওযী ২/২১৬; আলফাওয়াইদুল মাজমুআ পৃ. ৪৫৮-৪৫৯) এছাড়া এই সংখ্যা সম্পর্কে কিছু মনীষীর উক্তিও রয়েছে। যেমন মারওয়ান ইবনুল হাকামের কথামতে সতের হাজার জগত রয়েছে। আর আবুল আলিয়ার অনুমান অনুযায়ী চৌদ্দ হাজার কিংবা আঠারো হাজার মাখলুকাত আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। এই বিভিন্ন সংখ্যা কিছু মনীষীর উক্তিমাত্র, হাদীস নয়। দ্বিতীয়ত তাদের বক্তব্য থেকেও অনুমিত হয় যে, নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা বোঝাতে নয়; বরং আধিক্য বোঝাতেই তারা এ সব কথা বলেছেন। তাও আবার অনুমান করে। এই কারণে এর কোনোটিকেই প্রমাণিত সত্য মনে করার কোনো কারণ নেই; বরং এ বিষয়ে ইবনে কাসীর রাহ.-এর কথাটিই মূল কথা, যা তিনি আবুল আলিয়ার পূর্বোক্ত কথাটি পূর্ণভাবে উদ্ধৃত করার পর বলেছেন। আর তা হল, هذا كلام غريب يحتاج مثل هذا إلى دليل صحيح অর্থাৎ এটি এমন একটি আজব কথা, যার জন্য বিশুদ্ধ দলীলের প্রয়োজন রয়েছে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/২৬) অতএব আঠারো হাজার নয়; বরং বলা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা অসংখ্য অগণিত মাখলুক পয়দা করেছেন, যা আমরা গুণে ও হিসাব করে শেষ করতে পারব না।
অতএব এভাবে যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো কিছু প্রচার করা অতি নিন্দনীয়, অমূলক এবং নিতান্ত গর্হিত কাজ।
ছবি: অন্তর্জাল।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১০:১৬